এইমাত্র পাওয়া

কারিগরি শিক্ষায় আগ্রহ হারাচ্ছে শিক্ষার্থীরা

শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ কারিগরি শিক্ষায় নানামুখী সুযোগ-সুবিধা দিয়েও শিক্ষার্থী বাড়ানো যাচ্ছে না। এমনকি শিক্ষা বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ বাড়লেও সেই অনুপাতে বাড়ছে না শিক্ষার্থীর সংখ্যা। গত পাঁচ বছরের বাজেট বরাদ্দ ও শিক্ষার্থীর তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের কারিগরি শিক্ষার ডিপ্লোমা স্তরে সরকারের খরচ হয়েছে ১৫০ কেটি ৬৯ লাখ ৬৩ হাজার ৮ ৬৮ টাকা এবং বিপরীতে শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৯১ হাজার ২৬ জন। যদিও এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে কারিগরি শিক্ষায় সরকারের খরচ হয় ৭৬ কোটি ৯৩ লাখ ৩৮ হাজার ৩৯১ টাকা এবং বিপরীতে শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল এক লাখ ১১ হাজার ১২০ জন। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে কারিগরিতে বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে ৭৩ কোটি ৭৬ লাখ ২৫ হাজার ৪৭৭ টাকা। কিন্তু এই পাঁচ বছরে কারিগরিতে শিক্ষার্থী কমেছে ২০ হাজার ৯৪ জন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার কারিগরি শিক্ষায় আরো বেশি গতি আনতেই মূলত নানা ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে দক্ষ করতে দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে অগ্রাধিকারভুক্ত করে সরকার। দেশের শিক্ষামাধ্যমে সরকারের কারিগরি শিক্ষার এ উদ্যোগের মধ্যে ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত এবং এর মধ্যেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সফল অংশীদার হতে দক্ষ ও প্রযুক্তিনির্ভর মানবসম্পদ গড়তে প্রতিনিয়ত বাজেট বাড়ানো হচ্ছে দেশের কারিগরি এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষা খাতে। কিন্তু তারপরেও আশানুরূপভাবে শিক্ষার্থী টানতে পারছে না কারিগরি শিক্ষা।

সূত্র মতে, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যই বলছে, সরকারের ক্রমবর্ধনশীল অর্থায়ন এবং উদ্যোগ থাকলেও তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না দেশের কারিগরি শিক্ষায়। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে প্রতি বছরই ক্রমান্বয়ে কমছে কারিগরি শিক্ষার্থীর সংখ্যা। বর্তমানে দেশে কারিগরি শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার (এনরোলমেন্টে) বর্তমানে ১৭ দশমিক ২৫ শতাংশ হলেও সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এ হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করতে বাজেটে অর্থায়ন বৃদ্ধি করছে। সূত্র বলছে, দেশে কারিগরি শিক্ষায় বিগত পাঁচ বছরে সরকারের ব্যয় বেড়েছে ৭৩ কোটি ৭৬ লাখ ২৫ হাজার ৪৭৭ টাকা। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় সরকারের ব্যয় হয়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি অর্থ; কিন্তু বিপরীতে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ার কথা থাকলেও তাতে ধস নেমেছে বিগত বছরগুলোতে।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের তথ্য বলছে, দেশে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ডিপ্লোমা স্তরে শিক্ষার্থী ছিল এক লাখ ১১ হাজার ১২০ জন। সর্বশেষ ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে এ সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৯১ হাজার ২৬ জন। এর আগে ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে এক লাখ ছয় হাজার ৪১৮ এবং ৯৩ হাজার ৩০৯ জন। অর্থাৎ বিগত পাঁচ শিক্ষাবর্ষে দেশে কারিগরির ডিপ্লোমা স্তরে শিক্ষার্থী কমেছে ২০ হাজার ৯৪ জন। এ সময়ের মধ্যে সরকারের দ্বিগুণ ব্যয়েও বাড়েনি শিক্ষার্থীর সংখ্যা। অথচ সরকার আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার (এনরোলমেন্ট) ৩০ শতাংশে উন্নীত করার বিশেষ পরিকল্পনা করছে। শুধু ডিপ্লোমা স্তরেই নয়, শিক্ষার্থী কমছে কারিগরির মাধ্যমিক স্তরেও। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরে দুই লাখ ৭৬৩ জন শিক্ষার্থী থাকলেও সর্বশেষ ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে এ সংখ্যা কমে দাড়িয়েছে এক লাখ ৭৭ হাজার ৫৬৪ জনে। তবে দেশের কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমিক ও উচ্চস্তরে শিক্ষার্থী কমলেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে দুই লাখ সাত হাজার ৩৮৪ জন শিক্ষার্থী থাকলেও সর্বশেষ শিক্ষাবর্ষে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১৭ হাজার ৯০৫ জনে।

কারিগরিতে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার নেপথ্যে বিভিন্ন কারণও অনুসন্ধান করেছেন শিক্ষাবিদরা। বিশষ করে দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সরকার অনুমোদিত নীতিমালা অনুসারে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক শৃঙ্খলা আনতে পারছে না। এ ছাড়াও ভৌত সুযোগ-সুবিধা, যন্ত্রপাতির পর্যাপ্ততা ও কোর্স বাস্তবায়নের পরিবেশ নিশ্চিত কল্পে পরিদর্শন, মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণসহ প্রতিবেদন প্রণয়ন এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিশেষায়িত এ শিক্ষা খাতের গুণগত মান উন্নয়নের জন্য মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনায় দুর্বলতার কথাও জানিয়েছেন তারা।

উল্লেখ্য, বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দেশে চার বছর মেয়াদি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ বা শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাগ্রিকালচার, ফিশারিজ, ফরেস্ট্রি, লাইভস্টক, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ও ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (নেভাল) ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (আর্মি) এবং ডিপ্লোমা ইন মেডিক্যাল টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালিত হচ্ছে এবং যা তদারক করছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। এ ছাড়াও ‘জাতীয় দক্ষতামান’ (বেসিক ৩৬০ ঘণ্টা) নিয়েও তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদি শিক্ষাক্রম পরিচালনা করছে বিশেষায়িত শিক্ষা বোর্ডটি।

কারিগরিতে শিক্ষার্থী কমে যাওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, সারা পৃথিবীতেই যেখানে কারিগরিতে শিক্ষার্থী বাড়ছে সেখানে আমাদের দেশে এর বিপরীত চিত্র অবশ্যই আমাদের উদ্বেগের বিষয় এটি। তবে কেন এমনটি হচ্ছে এ বিষয়ে নিশ্চয়ই সরকার অনুসন্ধান করবে। তবে আমার মনে হয় কোভিড-১৯ মহামারী, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষ শিক্ষার্থী তৈরি করতে না পারা এবং সনদনির্ভরতার কারণে শিক্ষার্থী কমতে পারে। তিনি আরো বলেন, আমাদের কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষ ও যুগোপযোগী করতে হলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সতর্কতার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা যেন চাকরির বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। একই সাথে এ খাতে বাজেট বৃদ্ধির ফলে তা যেন নামমাত্র প্রতিষ্ঠান বা কাজের পেছনে খরচ না হয় সে দিকেও সতর্ক থাকার পরামর্শ তার।

দেশের কারিগরি শিক্ষা খাতে শিক্ষার্থী কমার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো: আলী আকবর খান বলেন, কারিগরিতে বাজেট বাড়ার বিষয়টি জাতীয় বাজেটে মোট বরাদ্দের অংশ। আর শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ২০২০ সাল থেকে কারিগরি শিক্ষায় উপবৃত্তি বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া আগে অনেকগুলো স্কুলে টেকনিক্যাল কোর্স চালু ছিল সেগুলো এখন বন্ধ রয়েছে। সেই কারণেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা এই এক সেক্টরেই ৫৫ হাজার থেকে ৪২ হাজারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ টেকনিক্যাল কোর্সের শিক্ষার্থীর সংখ্যাই ১৩ হাজার কমে গেছে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতার কারণে তাদের কোর্স বাতিল করা হয়েছে। যেহেতু কোর্স বাতিল করা হয়েছে, তাই শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে গেছে। এ ছাড়াও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তি না বাড়ার কারণেও শিক্ষার্থী কমছে বলে জানান তিনি।

তবে কারিগরি বোর্ড চেয়ারম্যান বেশ কিছু ইতিবাচক দিক নিয়েও আশার কথা জানান। তিনি বলেন, সরকারের ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা কাজ করছি। আমাদের চলমান প্রকল্পগুলো সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের কারিগরি শিক্ষা খাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে বলে আমরা আশা করছি।

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৩/০৯/২০২৩     

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.