রফিক নটবরের ‘খেরোখাতা’বাস্তবতার উপাখ্যান
।। মুক্তার হোসেন নাহিদ ।।
“আমি চিনিগো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী”-১৯২৪ সালে কবিগুরু লিখেছিলেন আর্জেন্টাইন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রেমে পড়ে। আর নার্গিসকে ভালোবেসে ১৫ বছর পর যন্ত্রণাকাতর হৃদয়ে নজরুল লিখেছিলেন “আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস কর, আমি তত মন্দ নই/ এই আমার শেষ কৈফিয়ত।”-দু’জনেই বিখ্যাত কবি প্রেমের কারণে। কেবল রবীন্দ্র-নজরুল নয়, জনপ্রিয় কবি পিটার, মেক্সিকোর চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কাহলো, রুশ কবি মায়াকোভস্কি সহ জগতের বিখ্যাতজনরা নারী ও প্রেমের কারণে খ্যাতি পেয়েছেন।
আমার বিশ্বাস কোনো এক অজানা নারী’র প্রেম এবং না পাওয়ার কষ্ট থেকে এলোমেলো ভাবনায় লেখা রফিক নটবরের ৬৪ পাতার ৬৪ টি কবিতা সম্বলিত গ্রন্থ ‘খেরোখাতা’ তাকেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যাবে। যদিও তিনি বইটিকে কবিতা গ্রন্থ বলতে নারাজ। “কবিতা নয়, খেরোখাতা’য় তার বাজে হিসাব”-দাবি রফিক নটবরের।
কিন্তু তিনি জানেন না, রুটির দোকানের ময়দা ডলতে ডলতে লেখা লাইনগুলো কখন যে অমর কবিতা হয়ে যাবে তা নজরুলও ভাবেন নি। ফলে অতীতের এলোমেলো স্মৃতিগুলো অবিন্যস্তভাবে লিখে রাখা রফিক নটবরের লাইনগুলো যে অসাধারণ কবিতা হয়েছে তা হয়তো তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না।
প্রেম মানুষকে অসাধারণ বানায়, বিখ্যাত বানায়। আবার বিখ্যাতরাও প্রেরণা পায় প্রেম থেকে। চীন বিপ্লবের মহানায়ক মাও সেতুংয়ের জীবনেও প্রেম ছিল। তিতা ইনফাতে, হিলদা গার্ডিয়া ও অ্যালাইদার প্রেমে ‘চে’, সেলিয়ার প্রেমে ফিদেল এবং লেনিনের জীবনে নাদিয়া এসেছিলেন সংগ্রামের প্রেরণা হয়ে। রফিক নটবর তার প্রেমিকার দেওয়া আঘাতের কারণে মনের গহীন থেকে যেসব বাক্যমালা তৈরি করেছেন তা হয়েছে সমাজ ও জীবনের বাস্তব চিত্র। ফলে ‘খেরোখাতা’ আমার কাছে কেবল কবিতা গ্রন্থ নয়, জীবনে উপলব্ধি।
সহকর্মী শরিফুল ইসলাম স্যার এক রাতের আড্ডায় বললেন, “আমাদের রফিক স্যার একটা কবিতার বই লিখেছেন, ভালোই লাগলো।” শরিফ স্যার বাংলা’র শিক্ষক, উনি যখন বলছেন-ভালো হতেও পারে। তবে রফিক স্যারকে আমি চিনি অভিনেতা হিসেবে। অভিনয় ভালোই করেন। করোনাকালীন জনসচেতনতামূলক তার কিছু টিপস ভিডিও অসাধারণ। তবে কবিতার বই! সেটা মনে হয় ভালো হবে না!
করোনার কারণে বইমেলায় যাওয়া হবে না বলে শরিফ স্যারের কাছেই বইটা চাইলাম। বইটা নিয়ে পড়ে দেখলাম এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ‘পাতা প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত রফিক নটবরের ‘খেরোখাতা’ কবিতা গ্রন্থটি সত্যিই অসাধারণ। প্রকাশক আলেয়া বেগম আলো প্রকাশিত বইটির কাভার পেজের খেরোখাতার ছবি ও অংকন তুর্যের হাতের পুরো প্রচ্ছদ আমার দারুণ লেগেছে।
বানানে এবং ফ্রন্ট সাইজে কিছুটা ত্রুটি থাকলেও কাগজ, প্রিন্ট ও বর্ণবিন্যাস বেশ সুন্দর। দামও হাতের নাগালে, মাত্র ১৫০ টাকা। সরাসরি প্রকাশনী থেকে নিলে হয়তো ডিস্কাউন্টও পাওয়া যাবে। আর অনলাইনে বইটি পেতে হলে যোগাযোগ করতে হবে রকমারি ডটকম এবং কানামাছি ডটকম-এ।
বেদনা ও আমার চোর পুলিশ
খেলার অভ্যাস সেই শৈশব থেকেই
৬৪টি কবিতার মধ্যে ‘বেদনার বৃত্ত’ নামক প্রথম কবিতার ১৪ ও ১৫তম লাইন দু’টিতে আমি অভিভূত। সত্যিই তো জীবন-সংসারে আমরা সবাই বেদনার সাথে চোর পুলিশ খেলছি। শত কষ্ট নিয়েও আমরা দামি পালঙ্কে কেবল দেহ রাখছি আর বেদনার কোলে ঘুমিয়ে যাচ্ছি। তাই তো কবির গভীর উপলব্ধি
রত্নখচিত পালঙ্ক কিনে এনে
তাতে রাখে দেহ, আর তার ঘুম
আসে গিয়ে বেদনার কোলে।
৯ম পৃষ্ঠার ‘গরমিল’ কবিতায় চতুর্থ লাইন থেকে
তুমি না হয় বেঁচেছো..
তোমার নতুন হয়েছে সবই,
আমি তো সেই স্মৃতির পাতা
রাঙাতে রোজ ভাবি।
কবি হয় তো তার প্রেমিকাকে নিয়ে ভাবনাগুলো লিখেছে কোনো এক ছেঁড়া পাতায়। কিন্তু একবার ভাবুন তো জীবনের বাস্তবতায় আমরা অতীতের গরমিল ভাবনাগুলো ভেবে স্মৃতির পাতারাঙাতে চাই। কিন্তু পারি কি! সিনেমায় নায়ক, খলনায়ক, প্রেম-ভালোবাসা, হাস্যরস, ক্রাইম, বেদনা ও যৌন উত্তেজনা যেমন থাকে, তেমনি পুরো সিনেমায় একটি শিক্ষামূলক ম্যাসেজও থাকে।
দর্শকের জ্ঞানের পরিধি এবং উপলব্ধি ক্ষমতার উপর নির্ভর করে সে কোনটা ধারণ করবে। নটবর স্যারের ‘খেরোখাতা’ একটি প্রেমের কবিতা হলেও এটি জীবনের বাস্তবতায় শিক্ষণীয় কবিতা গ্রন্থ। অনেকে ভালোবেসে উজাড় করে দেন। প্রেমিকা, পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয়, বন্ধু কিংবা দেশের জন্য। কিন্তু জীবনের বাস্তবতায় এক সময় যাদের জন্য ভালোবাসা উগড়ে দেয়, তারাই ভুলে যায় নতুন মোহে। ফলে না পাওয়ার বেদনায় ব্যর্থ মানুষের মতো মুখ লুকিয়ে কাঁদে নীরব যন্ত্রণায়। এই অসাধারণ ভাবনা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন গ্রন্থের নাম ভূমিকার ‘খেরোখাতা’ কবিতায়।
“লাল টিপ পড়লে তোমাকে কী সুন্দর লাগে!’-এমন কথা আমরা প্রথম জীবনে প্রেমিকা বা স্ত্রীকে বলি নাই এমন বেরসিক মানুষ খুব কমই আছি। কিন্তু সেই মানুষটি যখন আজীবন সঙ্গী হয়ে সংসার নামক ট্রেনে’র ঘানি টেনে ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে হয়ে যায়, চোখের নিচে কালি পড়ে, তখন কর্পোরেট ব্যবস্থার কাছে মস্তিস্ক বিক্রি করা এই আমরা রোবটের মতো চলতে গিয়ে একবারও তা খেয়াল করি না। আপন মানুষকে আর আপন লাগে না। অনন্তকাল ভালোবাসবো বলে যাকে প্রতিশ্রুতি দেই, সেই ভালোবাসা মরে গিয়ে আমাদের মনে পাহাড়সম অভিযোগ বাসা বাঁধে--এমন ভাবনা কবি তুলে ধরেছেন ১২ পৃষ্ঠায় তার ‘অভিযোগ’ কবিতায়।
গ্রন্থের ১৬ পৃষ্ঠায় ‘প্রয়োজন’ কবিতায় শেষ দুই লাইনে সমাজ জীবনের বাস্তবতার এক অসাধারণ বিশ্লেষণ-
আমরা তো নিরীহ দড়িকেও
সাপ ভেবে মুর্ছা যাই।
সত্যি তাই। ক্ষমতা, প্রভাব, অর্থ আর পেশিশক্তির ভয়ে আমরা প্রতিবাদের ভাষাও হারিয়ে ফেলেছি। ভয়ে গুটিয়ে থাকি। একবারও ভাবি না, যাদের বিষাক্ত সাপ ভাবি আসলে ঘুরে দাঁড়ালেই দেখব তারা সামান্য দড়ি। মানুষের মধ্যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ভাবনা আসছে না বলেই বিষহীন ধোঁরা সাপও ফণা তুলছে বার বার। ছোবলে ছোবলে দগ্ধ করছে এই দেশ, এই সমাজ। এর আগে ৫ম লাইন থেকে ১১তম লাইন পর্যন্ত নটবর স্যার লিখেছেন-
নতুবা প্রতিনিয়ত কাউকে হত্যার
হুমকি হয়ে বেঁচে থাকার অর্থ আমি জানি না।
কিন্তু বাস্তু সাপ যদি কাটে
আর মরে যাও
তবে জেনো
সে মৃত্যুর প্রয়োজন ছিল খুব।
বাস্তব বিশ্লেষণে সেটাই বলে। প্রতিবাদ না করে মিথ্যে সাপের হুমকিতে বেঁচে থাকার চেয়ে প্রতিবাদে গর্জে উঠে প্রকৃত সাপের হাতে মরা একান্ত প্রয়োজন। তবেই পাল্টাবে সমাজ, পাল্টাবে দেশ। অন্যদিকে শত কষ্টের মধ্যেও জগৎ সংসারে আমরা সুখ খুঁজে ফিরি। কিন্তু বাস্তবে সুখ নামক বস্তু ধরা দেয় না। সে সত্য তুলে ধরেছেন ২১ পৃষ্ঠার ‘বাস্তবতা’ কবিতায়। বাবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও হৃদয়ের গভীরে লুকানো বাবার স্মৃতির কথা দারুনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ২২ পৃষ্ঠায় ‘জন্মদাতা’ কবিতায়-
ভাবছো ভুলে গেছি
না, আজো ভুলি নাই।
তিনি লিখেছেন সাগরের পানি যেমন ফুরাবে না, পৃথিবী ধ্বংসের আগ পর্যন্ত সূর্য উঠা যেমন বন্ধ হবে না, তেমনি বাবাকেও ভুলে থাকা যাবে না।
এই সমাজে পতিতাবৃত্তিকে সবাই ঘৃণা করলেও একবারও ভাবে না কেন তারা এই ঘৃণিত কাজ করে! ওদের পারফিউমের ঘ্রাণের আড়ালে হাজারো কষ্ট লুকানো, রঙ্গিন পোশাক আর মেকাপের গভীরে লুকিয়ে আছে বুকফাটা আর্তনাদ! যারা দিনের আলোতে পতিতাদের ভৎসনা করে, তারাই আবার রাতের আঁধারে ওদের কাস্টমার হয়। এই নষ্ট সমাজে ভালো মানুষের খোলসের ভিতরের কুৎসিৎ চেহারার মুখোশ উম্মোচন হয় না-সুন্দর বিশ্লেষণ কবি তুলে ধরেছেন ২৪ পৃষ্ঠার ‘বেশ্যা’ কবিতায়। ৪১ পৃষ্ঠায় ‘নিয়ম’ কবিতায় বলেছেন, ‘সব কষ্ট প্রকাশ করতে নেই..।’
সবার মন ভালো করার চেষ্টা করি
কিন্তু সবাই যায় ভুলে..
আমারও আছে মন একটা
-এমন আক্ষেপ করেছেন ৪৩ পৃষ্ঠায় ‘কেউ জানে না’ কবিতায়। সব পুরুষের অন্তরের কথা তুলে ধরেছেন ৪৭ পৃষ্ঠার ‘ইচ্ছে’ কবিতায়। লিখেছেন-
গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে
.......................................
আমি তো পুরুষ,
আমার যে কাঁদতে নেই
পরেই আবার ৪৯ পৃষ্ঠায় ‘মাইসেল্ফ’ কবিতায় আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে লিখেছেন
ডিয়ার সেল্ফ
..............
পুরুষ হয়ে সিংহের মতো বাঁচো।
একজন কবি ও অভিনেতা হয়েও কবি-সাহিত্যিকদের আত্মসমালোচনা করে রফিক নটবর তার কবি ও বৃক্ষ কবিতায় লিখেছেন-
কবি কে দূর থেকে মনে হয় বৃহৎ ও মহান
কাছে গেলেই টের পাওয়া যায়
এটার মাধ্যমেই বোঝা যায় নটবর স্যার মানসিকভাবে কতটা উদার। এই গ্রন্থের প্রত্যেকটি কবিতা জীবন ও বাস্তবতার আলোকে লেখা। তার নিজের জীবনে এমন হয়েছে কিনা জানি না, তবে প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে তার প্রত্যেকটি কবিতা মিলে যাবে আমি আশা করি। আমি কোনো কবি-সাহিত্যিক নয়। আবার গ্রন্থ সমালোচনা করাও আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের দুঃসাহস দেখানো ছাড়া আর কিছুই না। তবে ‘খেরোখাতা’ গ্রন্থটি পড়ে যা পেলাম তা নিজের ভাবনায় একটু তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শব্দ চয়ন ও ভাবার্থ প্রকাশে অসঙ্গতি থাকলেও সামগ্রীক বিবেচনায় আমি বলবো নবীন লেখক হিসেবে অসাধারণ।
শেষ করতে চাই ‘খরোখাতা’র ভূমিকা নির্মাতা কবি ও সাহিত্য সমালোচক অধ্যাপক এম আব্দুল হালীম বাচ্চু’র ভাষায় “সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে যে খরা চলছে তার মাঝে দাঁড়িয়ে ‘খেরোখাতা’ নামীয় এই অনবদ্য বইটি কাব্যের জয়গানই উচ্চারণ করবে।” আমিও বলছি ‘খেরোখাতা’ রফিক নটবর স্যারের অতীত স্মৃতি কচলানো এলোমেলো ভাবনা হলেও এই সময়ে তা সমাজ ও বাস্তবতার উপাখ্যান।
লেখক: শিক্ষক, উইলস লিট্ল ফ্লাওয়ার স্কুল এন্ড কলেজ, ঢাকা।