নিয়োগ ও সনদ জালিয়াতি করে ২১ বছর ধরে শিক্ষকতা

নিজস্ব প্রতিবেদক, নীলফামারীঃ জেলার ডিমলায় নিয়োগ জালিয়াতি ও সনদ জাল করে ২১ বছর ধরে চাকরি করে যাচ্ছেন এক শিক্ষক। এই কয় বছরে তিনি বেতন উত্তোলন করেছেন প্রায় ৩০ লাখ টাকা। উপজেলার ডালিয়া দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (কম্পিউটার) বিশ্ব নাথ রায়ের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০২ সালে জালিয়াতি করে নিয়োগ পাওয়া ঐ শিক্ষক বেতনের সরকারি অংশ (এমপিও) পান ২০০৫ সাল থেকে। সে হিসেবে এখন পর্যন্ত ঐ শিক্ষক সরকার থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা বেতন উত্তোলন করেছেন।

শিক্ষাবার্তা’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৭ আগস্ট ২০০২ সালে ডালিয়া দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ফয়জুল হক স্থানীয় দাবানল পত্রিকায় দুই জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়। এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো ১৯৯৫ অনুযায়ী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে একাডেমিক কোন পর্যায়ে ৩য় বিভাগ গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সাতজন প্রার্থী আবেদন করলেও পরীক্ষায় উপস্থিত হয় পাঁচ জন প্রার্থী। শিক্ষক বিশ্বনাথ এর স্নাতক (পাস) শ্রেণিতে ৩য় বিভাগ থাকায় আবেদনের যোগ্যতা না থাকলেও তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ফয়জুল হক আর্থিক সুবিধা নিয়ে তাকে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করায়।

এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো ১৯৯৫

জানা গেছে, ঐ নিয়োগ পরীক্ষায় কম্পিউটার শিক্ষক পদে তিন জন উপস্থিত থাকলেও দুই জন কৃতকার্য হয়। সবগুলোতে ২য় বিভাগ থাকা সন্তোষ চন্দ্র রায়কে নিয়োগ না দিয়ে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ফয়জুল হক অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নিয়ে নিয়োগ পরীক্ষায় অযোগ্য ব্যক্তি বিশ্বনাথ রায়কে নিয়োগ প্রদান করে।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী নিয়োগ বৈধ না হওয়ায় ঐ সময়ে সরকারের বেতন পাননি এই শিক্ষক। বেশ কিছু অফিসে ঘোরাঘুরি শেষে আর্থিক সুবিধা দিয়ে ২০০৫ সালে তিনি এমপিওভুক্ত করে নেন।

১৯৯৫ সালের এমপিও নীতিমালায় কম্পিউটার শিক্ষক পদে নিয়োগ বিধিমালায় জাতীয় বহুভাষী সাঁটলিপি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমী (নট্রামস) অথবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে কম্পিউটার সনদ থাকা বাধ্যতামুলক থাকলেও শিক্ষক বিশ্বনাথ রায়ের নিয়োগের সময় কোন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সনদ ছিল না। পরবর্তীতে তিনি জাতীয় বহুভাষী সাঁটলিপি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমী (নট্রামস) থেকে ভুয়া কম্পিউটার সনদ দাখিল করেন। যার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন জাতীয় বহুভাষী সাঁটলিপি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমী (নট্রামস) কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয় ডালিয়া দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ফয়জুল হক শিক্ষাবার্তাকে বলেন, নিয়োগ বিধি অনুযায়ী হয়েছে। কোন অনিয়ম হয়নি। এমপিও নীতিমালা ১৯৯৫ সালের এমপিও ও জনবল কাঠামো নীতিমালা অনুযায়ী ও আপনার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী একাডেমিক পর্যায়ে সকল সনদে কমপক্ষে ২য় বিভাগ থাকতে হবে উল্লেখ থাকলেও কিভাবে ৩য় বিভাগ থাকা প্রার্থী আবেদন করলেন এবং নিয়োগ পেলেন এমন প্রশ্নে সাবেক এই প্রধান শিক্ষক বলেন, তার রেজুলেশনে উল্লেখ আছে যতদিন ৩য় বিভাগ গ্রহণ যোগ্য হবে না ততদিন বেতন পাবে না। সে হিসেবে তিনি ২০০৫ সাল থেকে এমপিও সুবিধা পাচ্ছে।

২০০৫ সালে এমপিও সুবিধা কোন বিধি অনুযায়ী পাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী তিনি পাচ্ছেন। এমপিও নীতিমালা ১৯৯৫, ২০০৯ এবং সর্বশেষ ২০২১ সালের নীতিমালা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০০৫ সালে কোন নীতিমালার আলোকে তিনি এমপিও পেলেন উল্লেখ করলে ফয়জুল হক বলেন ২০০৫ সালের নীতিমালা তার কাছে আছে। ২০০৫ সালে কি নীতিমালা আছে দেখাতে বললে তিনি বলেন এটা বর্তমান প্রধান শিক্ষকের কাছে দেয়া আছে। আমার কাছে ছিল সেটা কোথায় আছে আমি জানি না। এখন সব জানেন স্কুলটির বর্তমান প্রধান শিক্ষক। সব দায় তার। ২০০২ সালের নিয়োগ জালিয়াতি নিয়ে ২০২৩ সালের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের কিভাবে দায় আছে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি অবসরে যাওয়ার সময় সব তার কাছে বুঝিয়ে দিয়ে আসছে দায় তার।

২০০২ সালে নিয়োগ পরীক্ষায় উপস্থিতির যে তালিকা বিদ্যালয়ের প্যাডে দেওয়া ছিল সেখানে ১১ ডিজিটের একটি গ্রামীণ ফোনের মোবাইল নম্বর। গ্রামীন ফোনে ২০০৬ সালের এপ্রিলে ১১ ডিজিটের মোবাইল নম্বর বাজারে নিয়ে আসে তার আগে পর্যন্ত ১০ ডিজিট ছিল। ২০০২ সালে স্কুলে প্যাডে প্রধান শিক্ষকের সিল স্বাক্ষরযুক্ত প্যাডে কিভাবে ১১ ডিজিটের ফোন নম্বর আসে জিজ্ঞেস করলে এই প্রধান শিক্ষক বলেন, ঐ সময়ই ১১ ডিজিটের মোবাইল নম্বর ছিল।

২০০২ সালে প্রধান শিক্ষকের ছিল স্বাক্ষরিত স্কুলে প্যাডে ১১ ডিজিটের মোবাইল নম্বর। অথচ ১১ ডিজিটের মোবাইল নম্বর গ্রামীণ ফোন আনে ২০০৬ সালের এপ্রিলে।

কম্পিউটার সনদ জালিতারি বিষয়ে তিনি বলেন, কম্পিউটার সনদ ঠিক আছে। কোন সমস্যা নেই।

ডালিয়া দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সহিদা ইয়াসমিন শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, প্রধান শিক্ষক আমার উপরে যে দায় দিচ্ছেন তা কোনভাবেই কাম্য নয়। আমি ২০১২ সালে এই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করি। ২০০২ সালের নিয়োগ জালিয়াতির বিষয়ে আমি কিছু জানি না। যদি এমন কিছু হয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানে তদন্ত আসলে আমাদের তাদেরকে এই বিষয়ে সহযোগিতা করব।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডালিয়া দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির (এডহক) সভাপতি মঈনুল হক শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমি সবে মাত্র ম্যানেজিং কমিটিতে এসেছি। এ বিষয়ে কিছুই জানি না। খোঁজ খবর নিব।

এ বিষয়ে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন  শিক্ষাবার্তা’কে জানান,  তিনি ২০০৫ সাল থেকে এমপিও সুবিধা পাচ্ছেন। আমি এই বিষয়ে তার কাছে কাগজ পত্র চেয়েছি। নিয়োগ অনিয়ম হলে এবং সনদ জাল হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করব।

নীলফামারী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব ) ফেরদৌসি আশরাফি শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমি সবে দায়িত্ব পেয়েছি। সেজন‍্য কিছুই জানি না। আমি এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নিব।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা, রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের বিদ্যালয় পরিদর্শক মোসা: সাঈদা বেগম শিক্ষা বার্তা’কে বলেন, আমার কাছে অভিযোগের ফাইল আছে। কিন্তু যিনি অভিযোগকারী তিনি অফিসে না আসলে কার্যক্রম গ্রহন করা একটু সমস‍্যা হচ্ছে। তারপরও আমি এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা দপ্তরের রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ পরিচালক শফিকুল ইসলাম শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, এ বিষয়ে একটি অভিযোগ পেয়ছি।  দ্রুত তদন্ত শুরু করা হবে। সবে মাত্র দায়িত্ব পেয়েছি। অচিরেই এর একটি সুরাহা হবে।

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২০/০২/২৩   


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.