অধ্যক্ষ মহিউদ্দিন লিটনঃ শিক্ষকের মর্যাদা নিয়ে আমাদের সমাজে এ রকম প্রচলিত ধারণা আছে যে, একজন শিক্ষক হচ্ছেন আলোড় দিশারি তিনি শিক্ষা দিবেন আর আলোর পথ দেখাবেন তিনি শুধুমাত্র একজন শিক্ষকই। সমাজের অন্য মানুষের মতো তিনি টাকা-পয়সা, সুযোগ-সুবিধা, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। সারাটা জীবন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করতে করতে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেবেন। বিনিময়ে তিনি সালাম, মর্যাদা, সম্মান ইত্যাদি পাবেন। সবাই তাঁকে মহৎ পেশায় নিয়োজিত একজন মহান ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করবে, তিনি নিজেকে ধন্য মনে করবেন। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষকরা সেই মর্যাদা সবায় পান না। অতীতে শিক্ষকরা জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার দিকে না তাকিয়ে শিক্ষাদানের মহৎ কর্মে ব্রতী হতেন বলে তাঁরা অনেক সামাজিক মর্যাদা ভোগ করতেন। আগে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কম ছিল বলে শিক্ষিত মানুষ হিসেবে শিক্ষকরা যে এক ধরনের মর্যাদা পেতেন। শিক্ষার হার বাড়ায় মর্যাদার হ্রাস পেয়েছে।
একটি দেশের শিক্ষার গুণগত মান বাড়লে অবধারিতভাবে সেই দেশের শিক্ষকের মর্যাদা বাড়বে। একইভাবে সে দেশের শিক্ষার গুণগত মান কমলে শিক্ষকের মর্যাদা কমবে। দুই ক্ষেত্রেই এই বৃদ্ধির বিষয়টি দুভাবে ত্বরান্বিত করা যায়। এক হতে পারে আগে শিক্ষকের মর্যাদা বাড়িয়ে দেওয়া, তাতে শিক্ষার গুণগত মান এমনিতেই বাড়বে। আরেক রকম যেটা হতে পারে সেটা হচ্ছে আগে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানো হবে, তার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকের মর্যাদা বাড়ে। এখন কোনটা আগে হবে তা নির্ভর করবে যাঁরা চালকের জায়গায় বসে আছেন তাঁদের ওপর। শিক্ষকের মর্যাদা বাড়ানোর দায়িত¦ যেহেতু রাষ্ট্রের সেহেতু এখানে রাষ্ট্র একটি পক্ষ এবং শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর মূল দায়িত্ব যেহেতু শিক্ষকের এখানে শিক্ষক আরেকটা পক্ষ। এখন রাষ্ট্র আগে না শিক্ষক আগে সেটা নিয়ে তর্ক করলে সেটা অনেকটা ‘ডিম আগে না মুরগি আগের মতো অমিমাংসিত তর্কে পরিণত হয়ে যাবে।
করোনাকালে যখন সরকার- অভিভাবক-শিক্ষার্থী সবাই দিশেহারা, শিক্ষকরা তখন কখনো কখনো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও টিভি,অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনার সময় প্রথম প্রথম কিছু শিক্ষক একটু আগ্রহ কম থাকলেও পরে শিক্ষকরা আন্তরিকভাবে এই কার্যক্রমটি বাস্তবায়ন করেছেন। করোনাকালীন সময়ে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা.দিপু মনি ঘোষণা করেছিলেন, যদি এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া না যায় তবে শিক্ষকদের দেওয়া অ্যাসাইনমেট এর নম্বরের ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীদের জিপিএ নির্ধারণ করা হবে। এ কার্যক্রমে শিক্ষকদের কিছুটা মর্যাদা বেড়েছে।
বর্তমানে নতুন কারিকুলামে প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক মূল্যায়নকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যা পরোক্ষভাবে শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখবে। নতুন কারিকুলামে একজন শিক্ষার্থীর জিপিএ কী হবে, তার অনেকটাই নির্ধারণ করবেন তাকে যিনি পড়ান সেই শিক্ষক। একজন শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তৈরি হবে ।
শিক্ষকরা প্রস্তুতি নিতেছেন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাঁর দক্ষতা ও সততা দিয়ে নতুন কারিকুলামটি বাস্তবায়ন করার জন্য ও গুণগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠিত করতে। আর দেশে গুণগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠিত হলে একজন শিক্ষার্থী পড়ালেখা শেষ করে পরিবার ব্যয়ভার বহন করার পাশাপাশি রাষ্ট্রে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অগ্রনী ভুমিকা রাখতে পারবে। বর্তমানে আমার দৃষ্টিতে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধার পার্থক্য অনেক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন করেছেন। এ সময়ে দশটি পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়, উনপঞ্চাশটি প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়সহ প্রতিটি উপজেলায় একটি করে করে সরকারি কলেজ করার আলোকে ইতি মধ্যে দুইশত একাত্তরটি কলেজ সরকারি করা হয়েছে। সারা দেশে তিনশত উনত্রিশটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়েছে। শুধুমাত্র ২০১৩ সালে ২৫৮৩১ প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করন করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সরকার । বিগত কয়েক বছরে চার হাজার নয়শত তেষট্রটি স্কুল,কলেজ, মাদ্রাসা এমপিও ভুক্ত করেন। প্রতি বছর প্রথম থেকে দশম শ্রেনি পযর্ন্ত শিক্ষাথীদের মাঝে বিনামূল্য বছরে প্রথম দিনই বই তুলে দেন। সরকারিভাবে মেধা বৃত্তি ও মেয়েদের উপবৃত্তি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক শেখ রাসেল আইসিটি ল্যাব প্রদান করেন সরকারিভাবে।
এছাড়াও আরো কিছু সরকারিভাবে বিশ^বিদ্যালয়,কারিগরি স্কুলের স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। এখন সময়ের চাহিদা জরুরী এমপিও ভুক্ত স্কুল,মাদ্রাসা ও কলেজগুলো সরকারি করা। বিশেষ করে সম্পন্ন বেসরকারি স্কুলও কলেজ শিক্ষকদের দিকে নজর দেওয়ার এখন সময়ের দাবী। সম্পন্ন বেসরকারি স্কুল ও কলেজ শিক্ষকরা সৃজনশীল বিষয়ে প্রশিক্ষণ, নতুন কারিকুলামের বিষয়ে এমপিও শিক্ষকদের সাথে প্রশিক্ষণ করার সুযোগ পান ।
শিক্ষাবোর্ডাও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সকল নির্দেশনা মেনে চলেন। সম্পন্ন বেসরকারি স্কুল ও কলেজ শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নিয়ে আন্তরিকতা সহিত পাঠদান করান। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে আর্থিক সুযোগ সুবিধার পার্থক্য অনেক। সরকারি ও এমপিও শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধার বৃদ্ধির পাশাপাশি সম্পন্ন বেসরকারি স্কুলও কলেজ শিক্ষকদের আর্থিকভাবে কিছু না কিছু বিবেচনা করা দরকার। এখন সকল শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার সময়ের দাবি।
লেখক: অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ,বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৩/০১/২০২৪
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সর্বশেষ সংবাদ, শিরোনাম, ছবি ও ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তা’য়।
“মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.