করোনাকালে গ্রামীন শিক্ষাব্যবস্থার ভয়াবহ অবনতি
সান্ত আলী, ঢাকা।।
করোনাকালে গ্রামীন শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াবহ অবনতি হয়েছে যা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষকদের অনলাইনে পাঠদানের কার্যক্রম ও অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের প্রদত্ত তথ্য থেকে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। করোনাকালে গ্রামীন শিক্ষা ব্যবস্থার খোঁজ নিয়ে প্রতিবেদন করতে গেলে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্থ খাতের মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে শিক্ষাখাত। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার যে ক্ষতি হয়েছে বা এখনো হচ্ছে তা পরবর্তী কয়েকবছরেও পুষিয়ে উঠা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশে গত মার্চ মাস থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং অনলাইন, রেডিও, টেলিভিশন ও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো শুরু হয়। যা অবশ্যই যুগোপযোগী সুন্দর একটি সিদ্ধান্ত। তবে এসব শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ফলাফল কতটুকু সন্তোষজনক তা নিয়ে এখনো কোন পরিষ্কার তথ্য নেই। যদিও সরকার বলছে সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থী সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র উল্টো। মুষ্টিমেয় শহরের কিছু শিক্ষার্থী ভাল ডিভাইস ও ইন্টারনেট এর সহজলভ্যতা থাকার কারনে এসব ডিজিটাল পাঠদানের সুযোগ পাচ্ছেন। অপরদিকে গ্রামের শিক্ষার্থীদের অবস্থা খুবই নাজুক।
সরেজমিনে দেখা হচ্ছে, গ্রামের স্কুল পড়ুয়া শতকরা ৯০ ভাগের কাছেই নেই কোন উন্নত মোবাইল ডিভাইস, ইন্টারনেট তো স্বপ্নের মতো তাদের কাছে। কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কাছে ভাল মোবাইল থাকলেও অনলাইন ক্লাসের প্রতি তাদের যথেষ্ট অনিহা দেখা গেছে। অনেকেই ইন্টারনেটের অভাবে এসব ক্লাস বা কনটেন্ট পাচ্ছে না। অনেকেই ইন্টারনেটের সঠিক বা গঠনমূলক ব্যবহার জানেন না। বেশিরভাগ গ্রামে ব্রন্ডব্যান্ড বা ওয়াইফাই কানেকশন তো নেই, আর যদিও শতকরা ৫ ভাগ গ্রামে আছে সেখানে আবার খরচ খুবই ব্যয়বহুল। যা গ্রামের এসব অসহায় গরীব শিক্ষার্থীদের পক্ষে খরচ যোগানো সম্ভব না।
রেডিও ও টেলিভিশনের ক্লাশের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই এসব গ্রামীন শিক্ষার্থীদের। কারন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সকাল হলেই পরিবারের বাবা ও বড়দের সাথে কৃষিকাজ বা অন্য কোন কাজে সময় দেওয়া শুরু করে দিচ্ছে। “স্কুল বন্ধ তাই মাঠে একটু বাবার সাথে সময় দেই” - এক শিক্ষার্থীর বক্তব্য।
সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা হচ্ছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ৯ম-১০ম শ্রেণী থেকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা খন্ডকালীন শ্রমিকে পরিনত হয়ে পড়েছে। যা সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার। এসব খন্ডকালীন শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত অনেক শিক্ষার্থী আবার স্থায়ী শ্রমিকে পরিণত হওয়া শুরু করেছে। এদের মধ্যে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও যুক্ত হয়েছেন।
তাদের কাছে জানতে চাইলে বলে, “স্কুল বন্ধ, বাড়ীতে বসে আর ভাল লাগছে না, তাছাড়া দিন গেলে ২০০ থেকে ৩০০টাকা পাচ্ছি। খারাপ কিসের! বাড়ীতে বাবা মা ও অনেক খুশি।”
“ভাবছি কাজ করে যা টাকা পাবো একটা স্মার্ট মোবাইল কিনবো। স্কুল যদি আরো বেশি বন্ধ থাকে তাহলে ফোনের মাধ্যমে ক্লাশ করবো। তাই কাজে আসছি।”- ১০ম শ্রেণীতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর কথা।
“সবকিছু খোলা। কলেজটা বন্ধ রাখার কি দরকার। আমরা তো সচেতনতা বুঝি। কলেজ বন্ধ থাকার কারনে একটা ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছি। যে ঘাটতি হলো পড়াশুনার আর মনে হয় কলেজ পাস করা হবে না।” - দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়–য়া এক শিক্ষার্থী অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করেই কথা গুলো বললো।
তবে, সবচেয়ে ভয় ও আশংকার হচ্ছে এসব কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে আদৌ কি স্কুলে ফেরানো যাবে? তাদের মধ্যে অর্থ আয়ের নেশাটা চাপিয়ে গেলে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকার কি পারবে তাদের আবার স্কুলগামী করতে? গ্রামীন বাস্তবতায় তা অনেকাংশে অসম্ভব। তাই নীতিনির্ধারকদের গ্রামীন শিক্ষা ব্যবস্থার কথা ভাবা উচিত।
শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় শহরের শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে এভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে গ্রামের নিম্নবিত্ত অসহায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের সুন্দর ভবিষৎ নষ্ট করে দেওয়া সমীচিন হবে না।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট সকল, পরিবার ও সমাজের দায়িত্বশীল মানুষদেরকে সচেতন করে পর্যায়ক্রমে উচ্চ শিক্ষা থেকে প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে গ্রামের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী চিরতরে শিক্ষা জীবন থেকে বিদায় নিবে। জাতি হারাবে সৃষ্টিশীল কাজের জন্য পরিস্ফুটিত হওয়া সূর্য সন্তানদের যারা হয়তো ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে সোনার বাংলা বি-নির্মানে ঝাঁপিয়ে পড়তো এবং দেশটাকে উন্নত বিশ্বে অনন্য এক পর্যায়ে নিয়ে যেতে সর্বাত্মক সহায়তা করতো।