ঢাকাঃ দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর ১৫ শতাংশ কর দেওয়া সংক্রান্ত রিট আপিল নিষ্পত্তি হলেও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এমন সিদ্ধান্তে এই খাতে নির্ভরশীল শত শত শিক্ষক-কর্মচারীর ঈদের আগে বেতন-বোনাস না হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
১৫ শতাংশ আয়কর না দেওয়ার অভিযোগ তুলে নর্থ সাউথসহ দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে দিয়েছে কর উপকমিশনারের কার্যালয় (সার্কেল-৩)। ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রেজিস্ট্রারকে পাঠানো চিঠি দেওয়া হয় গত ৪ মার্চ। চিঠিতে জানানো হয়, ‘আয়কর আইন-২০২৩-এর ২১৪ ধারা মোতাবেক বকেয়া পরিশোধের নোটিশ পাঠানো হলো। চলতি ১৫ মার্চের মধ্যে কর পরিশোধ করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। এই কর প্রদানে ব্যর্থতায় আয়কর আইন-২০২৩-এর ২৭৫ ধারা অনুযায়ী জরিমানা আরোপসহ অন্যান্য আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।’
কর উপ-কমিশনার মো. জহিরুল ইসলাম ভূইয়ার সই করা চিঠিতে আরও জানানো হয়, ‘যদি ইতোমধ্যে কর পরিশোধ করে থাকেন, তবে পরিশোধিত চালানের কপি বা প্রমাণাদি অথবা কোনও আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকে, তার প্রমাণাদি নিম্নস্বাক্ষরকারীর দফতরে উল্লিখিত তারিখের মধ্যে (১৫ মার্চ) দাখিল করার অনুরোধ করা হলো। অন্যথায়, বকেয়া দাবির ব্যাপারে আপনার পক্ষ থেকে কোনও আপত্তি নেই বলে বিবেচিত হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দফায় দেশের ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্ট স্থগিত করা হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, ডেফোডিল ইউনিভার্সিটি, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ ও প্রাইম ইউনিভার্সিটি। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হবে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আদালত যেহেতু রায় দিয়ে দিয়েছেন, উনারা যেহেতু আপিল করেননি, সেহেতু ইনকাম ট্যাক্স অফিসারের এখতিয়ার আছে এই ব্যবস্থা নেওয়ার। আপিল বিভাগ স্থগিত করলে আমরা পারতাম না। যেহেতু আমরা একটা রায় পেয়েছি, সেহেতু ট্যাক্স চাওয়া যেতেই পারে।’
নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি অ্যাকাউন্ট স্থগিত করা হয়েছে, তাহলে তারা ঈদের আগে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেবে কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘তারা এখন কনসার্ন ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে বসে সেটেল করবে। ব্যাংক অ্যাটাচমেন্ট তো এমনি দেওয়া হয় না। তার আগে অনেকবার নোটিশ করা হয় ট্যাক্স দেওয়ার জন্য। অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এগুলো পারফর্ম না করলে এটা লাস্ট স্টেপ।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এই সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি জানিয়েছে, সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর প্রদান সংক্রান্ত রিট আপিলের নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে রায় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণের বিশদ বিবরণ এখনও প্রকাশিত হয়নি। তথাপি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর দেওয়ার চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে এবং দুঃখজনকভাবে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেনের ৩১ মার্চ সই করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ এবং রায় অনুযায়ী আয়কর দেওয়ার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কোনও সুযোগ না দিয়ে রোজা চলাকালীন মুসলমানদের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত করা একটি অমানবিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রতীয়মান। কেননা, এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল সংখ্যক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবারের বেতন, বোনাস এবং অন্যান্য বিল পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।
আদালতের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা প্রকাশের আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত করায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খাতে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করে শেখ কবির হোসেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি এখনও হাতে পাইনি। আমরা তো অপেক্ষা করে আছি। আদালতের রায়ে নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে। রায় হাতে না পেলে কীভাবে নিষ্পত্তি হবে? অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হবে আমাদের এমন চিঠিও দেওয়া হয়নি। অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ থাকলে বেতন-বোনাস দেওয়া যাবে না।’
অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘যে শিক্ষার্থী বিদেশে গিয়ে লেখাপড়া করছে, তার টাকার ওপরে ট্যাক্স নেই। তাদের কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর যে বাংলাদেশে পড়ছে তার টাকা দেশে থাকছে—অথচ ট্যাক্স আছে এটা কীভাবে হয়?’
এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান এখনও আদালতের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পাননি জানিয়ে বলেন, ‘অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ থাকলে তো আমরা ঈদের আগে বেতন-বোনাস দিতে পারবো না। আমরা চিন্তিত। কাল (সোমবার) কর কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক আছে, দেখি ওনারা কী করেন।’
এদিকে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ড. চৌধুরী মফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আয় সারপ্লাস থাকে না। দিন আনি, দিন খাই। এনবিআর অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ও ঈদের বোনাস দিতে পারছি না।’
ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য ড. মাহবুব মজুমদার বলেন, ‘আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনও হাতে পাইনি। আদালতের রায় পুনর্বিবেচনার সুযোগও আছে। এসব প্রসিডিউর না মানলে তো হবে না। মিনিমাম একটা সময় দিতে হবে।’
এনবিআর থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘বিষয়টি জানি না, এইমাত্র আপনার কাছ থেকে জানলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটা কোনোভাবে কাম্য নয়।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশের সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হবে বলে রায় দেন আপিল বিভাগ। ওই রায়ের কপি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাতে এখনও পৌঁছায়নি। তাছাড়া রায়ের সার্টিফায়েড কপি হাতে পেলে তারা রায় পুনর্বিবেচনার জন্য রিভিশন করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আইনি এসব প্রক্রিয়ার বিষয়টি মাথায় না নিয়েই ঈদের আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা অমানবিক বলে মনে করছে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
কর কমিশন অফিস থেকে রায়ের বিষয়ে উল্লেখ করে চিঠি দিয়েও জানায়নি। কিন্তু রায় হওয়ার ছয় দিনের মাথায় গত ৪ মার্চ কর আদায়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চিঠি দেওয়া হয়। মাত্র কয়েক দিন সময় দিয়ে কর পরিশোধের চিঠি দেয় কর উপ-কমিশনার। ১৫ মার্চের মধ্যে কর পরিশোধের আল্টিমেটাম দেয় উপ-কর কমিশন অফিস (সার্কেল-৩)। নির্ধারিত ১৫ মার্চ শেষ হলে কোনও চিঠি না দিয়ে ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়া হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়েছে। ঈদের বেতন-বোনাস বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষকরা পড়েছেন বেকায়দায়।
প্রসঙ্গত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ আয়কর আরোপিত হলে রাষ্ট্রপতির কাছে বিষয়টি বিবেচনার জন্য আবেদন জানিয়েছিল বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/৩১/০৩/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.