এইমাত্র পাওয়া

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কী চলছে?

ঢাকাঃ  শিক্ষা ব্যবস্থা রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে শিক্ষার্থীকে দক্ষ করে তুলতে উদ্যোগ নেয় সরকার। এর ধারাবাহিকতায় ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম পরিবর্তন শুরু হয় ২০২২ সালে। এ রূপরেখা প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন মহলে উৎসাহ দেখা গেলেও বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে একটি শ্রেণির মধ্যে বিরূপ মনোভাব দেখা যায়।

শিক্ষাবিদরা বলেছেন— ‘সংস্কার ভেঙ্গে নতুনকে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে সব সময়ই প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। প্রতিক্রিয়াশীলরাও বুঝে অথবা না বুঝে প্রতিবাদে নেমে পড়েন। তাই বলে ভালো কাজ থেকে পিছু হটার কোনও সুযোগ নেই। শুরুতে গুজব, তারপর অপপ্রচার চলতে থাকে। এতে অভিভাবকরা ভুল বুঝতে পারেন, এমনকি ভুল দাবিও করে বসতে পারেন। তবে তা নিরসন করতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলছেন, অভিভাবকদের মাঠে নামাতে নেপথ্যে রয়েছে কোচিং বাণিজ্য ও নোট-গাইড ব্যবসা। এছাড়া রাজনৈতিক কারণে জাতীয় শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু না হতেই আন্দোলনে নামা হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হলে বিবর্তনবাদ নিয়ে প্রথম গুজব তৈরি হয়। ইসলাম ধর্ম শিক্ষা বাদ দেওয়া হচ্ছে বলেও অপপ্রচার চলতে থাকে। গুজব ও অপপ্রচার ঠেকাতে পাঠ্যবই থেকে বিবর্তনবাদ অংশটিই বাদ দেওয়া হয়। আর শিক্ষা প্রশাসন সঠিক তথ্য তুলে ধরলে অপপ্রচার ও গুজবের সাময়িক নিরসন হয়। তবে সম্প্রতি অভিভাবকরা জাতীয় শিক্ষাক্রমের বিরোধিতায় সরাসরি মাঠে নেমে পড়েন। তারা নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন নিয়ে সমালোচনা করে নতুন শিক্ষাক্রমের বিরোধিতা শুরু করেন। নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনেও অভিভাবকরা মানববন্ধন করে শিক্ষাক্রমের বিরোধিতা করেছেন। শুক্রবার (১০ নভেম্বর) সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছে।

নতুন শিক্ষাক্রমের সমালোচনার জবাবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে পৃথিবীর বাস্তবতা অনেকটাই পাল্টে যাচ্ছে। শ্রমনির্ভর অর্থনীতির মডেল সামনে হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তির প্রসারের ফলে ভবিষ্যতে নতুন অনেক কর্মসংস্থান তৈরি হবে, যার কারণে বর্তমান সময়ের অনেক পেশা ও শ্রম অচিরেই প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশের সম্ভাবনার দিক হলো— এদেশের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী, যার জনমিতিক সুফল পেতে হলে অনতিবিলম্বে আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা প্রয়োজন ছিল। সে কারণেই শিক্ষার রূপান্তর ঘটানো হচ্ছে। কিন্তু যেসব শিক্ষক কোচিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তারা এই শিক্ষাক্রমে সন্তুষ্ট নন। কারণ তাদের ব্যবসা নষ্ট হচ্ছে। পাঠ্যবই বা মূল্যায়ন নিয়ে কোনও অভিযোগ থাকলে কেউ করতে পারে, কিন্তু তা না করে আন্দোলনে নেমে পড়ছেন। কোচিং বাণিজ্য পরিচালনাকারী শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা এই অপপ্রচার ও আন্দোলনের নেপথ্যে রয়েছেন।’

কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান বলেন, ‘পুরাতন সংস্কার ছেড়ে নতুন ধারণা মেনে নিতে চায় না মানুষ। তাছাড়া নতুন ধারণা বুঝতে সময় লাগার কথা। যদি কারও কাছে মনে হয় তার সন্তানের পড়ালেখায় ক্ষতি হচ্ছে, কিংবা বাড়তি ব্যয়ভার বহন করতে হচ্ছে, তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অভিযোগ করার কথা। কিন্তু তা করা হয়নি। অথচ সরাসরি মাঠে নেমে আন্দোলন করা হচ্ছে। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন চলবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত। অথচ শুরু হতে না হতেই আন্দোলন করা হচ্ছে মাঠে নেমে। আর সে কারণেই আন্দোলনটা রহস্য মনে হচ্ছে। নতুন বিষয় বুঝতে হলে সময় প্রয়োজন, জানা প্রয়োজন, তা না করেই কেন আন্দোলন সেটিই বড় প্রশ্ন? রাষ্ট্র বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিয়ে নিজে পরিকল্পনা করে নিজেই গর্তে পড়বে এমনটা কখনই হতে পারে না এই ম্যাচিউরিটি তাদের (অভিভাবক) থাকার কথা।’

অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান আরও বলেন, ‘আমরা যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি শেষ ছয় জেনারেশনের মধ্যে কেউ এই অভিজ্ঞতা নেয়নি। এবং এটা একটা বৈশ্বিক পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনটায় নিজেকেই একটা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তা না বুঝে আন্দোলন কেন করা হচ্ছে?’

শিক্ষাক্রমের সমালোচনা ও অভিভাবকদের বিরোধিতার প্রশ্নে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য ড. অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যাপক শিক্ষার্থী রয়েছে এবং কোচিং বাণিজ্য রয়েছে, সেখানে সমস্যা দেখা যাচ্ছে। অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক ও শিক্ষকদের অভিযোগ নেই। আন্দোলন সেসব প্রতিষ্ঠানের অভিভাবকরাই করছেন যেখানে শিক্ষকরা কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। যেখান শিক্ষকরা কোচিংয়ে জড়িত নন, সেসব প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক বা শিক্ষকদের কোনও অভিযোগ নেই। অনেক প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষক কোচিং করেন এবং কোচিং বাণিজ্য পরিচালনা করেন বড় বড় শহরে, যেখানে বাণিজ্য বেশি। উদ্দেশ্যমূলক যখন কিছু করে তখন তাকে বোঝানো যায় না। কিন্তু আমাদের তো পিছু হটার সুযোগ নেই। তাছাড়া শতাধিক বছর ধরে যা চলছে তা মানুষের মগজে গেঁথে আছে। সেখান থেকে বের হওয়া কঠিন। এক্ষেত্রেও তা হবে। তবে এর নিরসনও হবে।‘

কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্পর্কে ড. অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘শিক্ষক গাইড এমনভাবে দেওয়া হয়েছে যাতে অনেক বেশি যোগ্য শিক্ষক না হলেও সমস্যা হবে না। শিক্ষকরা গাইড ফলো করেই শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে পারবেন, শিক্ষার্থীরা নিজেরাই শিখতে পারবেন।‘

শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের উদ্দেশ্যে শিক্ষা ব্যবস্থার সকল ধারাকে বিবেচনা করে প্রথমবারের মতো জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা- ২০২১ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই রূপরেখা প্রণয়ন এবং তার ভিত্তিতে বিস্তারিত শিক্ষাক্রম, শিখন শেখানো সামগ্রী এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়া প্রণয়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শিক্ষাক্রম প্রণয়নের আগে ২০১৭-২০১৮ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ৮টি গবেষণা পরিচালনা করে। তার ভিত্তিতে এই রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়।

‘বুকিংস রিপোর্ট (২০১৬) অন স্কিলস ফর চেঞ্জিং ওয়ার্ল্ড’ এ দেখা যায়, ১০২টি দেশের মধ্যে ৭৬টি দেশের শিক্ষাক্রমে সুনির্দিষ্টভাবে দক্ষতাভিত্তিক যোগ্যতাকে নির্ধারণ করা হয়েছে এবং ৫১টি দেশের শিক্ষাক্রম সম্পূর্ণ রূপান্তরমূলক দক্ষতাভিত্তিক করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দিকে তাকালেও দেখা যায়, ভুটান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশও তাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। বাংলাদেশও একইভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় একটি সার্বিক পরিবর্তনের তাগিদ অনুভব করছিল যা একইসঙ্গে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় শিক্ষার লক্ষ্য, শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া, মূল্যায়ন, শিখন পরিবেশ, শিখন উপকরণ, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, এলাকার জনগণসহ সকল উপাদানের মাঝে আন্তঃসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে একই পরিবর্তনের ধারায় নিয়ে আসবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় আরও জানায়, নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে মিথ্যাচার হচ্ছে। গত জানুয়ারিতে এর সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার লক্ষ্যে বই নিয়ে মিথ্যাচার করা হয়েছিল। মিথ্যাচারকারীরা চায় না শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে শিখতে, চিন্তা করতে শিখুক, অনুসন্ধিৎসু হোক, মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার চর্চা করুক। ওরা চায় মগজ ধোলাইয়ের শিক্ষাই চালু থাকুক।

শিক্ষাক্রম বিরোধিতা করে যেসব প্রশ্ন তোলা হয়, সে বিষয়ে শিক্ষা প্রশাসন ব্যাখ্যা দেয় গত ৩১ অক্টোবর। শিক্ষামন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করেও ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু সেই ব্যাখ্যা নিয়ে কোনও আলোচনা বা সভা সমাবেশ না করেই সরাসরি মাঠে নেমে আন্দোলন করা হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রমের বিরোধিতা করে। সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১০/১১/২০২৩ 

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.