মো. আমিনুল ইসলাম :
সংবাদপ্রত্রের পাতা এবং টেলিভিশনের পর্দায় এখন যা খবর হয়ে বের হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন, তা একটু বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে বিব্রত করছে। লজ্জিত করছে। শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ এগুলোই এখন খবর!
স্কুল ছাত্রী, মাদ্রাসা ছাত্রী, গৃহবধূ, নার্স, পোশাক শ্রমিক কেউ বাদ পড়ছেন না এই পাশবিকতার নির্মমতা থেকে! আর এই অপকর্মের সাথে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, বাস চালক, হেলপার থেকে প্রভাবশালীদের নাম! যা আমাদের ঘুণে ধরা সমাজে অবক্ষয়ের তীব্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সাত বছরের একটি মেয়ে। বড়সড় একটি পুতুলের মতো দেখতে সে। পুতুলের মতো মেয়েটি ছোটাছুটি করে সারা বাড়ি মাথায় করে রাখতো। সাত বছরের শিশুরা যেমন হয়! মেয়েটি স্কুলেও যাওয়া শুরু করেছিল। তার খাতার পাতায় এখনও জ্বলজ্বল করছে সদ্য লিখতে শেখা গোটা গোটা হাতের লেখা। গত ঈদে কেনা রঙিন ফ্রকটি এখনও তার আলমারিতে ভাঁজ করা আছে। তার পানি খাওয়ার মগ, ভাত খাওয়ার থালা, স্কুলের ব্যাগ সবই তেমন আছে। শুধু মেয়েটি নেই। নেই মানে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তারও আগে ধর্ষণ করা হয়েছে তাকে। লিখতে গিয়ে হাতটা একটু কেঁপে উঠলো কি! হয়তো! সাত বছরের একটি মেয়ে, যে এখনও জীবনকে চিনতেই শুরু করেনি, তাকে কি না মেনে নিতে হলো মৃত্যুর মতো করুণ উপসংহারকে! তারও আগে সহ্য করতে হলো পৃথিবীর নিকৃষ্টতম অত্যাচারকে!
অপরাধী ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সদ্য কৈশরোত্তীর্ণ এক যুবক। এই বয়সের যুবকেরা নিজেকে গুছিয়ে নিতে শুরু করে। নিজের একটা পরিচয়, বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন তৈরির চেষ্টা করে। এই বয়সে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, কেউ ব্যবসা শুরু করে, কেউ শ্রমিকের কাজ করে। তাই বলে একটা মানুষ খুন? খুনি এই যুবকটি কি জানতো তার মধ্যে বাস করছে এক খুনি সত্তা! তার এই খুনি সত্তা একদিনে গড়ে ওঠেনি। যে কোনোভাবেই হোক, যুবকটির ভেতরে এই বিশ্বাস গড়ে উঠেছে যে একটি খুন করলে কিছুই হয় না! যেন খুন করা খুব স্বাভাবিক একটি কাজ। যেন চাইলেই যে কাউকে মেরে ফেলা যায়! পেশাদার খুনি না হয়েও যখন তখন যে কাউকে মেরে ফেলার মতো এমন অনেক খুনিই আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো একটি খুনের ঘটনা ঘটলেই কেবল আমরা তাদের দেখতে পাই। হয়তো আপনার-আমার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এই অসহশীল সত্তা, আগামী দিনের খুনি!
এই অবক্ষয়ের স্রোতে সবাই গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন তা হয়তো নয়। তবে এটা রোধে সামাজিক যে জোরালো প্রতিবাদ গড়ে তোলার কথা ছিল সেটা করা যাচ্ছে না। বা হচ্ছে না। শুধু আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী কঠোর হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে তাও না। এই অবক্ষয় রোধে শুভ বুব্ধি সম্পন্ন মানুষকে জেগে উঠতে হবে। হাতে হাত ধরে রাস্তায় নামতে হবে। সেই জায়গায় আমরা কেন জানি সামনের দিকে পা বাড়াতে চাইছি না। অথবা পারছি না।
এই না পারার গ্লানিবোধ অনেককে পোড়াছে। কিন্তু সেই দগ্ধ মনের যন্ত্রণা নিয়ে তারা দিন পার করছেন। অস্ফুট স্বরে হয়তো বলছেন;‘ এ কোন সমাজের বাসিন্দা হয়ে গেলাম আমরা! যেখানে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের কাছে নিরাপদ নয় তার ছাত্রী, যেখানে স্কুল শিক্ষকের কাছেও অনিরাপদ কিশোরীরা! ঘরে-বাইরে, চলন্ত বাসে, কোথায় তারা নিরাপদ!
আসলে গোটা সমাজে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। দায়টা সবাই সরকারকে দিয়ে পার পেতে চান। কিন্তু সরকারের পাশে সমাজের বিবেক বলে যারা দাবি করেন, তারা কতটা এসে দাঁড়াছেন? একটা মানব বন্ধন, কয়েকটা মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করলেই সমাজের এই অন্ধকার দূর হয়ে যাবে সেটা আশা করা বাড়াবাড়ি।
আমাদের এই সমাজের আরেকটা খারাপ উপসর্গ; আমরা কার্পেটের নিচে আগুন লুকাতে চাই। সবকিছু লুকিয়ে রেখে সমাধান খুঁজতে চেষ্টা করি। এই সব ধর্ষণের প্রবণতা কেন বাড়ছে, তার নানা রকম যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছি যে যার পক্ষ থেকে।
কেউ অতি নারীবাদী হয়ে যাচ্ছেন। আবার কেউ দুষছেন নারীদের। বলছেন তার পোশাক, চাল-চলন এই সব আদিম উগ্র বাসনাকে জাগিয়ে দিচ্ছে। যে কারণে ধর্ষণের মত ঘটনা বাড়ছে! হাস্যকর। নারী যে দেশে বোরকা পরে, হিজাব পরেও নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারছেন না, সেখানে ঐ সব সেকেলে যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা যারা করেন তারা আসলে কামান্ধ। বিবেক বন্ধক রাখা ব্যক্তি।
দিন কয়েক আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক সাংবাদিক বন্ধু তাঁর নিজের টাইম লাইনে লাল অক্ষরে ব্রেকিং নিউজের মত করে লিখেছেন; আজ একটাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি! বুঝতে অসুবিধা হয়নি বিবেক কতটা পোড়ালে তিনি এরকম একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
যে দেশে গণমাধ্যমের নিত্য দিনের সংবাদ হয়ে আসছে ধর্ষণ, সেখানে একটা দিন সেরকম কিছু না দেখলে খানিকটা স্বস্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু মনে যে সারক্ষণ অস্বস্তির কাঁটা খোঁচা দেয়; এ কোন সমাজের বাসিন্দা হয়ে গেলাম আমরা যেখানে ধর্ষণ হয়ে দাঁড়াছে শিরোনাম।
ধর্ষিতাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে থানায় আরো একবার মুখে ধর্ষণ করা হয়। যেখানে একজন নার্স, যিনি হাজার রোগীকে সেবা করছেন, তিনি বাড়ি ফিরতে পারছেন না নিরাপদে! ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে তাঁকে। সত্যিই ধর্ষণ শিরোনামের এখন পরিচিত এক শব্দে রুপ নিয়েছে।
কিন্তু আজকের এই পরিচিত সমাজ কোনভাবেই কাঙ্খিত হতে পারে না নিজেদের সভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দেয়ার জন্য। ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর তিন লক্ষ মা -বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন নারীকে আবার নিজের সম্ভ্রম বিসর্জন দিতে হবে, তেমন বাংলাদেশ তো আমরা চাইনি। অর্ধ শতাব্দীর দিকে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের এই সামাজিক অবক্ষয় রুখবে কারা? তাহলে কী আমাদের সভ্যতা পশ্চাদমুখি হয়ে পড়েছে? আমরা কী ফিরে যাচ্ছি সেই আদিম যুগে? তাতো হতে পারে না।
তীব্র এক লজ্জাবোধ প্রায় প্রতিদিন আঘাত করছে আমাদের। লজ্জিত হচ্ছে বৈষম্যহীন সমাজ বির্নিমাণের প্রত্যাশা। প্রতিদিন লাঞ্ছিত হচ্ছে আপনার আমার স্ত্রী-কন্যা, বোন। কিন্তু আমি, আমরা এখনও নির্বাক। একবার আমাদের সরব হয়ে ওঠা দরকার। চিৎকার করে ওঠা দরকার। বলা দরকার, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এর এই উপত্যকা আমার দেশ হতে পারে না। আমি , আপনি, আমরা এই সমাজের বাসিন্দা হতে পারি না।
সায়মার মায়ের অভিশাপ কি একটুও আঁচড় কাটবে না এই মানচিত্রে? সায়মার বাবার কাঁধে সন্তানের লাশের যে বোঝা আমরা চাপিয়ে দিয়েছি, সেই ভার সইতে পারবে তো বাংলাদেশ! হয়তো পারবে! এর আগেও তো তনু, রিশা, মিতু, বিশ্বজিৎ, নুসরাত, রিফাতদের ভার সয়ে নিয়েছে। সয়ে নিয়েছে সেই সব হতভাগ্যের লাশ যারা শুধু মৃত্যুই পেয়েছে, বিচারটুকুও পায়নি! আমাদের চোখের জল, আমাদের দীর্ঘশ্বাস, আমাদের অসহায়ত্ব, আমাদের হাহাকার, আমাদের অভিশাপ- সব সয়ে নিতে পারে আমাদের এই দুখিনী দেশ। আর আমরা বেঁচে থাকি তার সেই সব মেরুদণ্ডহীন সন্তান হয়ে, যারা শুধু দেখে আর সহ্য করে যায়, প্রতিবাদ করতে জানে না!
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.