এসএসসি ও এইচএসসিতে মেধা তালিকা ফিরিয়ে আনার দাবি বাড়ছে

এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় পূর্বের ন্যায় মেধা তালিকা বা স্ট্যান্ড পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার পক্ষে অনেক শিক্ষক ও অভিভাবক। জিপিএ পদ্ধতি চালুর আগে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকা ছিল। প্রতি বোর্ডের মেধা তালিকায় সেরা ২০ জন শিক্ষার্থী বাছাই করা হতো। বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করাকে ফার্স্ট স্ট্যান্ড বলা হতো। এভাবে মেধা তালিকার সবাই স্ট্যান্ডধারী শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচিত পেত। বিভিন্ন বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করা বা ২০ জনের তালিকায় থাকতে পারা অতি গৌরবের বিষয় ছিল। এটি একটি ভালো পদ্ধতি ছিল এবং এটি উঠিয়ে দেয়ায় এখনো অনেকে শিক্ষক ও অভিভাবক আফসোস করেন। এ পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার পক্ষে তারা।
বর্তমানে অষ্টম শ্রেণী থেকে এইচএসসি পর্যন্ত পাবলিক পরীক্ষায় গ্রেডিং পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রস্তাব বিষয়ে অনেক শিক্ষক অভিভাবক এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকা ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

তাদের মতে বোর্ডের এ মেধা তালিকা ঘিরে দেশজুড়ে সারা বছর পড়ালেখা নিয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলত। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন থাকত বোর্ডে স্ট্যান্ড করা। দেশ সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করা। তখন দেশ সেরা বা বোর্ডে প্রথম স্থান পাওয়া সত্যিই অনেক বড় গৌরবের বিষয় ছিল। তাদেরকে জাতীয়ভাবে সম্মানিত করা হতো। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হতো। পড়ালেখা আর মেধার ক্ষেত্রে তারা অনুসরণীয় হিসেবে বিবেচিত হতো। পরবর্তী শিক্ষা জীবনেও অনেক সুযোগ-সুবিধা দেয়া হতো বাছাই করা এ মেধাবী শিক্ষার্থীদের। পরবর্তীতে এদের মধ্যে অনেকেই কর্মজীবনেও দেশের নামী ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গে পরিণত হতেন। এভাবে পাবলিক পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করতে পারাটা সারা জীবনের জন্যই একটি গৌরব আর পরম আনন্দের বিষয় অনেকের কাছে। তাদের বাবা-মায়ের জন্যও ছিল এটি গৌরবের। মা-বাবার সাথে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়াদের সহাস্য ছবি ফল প্রকাশের পরদিন পত্রিকায় ছাপা হতো। গোটা দেশবাসী তাদের নিয়ে আলোচনা করত। সে কারণে এ গৌরব আর সাফল্য অর্জনের জন্য অনেক শিক্ষার্থী নিবিড়ভাবে পড়ালেখায় মগ্ন হতো।

বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও চেষ্টা করত তাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ যেন মেধা তালিকায় স্থান পায়। কেননা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্যও এটি ছিল গৌরবজনক। কিন্তু ২০০৩ সাল থেকে সনাতন এ পদ্ধতির পরিবর্তে জিপিএ পদ্ধতিতে ফল প্রকাশ শুরু হয় এবং তুলে দেয়া হয় মেধা তালিকা। তবে গ্রেডিং পদ্ধতিতে মেধা তালিকা রাখা কোনো সমস্যা নয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিউটের শিক্ষক শাহ্ শামীম আহমেদ বলেন, মেধা তালিকা রাখা যেতে পারে। এর সাথে গ্রেডিং পদ্ধতির কোনো সমস্যা নেই। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণী, দ্বিতীয় শ্রেণী রয়েছে। প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্তদের মধ্যে কে প্রথম আর দ্বিতীয় হয় তা নির্ধারণ করা হয়। তাহলে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকা রাখতে অসুবিধা কোথায়।

পাবলিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া নিয়ে শেষের দিকে রাজধানীর কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে। রাজধানীর নামকরা অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে নানা ধরনের নোংরা প্রতিযোগিতার অভিযোগও ওঠে। যেসব স্কুল-কলেজ থেকে নিয়মিত বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান পেত শিক্ষার্থীরা সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশের সেরা বা নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত পেত। এ ধরনের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের সুনামকে ব্যবহার করে ভর্তি বাণিজ্য, শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা ধরনের অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়ে। জিপিএ পদ্ধতি চালু এবং মেধা তালিকা তুলে দেয়ার পেছনে এগুলোও তখন বিবেচনায় নেয়া হয়।

তবে মেধা তালিকা তুলে দেয়া হলেও নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি বাণিজ্যসহ নানা ধরনের অনিয়ম এখনো বন্ধ হয়নি। বরং জিপিএ৫ নিয়ে এখন আগের চেয়েও তীব্র আর নোংরা প্রতিযোগিতা চলছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে। আর শিক্ষকদের অনেকেই জড়িয়ে পড়েছেন সরাসরি প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার সাথে। বিভিন্ন স্কুলের বিরুদ্ধে পরীক্ষার আধাঘণ্টা, এক ঘণ্টা আগে প্রশ্ন ফাঁস করে দেয়া ও পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর শিখিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে। শিক্ষকরা অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়ছে পরীক্ষার হলেও।

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মুগদা দিবা শাখার সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক ও বর্তমানে কেরানীগঞ্জে অবস্থিত নুরুল আলম স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল দেওয়ান বাকিউল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি মেধা তালিকা ফিরিয়ে আনার পক্ষে। এটি খুবই ভালো একটি ব্যবস্থা ছিল। এটি শিক্ষার মান বৃদ্ধিতেও সহায়ক ছিল। কারণ শিক্ষার্থী অভিভাবকরা যেমন এ মেধা তালিকায় স্থান পাওয়ার জন্য চেষ্টা করত, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও সচেষ্ট ছিল। মেধা তালিকার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বাড়ত। নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার ধরন অনুসরণ করত অন্য অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, মেধা তালিকা ঘিরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেসব অনিয়ম আর প্রতিযোগিতার অভিযোগ শোনা গেছে সেটি দূর করা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। সেটি দূর করা সম্ভব।


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.