ভিকারুননিসার ‘অধ্যক্ষ দখল’ লড়াই!
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ ‘দখল’ নিয়ে চলছে লড়াই। আর এই লড়াইয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের (গভর্নিং বডি) সদস্যরাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এক পক্ষে রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠতম শিক্ষক হাসিনা বেগম আর অন্য পক্ষে আছেন দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ শিক্ষক কেকা রায় চৌধুরী। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে– এক পক্ষ অন্য পক্ষকে বাদ দিয়ে সভা করে দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠতম শিক্ষক কেকা রায় চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জ্যেষ্ঠতম শিক্ষক হাসিনা বেগম ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে অভিযোগ করেছেন।
পরিচালনা পর্ষদের প্রথম পক্ষের (হাসিনা বেগম) সদস্যরা দাবি করছেন, গত ১ এপ্রিল আদতে গভর্নিং বডির কোনো সভা হয়নি। কোনো সদস্য সভার নোটিশও পাননি। কাগজে-কলমে নোটিশ করা হয়েছে দেখানো হলেও, বাস্তবে পাঁচ সদস্যকে বাদ দিয়ে সভার নামে নাটক সাজিয়ে কেকা রায় চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ পক্ষটি গতকাল রোববার পর্যন্ত কেকা রায় চৌধুরীকে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নিতে দেয়নি।
পরিচালনা পর্ষদের দুই পক্ষের এই দ্বন্দ্বে বের হয়ে আসছে নানা দুর্নীতির চিত্র। বলা হচ্ছে, ৬৯ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা পকেটে পুরেছে পরিচালনা পর্ষদের একাংশ। এই নিয়োগে কোনো বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু করে লাখ লাখ টাকা আয় করা হচ্ছে, যার কোনো হিসাব সাবেক অধ্যক্ষ কামরুন নাহার ছাড়া আর কারও কাছে নেই। তিনি অবসরে যাওয়ার আগে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি পরিচালনা পর্ষদের এক সভায় ৮৯ লাখ টাকার বিভিন্ন কেনাকাটার বিল পাস করে নিয়েছেন। পরিচালনা পর্ষদের কেউ কেউ দাবি করছেন, ওই সভাটিও আদতে হয়নি। কাগজে-কলমে সভা দেখানো হয়েছে। কারণ পর্ষদের অর্ধেক সদস্যই জানতেন না এ সভার কথা।
অধ্যক্ষ পদ নিয়ে কাড়াকাড়ি ভিকারুননিসায় নতুন কিছু নয়। প্রায় ২৮ হাজার ছাত্রীর এই নামি বিদ্যাপীঠে এর আগেও অধ্যক্ষ পদ নিয়ে ঠেলাঠেলি চলেছে। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার মান বাড়াতে ও প্রশাসনিক দক্ষতা নিশ্চিত করতে পাঁচ বছর আগে সরকার বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার থেকে প্রেষণে অধ্যক্ষ নিয়োগ শুরু করে। প্রথমে নিয়োগ দেওয়া হয় অধ্যাপক ফওজিয়াকে। তবে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ ওঠায় তাঁকে বিদায় করে ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর শিক্ষা ক্যাডারের দর্শন বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক কামরুন নাহার মুকুলকে প্রেষণে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে তিনি রাজধানীর দুয়ারীপাড়া সরকারি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। দুই বছরের বেশি সময়ে দায়িত্ব পালনকালে তিনিও দুর্নীতির অভিযোগ থেকে মুক্ত হতে পারেননি। গত ৪ এপ্রিল তিনি অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে যান। এর পরই মূলত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদ নিয়ে শুরু হয় ঠেলাঠেলি।
১ এপ্রিল পরিচালনা পর্ষদের ‘বির্তকিত’ সভায় জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে কেকা রায় চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই ঘটনায় ১৫ শিক্ষক লিখিতভাবে অভিযোগ করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। একই অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির অভিভাবকরাও। এসব অভিযোগে বলা হয়, দুই শিক্ষক প্রতিনিধিসহ কলেজ গভর্নিং বডির পাঁচ সদস্যকে বাদ দিয়ে গোপন বৈঠকের মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ করা হয়।
জানতে চাইলে কেকা রায় চৌধুরী বলেন, ‘পরিচালনা পর্ষদের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে। তাঁরা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন।’
তবে গভর্নিং বডির সদস্য (অভিভাবক প্রতিনিধি) ড. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বৈঠক করা হয়েছে আমাদের পাঁচজন সদস্যকে বাদ দিয়ে। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’ অভিভাবকরাও অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া কনটেম্পট পিটিশনও রয়েছে। তবে অবৈধ এ সিদ্ধান্ত টিকবে না। কারণ, এ সিদ্ধান্তে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন লাগবে। আর জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করায় অনুমোদন পাওয়ার সুযোগ নেই। বঞ্চিত জ্যেষ্ঠতম শিক্ষক হাসিনা বেগমও বোর্ডে এ কথা জানিয়ে আবেদন দিয়ে রেখেছেন।’
গভর্নিং বডির আরেক অভিভাবক সদস্য ওয়াহেদুজ্জামান মন্টু বলেন, ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ করার সুযোগ নেই। সাবেক অধ্যক্ষ এবং একজন শিক্ষক এই অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত। অ্যাডহক কমিটির মাধ্যমে ৬৯ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করা হয়েছে। এখন একজনকে জোর করে চেয়ারে বসানোর চেষ্টা চলছে, আমরা প্রতিবাদ করে যাচ্ছি।’
জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘বিধি অনুযায়ী, যিনি জ্যেষ্ঠ শিক্ষক, তিনিই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পাবেন। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে শিক্ষকদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে কোনো জটিলতা থাকলে মাউশি বা শিক্ষা বোর্ড তা নির্ধারণ করে দিতে পারে।’
গভর্নিং বডির সদস্য (শিক্ষক প্রতিনিধি) চাঁদ সুলতানা বলেন, ‘আমরা চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তাঁকে অনুরোধ করছি নিয়ম অনুযায়ী যেন অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হয়।’ গভর্নিং বডির আরেক সদস্য (শিক্ষক প্রতিনিধি) আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা বৈঠকের চিঠি পাইনি। ওই মিটিংয়ের এজেন্ডাও জানানো হয়নি। মিটিং হয়েছে কিনা, আমি জানি না। যদি হয়ে থাকে, আমাদের অ্যাভয়েড করে করা হয়েছে।’ তবে সদস্য ড. তাজুল ইসলাম দাবি করেন, কোনো মিটিং হয়নি, কাগজপত্রে সাজানো মিটিং দেখানো হয়েছে।
এসব বিষয়ে বারবার চেষ্টা করেও প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিলুর রহমানের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
পরিচালনা পর্ষদের দ্বন্দ্বে বেরোচ্ছে দুর্নীতির গন্ধ: নিয়ম অনুসারে, কোনো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অ্যাডহক (অস্থায়ী) পরিচালনা কমিটি রুটিন কাজের বাইরে কিছু করতে পারে না। নিয়োগ তো নয়ই। অথচ ভিকারুননিসায় ২০২২ সালে অস্থায়ী কমিটির মেয়াদে নিয়োগ দেওয়া হয় শাখাপ্রধান এবং ৫০ শিক্ষক-কর্মচারী। যখন কমিটির কোনো বৈধতাই ছিল না, সেই অতিরিক্ত সময়ে নিয়োগ দেওয়া হয় আরও ১৯ শিক্ষক-কর্মচারী। ৬৯ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয় অ্যাডহক কমিটি। এ নিয়োগে কয়েক কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ এখন প্রতিষ্ঠানটির সবার মুখে মুখে।
২০২১ সালে প্রথম অ্যাডহক কমিটি নিয়োগ দেওয়া হয় ৫ ডিসেম্বর। ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার খলিলুর রহমানকে সভাপতি, অধ্যক্ষ কামরুন নাহারকে সদস্য সচিব, নন-এমপিও শিক্ষক ড. ফারহানা খানম এবং অভিভাবক প্রতিনিধি আবু সালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খানকে সদস্য করে চার সদস্যের অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়। ছয় মাস মেয়াদের এই কমিটি অনুমোদন করে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। ওই মেয়াদে গভর্নিং বডির নির্বাচন করতে ব্যর্থ হলে আবারও একই কমিটি অনুমোদন চাওয়া হয় প্রতিষ্ঠান থেকে। দ্বিতীয় মেয়াদেও অ্যাডহক কমিটি নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়। অ্যাডহক কমিটির মেয়াদের মধ্যে ২০২২ সালে নিয়োগ দেওয়া হয় শাখাপ্রধান এবং ৫০ শিক্ষক-কর্মচারী। অ্যাডহক কমিটির মাধ্যমে ৬৯ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের ঘটনায় সম্প্রতি নিম্ন আদালতে মামলা করেছেন অভিভাবক তিন্না খুরশিদ জাহানসহ তিনজন।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সদ্য সাবেক অধ্যক্ষ কামরুন নাহারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তের জন্য শিক্ষা সচিবকে নির্দেশ দিয়েছে। ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, মাউশি অধিদপ্তরের কোনো অনুমোদন ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরে ‘ভিএনএসসি শিল্পাঙ্গন’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন কামরুন নাহার। সেখানে পাঁচ প্রশিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। হাজার হাজার শিক্ষার্থী এই শিল্পাঙ্গনে ভর্তি হলেও এর আয়-ব্যয়ের যথাযথ হিসাব দেওয়া হয়নি। একইভাবে একটি কারাতে ক্লাবও করা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের অনেক অর্থই বিনা রসিদে নেওয়া হয়েছে। অধ্যক্ষের পিএ নুরুন নবীর মাধ্যমে এই টাকা ভাগাভাগি হয়। নিজের লোক দিয়ে প্রশ্নপত্র ছাপিয়েও বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সাবেক অধ্যক্ষ। প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ব্যবহার করে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার নিয়োগ ও ভর্তি পরীক্ষার জন্য আদায় করা সম্মাানিরও একটি বড় অংশ নিয়েছেন তিনি। শিক্ষকদের জন্য ৭০টির মতো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) কেনা হয়েছে। আর প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার বিদ্যুৎ বিল দেওয়া হয়েছে। কোনো দরপত্র ছাড়াই শিক্ষক প্রতিনিধি ফারহানা খানমের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানের ক্যান্টিন ভাড়া দিয়েছেন। এমনকি এ কাজে গভর্নিং বডির অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা দু’জনেই নিজের লোক দিয়ে এই ক্যান্টিন চালাচ্ছেন। প্রতি মাসে অধ্যক্ষ বিপুল পরিমাণ আপ্যায়ন বিল তুললেও কাউকে তেমন কোনো আপ্যায়ন করা হয় না। এই অধ্যক্ষের সময়ে স্কুল মাঠে গরুর হাটও বসানো হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে সদ্য সাবেক অধ্যক্ষ কামরুন নাহার বলেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। বরং কাউকে কাউকে অন্যায় করতে দেইনি। গত দুই বছর যারা আমার কাছ থেকে কোনো অনৈতিক সুবিধা পায়নি, তারাই নানা অভিযোগ করছে।’
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১০/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়