দুই শ্রেণির বইয়েই প্রায় ৭০০ ভুল!
আবু তাহের খানঃ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির কিছু বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ের বেশকিছু ভুলের বিষয়ে সংশোধনী এনেছে এনসিটিবি।
সম্প্রতি এনসিটিবির ওয়েবসাইটে এসব সংশোধনী প্রকাশ করা হয়েছে। তবে শিগগিরই তা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের ((মাউশি) মাধ্যমে সব বিদ্যালয়ে পাঠানো হবে, যাতে শিক্ষকরা সংশোধনীগুলো শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে দেয়ার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, এ সংশোধনীর সংখ্যা প্রায় পৌনে ৭০০। আর এসব সংশোধনীর মধ্যে বড় ধরনের তথ্যগত ভুলই সর্বাধিক। তবে বানান ভুলের মতো বিষয়াদিও রয়েছে।
এখন কথা হচ্ছে, মাত্র দুই শ্রেণির বইতেই যদি পৌনে ৭শ' ভুল থাকে, তাহলে অন্যান্য শ্রেণির বইতে যে তা একেবারেই নেই, এমনটি বলার কোনো সুযোগ নেই। বরং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই যাদের দায়িত্বে ও তত্ত্বাবধানে প্রণীত হয়েছে, অন্যান্য শ্রেণির বইয়ের দায়িত্ব ও তত্ত্বাবধানও যেহেতু তাদেরই, ফলে অন্যান্য শ্রেণির বইতেও অনুরূপ ভুল থেকে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তবে সে ভুলের পরিমাণ কিছুটা কম বলে বা অন্যকোনো কারণে তারা হয়তো সেটি এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে ভুল থাকার মতো ত্রুটি, তা সেটি যত সামান্যই হোক না কেন, কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় সৃষ্ট পরিস্থিতিতে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অন্যান্য শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকেও অনুরূপ ভুলত্রুটি আছে কিনা (যা থাকার আশঙ্কাই সর্বাধিক) তা যাচাই করে দেখার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করি।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠ্যপুস্তক (সব না হলেও অধিকাংশ) বিতরণ করা হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে। এরইমধ্যে প্রায় চার মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে এসে এনসিটিবির মনে হলো যে, ভুলগুলোর বিষয়ে সংশোধনী জারি করা উচিত, যা শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের হাতে যেয়ে হয়তো পৌঁছাবে মে'র শেষনাগাদ এবং কোনো কোনো শিক্ষার্থীর কাছে তা হয়তো কোনোদিনই পৌঁছাবে না। আর যেসব শ্রেণির বইয়ের ভুল এখনও চিহ্নিত হয়নি, তারাতো ওই ভুলটি শিখেই শিক্ষাবর্ষ পার করে দেবে। আসলে আমাদের শিক্ষাকর্তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার মাত্রা ও নজিরগুলো বস্তুতই গিনিজ বুকে রেকর্ড করে রাখার মতো। বাংলাদেশস্থ জাপানি রাষ্ট্রদূত যেমন দিনের ভোট রাতে হয় শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন, এও তেমনি বিস্মিত হওয়ার মতো আরেকটি নজির বৈকি!
সৃষ্ট পরিস্থিতিতে, ভুলে ভরা উল্লিখিত বইগুলোর প্রণয়ন ও মুদ্রণের দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত ছিল তাদের অযোগ্যতা ও অদক্ষতার বিষয়টি এখন আর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। বরং এ ধরনের অদক্ষতা ও অযোগ্যতার শাস্তি কী হতে পারে, সেটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া উচিত বলে মনে করি এবং নিকট ভবিষ্যতে তাদের আর অনুরূপ দায়িত্বে রাখা উচিত হবে কিনা তা নিয়েও ভাবা উচিত। তবে উচিত যা কিছুই হোক না কেন, বাস্তবে এ অযোগ্যরাই-যে আগামীদিনে একই দায়িত্বে অত্যন্ত দাপটের সাথে টিকে থাকবেন এবং তাদের অযোগ্যতার খেসারত-যে সাধারণ জনগণকেই বইতে হবে, সেটা মোটামুটি প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। অবশ্য এ আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হোক-সেটাই কাম্য। তবে সত্যি সত্যি তা ভুল প্রমাণিত হলো কিনা তা বুঝা যাবে আগামী ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের হাতে সম্পূর্ণ নির্ভুল পুস্তক পৌঁছে দেয়া গেল কিনা তা দেখার পর।
উপরোল্লিখিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের শিক্ষাখাত কি তাহলে আগামী দিনগুলোতে এভাবে চরম অযোগ্যদের দ্বারাই পরিচালিত হবে, যেমনটি গত ৫২ বছরের অধিকাংশ সময় জুড়ে পরিচালিত হয়ে আসছে? প্রশ্নের জবাব 'না' হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত খুবই ক্ষীণ। কিন্তু কথা হচ্ছে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র দীর্ঘ ৫২ বছরেও তার শিক্ষাব্যবস্থার একটি স্থায়ী কাঠামো দাঁড় করাতে পারলো না এবং দিনে দিনে তা কেবল অধঃপতনের দিকেই যাচ্ছে- এটি কেমন কথা? ভাবুনতো, একটি রাষ্ট্র কতটা অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হলে এমনটি হতে পারে? এরূপ পরিস্থিতিতে বিত্তবান ও ক্ষমতাশালীরা নিজেদের সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে ইতোমধ্যে এ সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ খুঁজে নিয়েছেন। কিন্তু বিত্তহীন ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষের সন্তানেরা কোথায় যাবে? তাহলে যে সংবিধানে বলা হলো, ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য...রাষ্ট্র কার্যকর ববস্থা গ্রহণ করিবেন’, [সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮(১)] সেটি কি তবে কেবলই কথার কথা?
পাঠ্যপুস্তকে ভুল থাকা, সময়মতো তা শিক্ষার্থীদের হাতে না পৌঁছা, কার্যাদেশে উল্লিখিত মানের চেয়ে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপা হওয়া, বছর বছর পরীক্ষাপদ্ধতি বদল হওয়া, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যখন-তখন বইতে তথ্য ও ঘটনার সংযোজন ও বিয়োজন ঘটানো, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের আশ্রয় গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়গুলো এখন খুবই মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় আগামী বছর যদি এরূপ ভুলের পরিমাণ দু' শ্রেণির পরিবর্তে এক শ্রেণিতেই পৌনে ৭শ' দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে তাতে মোটেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। কিন্তু কষ্ট থাকবে একটাই, এ ভুলের দায় কেউ গ্রহণ করবে না বা কেউ দায়ী বলে তাকে চিহ্নিতও করা হবে না।
বস্তুত এ হচ্ছে এমন এক জবাবদিহিতাবিহীন রাষ্ট্র, যেখানে অযোগ্য, অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা চক্রই অধিকাংশ ক্ষমতার নিয়ন্তা। আর সেটি যখন হয় শিক্ষাখাতের মতো জীবনের কোনো মৌলিক অনুষঙ্গকে ঘিরে, তখন সে নিয়ন্ত্রণ পুরো জাতিগত বিকাশকেই বন্ধাত্বের মুখে ফেলে দেয় বৈকি! বস্তুত সে বন্ধাত্বই বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে বিরাজ করছে, যার সমাধান চলমান আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কিছুতেই এবং কখনোই পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ক্ষমতায় থাকার বা যাওয়ার জন্য মোহাবিষ্ট রাজনীতিকরা কি একবারের জন্য হলেও ভাববেন যে, একটি আধুনিক অগ্রসর জাতির মান ও মর্যাদার স্তর পরিমাপের মূল মানদণ্ড হচ্ছে তার শিক্ষা ও সংস্কৃতি। মাথাপিছু গড় আয় কখনো সে মানগত অবস্থান নির্দেশ করে না- মর্যাদার বিষয়টিকেতো করেই না।
লেখকঃ পরিচালক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৭/০৫/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তা’য়