বিগত দুই-তিন বছরে জ্বালানি গ্যাস নিয়ে নাটক কম হয়নি। ২০১৭ সালে প্রথম দুই ধাপে পর্যায়ক্রমে বাসাবাড়িতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছিল। সেই থেকে আজ অবধি গ্যাসের তাপে বার বার পুড়তে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। ২০১৭ সালে এক বার্নার চুলা ৬০০ এবং দুই বার্নার চুলা ৬৫০ টাকা থেকে ১ মার্চ-এ যথাক্রমে ৭৫০ ও ৮০০ টাকা করা হয় এবং ওই বছরেরই ১ জুন থেকে তা করা হয় এক বার্নার ৯০০ এবং দুই বার্নার ৯৫০ টাকা। আবার চলতি বছরের জুলাই থেকে এক বার্নার চুলা ৯২৫ ও দুই বার্নার চুলা বাবদ দিতে হচ্ছে ৯৭৫ টাকা।
স্বল্প সময়ের মধ্যে দফায় দফায় গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে কার্যত মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষদের নিত্য খরচে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। ১ জুলাই থেকে গ্যাসের এ নতুন দাম ধার্য করায় ভোক্তা পর্যায়ে গড়ে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে যা এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। শুধু বাসাবাড়ির গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি, পাশাপাশি সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন, শিল্প, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ক্যাপটিভ পাওয়ার, সার কারখানাসহ সব ক্ষেত্রে ব্যবহূত গ্যাসের দাম বেড়েছে। তবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)-এর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাধারণ জনগণের ব্যবহারিক জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এই গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির চাপ ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। যাতায়াত, শিক্ষার পাশাপাশি বাজারেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। পরিবহন খরচ, শিক্ষা উপকরণ বিশেষত কাগজের দাম বৃদ্ধি এবং ব্যবসায়ীদের গ্যাসের বাড়তি চাপ সমলাতে বিভিন্ন পণ্যের ওপর অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির কুফল ভোগ করতে হচ্ছে আমজনতাকে।
এদিকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে দেশের শিল্প জগতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এর মাধ্যমে সরকারের উন্নয়নশীল দেশ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার পথে প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে। অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় সরকার নতুন মেয়াদে বেসরকারি খাতের আরো প্রসার চায়। অথচ গাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তে বেসরকারি পর্যায়ের শিল্পোদ্যোগ কতখানি বেগবান হবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তে নিঃসন্দেহে বাড়বে পণ্য উৎপাদন ব্যয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়বে দেশি শিল্প। আর দেশীয় শিল্পের প্রসার না ঘটলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে না। ফলে দেখা যাচ্ছে, একটি ক্ষেত্রে দাম বৃদ্ধির কারণে দেশের মানুষের ব্যবহারিক জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে যেমন ব্যয়ভার বেড়ে যাবে, তেমনি সামাজিক ক্ষেত্রে চাকরির বাজারে দেখা দেবে অসন্তোষ ও অস্থিরতা। সুতরাং গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আগে আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতাগুলো আরো বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন ছিল বলে মনে করছি।
বর্তমান সময়ে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রাক্কালে বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন বা বিপিএমএ’র পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়েছে, দেশীয় কাগজ শিল্প টিকিয়ে রাখার স্বার্থে গ্যাসের দাম বাড়ানো ‘অযৌক্তিক’ ও ‘অপরিণামদর্শী’। সংগঠনটি তখন তাদের লিখিত বিবরণে বলেছিল, বর্তমানে গ্যাসের দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তাতে টনপ্রতি কাগজের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে ১০-১৫ হাজার টাকা। এই খরচ বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে বাজারে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ব্যবসায়ীরা। এমতাবস্থায় সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি যেন বাস্তবায়ন না করা হয়। তাদের মতে, এটি হবে শিল্পের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সঙ্গত কারণে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে। তখন মানুষ বিদেশি পণ্য কেনার দিকে ঝুঁকে পড়বে। আর তারই প্রভাব পড়বে দেশীয় কাগজ শিল্পের ওপর। তাই গ্যাসের দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ থেকে সরে আসার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা প্রদানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছে কাগজ শিল্পের সংগঠন বিপিএমএ’র নেতারা।
একথা স্বীকার করে নিতে হবে যে, দেশীয় কাগজ মিলগুলো নিজেদের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে কাগজ শিল্পকে স্বয়ংসম্পূর্ণ খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। দেশের বিনিয়োগকারীরা এই শিল্পের বিকাশে নতুন প্রযুক্তি সংযোজন করছেন। দেশীয় কাগজ শিল্পের উদ্যোক্তারা এই খাতে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। বহুমুখী প্রচেষ্টার ফলে উৎপাদন বেড়েছে। আবার গুণগত মান ভালো হওয়ার কারণে বিভিন্ন দেশের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে কাগজ আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাংলাদেশের কাগজ উৎপাদকরা যুক্তিসঙ্গত কারণে ইউরোপের বাজারে কাগজ রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধার পাশাপাশি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সুবিধা দাবি করে আসছে। কিন্তু আশ্চর্য লাগল সরকার যখন দেশীয় কাগজ শিল্পের উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছে, তখনই নানান জটিলতা সৃষ্টির মাধ্যমে এ শিল্পে দেখা দিয়েছে গভীর অনিশ্চয়তা। আমরাও মনে করি একটি শিল্প যখন অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সমৃদ্ধির স্বপ্নে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায়, তখন এর গতিসঞ্চারে আরো সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়াটাই উন্নয়নবান্ধব নীতি হওয়ার কথা। কিন্তু এখন গ্যাসের দাম বাড়ানোয় শিল্পটি সন্দেহাতীতভাবে বাধা ও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
তথ্যমতে, দেশে কাগজের বাজারের পরিমাণ ছয় হাজার কোটি টাকার। চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশের কাগজকলগুলো প্রায় ৩০টি দেশে রপ্তানি করছে। যার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে বাংলাদেশ। দেশের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই পৌঁছে দেওয়ার সাফল্যের পেছনে দেশীয় কাগজের উৎপাদন ও সরবরাহ বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এ শিল্পে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ১০ লাখ এবং পরোক্ষভাবে ৫০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। কাগজ শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে প্রায় ৩০০টির অধিক সহায়ক শিল্প গড়ে উঠেছে। তাই কাগজ উৎপাদনের অন্যতম মূল উপাদান গ্যাস ও বিদ্যুতের অপ্রতুলতা, দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি এবং সংযোগের ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতার কারণে কাগজ উৎপাদন যেন ব্যাহত না হয়, এ বিষয়টিও সরকারের ভেবে দেখার প্রয়োজন ছিল।
ভেবে দেখা দরকার ছিল নগরবাসী ২৪ ঘণ্টায় কতটুকু গ্যাস পাচ্ছে সেদিকটাও। বেলা বাড়ার সাথে সাথে গ্যাস উধাও। যার ফলে সারাদিনেও ঠিকমতো চুলা জ্বালানো সম্ভব হয় না। অনেক পরিবারকে বিকল্প চুলার ব্যবস্থা রাখতে হচ্ছে। বলতেই হয়— নগরবাসীর গ্যাস সংকটের সুরাহা কর্তৃপক্ষ আজো করতে পারেননি। অথচ একটা সময়ে গণশুনানিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে ভোক্তা, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজসহ সবার বিরোধিতা সত্ত্বেও ফের গ্যাসের নতুন দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিল এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিআইআরসি)। বিপরীতে বাসাবাড়ি ও শিল্প-কারখানার গ্যাস সংকট দূরীকরণ তো সম্ভবই হয়নি, পাশাপাশি অবৈধ গ্যাস সরবরাহও বন্ধ করতে পারেনি সরকার। ইতোমধ্যে এই গ্যাস বৃদ্ধির ফলে সার্বিক অর্থনীতি ও জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। একদিকে শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হবে, বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে এবং রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা কমে যাবে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। অন্যদিকে পরিবহন ভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এবং বাড়ি ভাড়াও বেড়ে যাবে। যার শিকার হবে ভুক্তভোগী স্বল্প আয়ের মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ।
যদিও বলা হচ্ছে, অপচয়, অদক্ষতা ও চুরির কারণে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এমন যুক্তি হাস্যকর বৈ আর কিছু নয়। জোচ্চুরি বন্ধ না করে বিপরীতে ভোক্তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় অনৈতিকই বলতে হবে। আরো জানা গেছে, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গ্যাস-বিদ্যুতের ১২ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এর মধ্যে অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠানও আছে। সরকারের উচিত হবে এসব বকেয়া বিল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া। উল্টো গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে ভোক্তা পর্যায়ে ব্যয়ভার বৃদ্ধি করে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্ত করা হলো। উৎপদান খরচ বেড়ে গিয়ে বাড়বে আমদানি। ফলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাবে বাইরে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে পড়বে। এতে রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্ত আমদানি হওয়া কাগজ, বোর্ড, বস্ত্রসহ নানা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি হওয়ায় হুমকিতে পড়বে দেশি শিল্প। বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেও উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পেরে লোকসান গুনতে হবে উদ্যোক্তাদের। আর অধিক মূল্যে পণ্য কিনতে আগ্রহ হারাবে বিদেশি ক্রেতারা।
সম্প্রতি রাজধানীর কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ক্ষেত্রে প্রিপেইড মিটারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই প্রিপেইড মিটার নিয়েও জনমনে নানা শঙ্কা ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সব ক্ষেত্রেই যখন দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের এ ছোট দেশটিতে, তখন ভরসার জায়গাটুকু হারিয়ে ফেলে অসহায় সাধারণ মানুষ। কিন্তু যতদূর জানতে পেরেছি, বাসাবাড়িতে গ্যাসের এই প্রিপেইড মিটার লাভজনকই বটে। আপাতদৃষ্টিতে মাত্র ৫০০ টাকায় ৪ জনের একটি ছোট সংসারে মাস কাবার হয়ে যায়। সুতরাং অন্তত বাসাবাড়িতে গ্যাসের প্রিপেইড মিটার দ্রুত স্থাপনের উদ্যোগ সরকার নিতেই পারে এবং এ বিষয়ে জোর প্রচার ও জনগণকে সচেতন করে তোলা আবশ্যক মনে করছি।
সাম্প্রতিক সময়ে নাগরিক সেবার সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতির আঁচড় লেগেছে, যার ভয়ংকর রূপ বিভিন্ন সময়ে খবরের কাগজগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন জনমনে দানা বাঁধতেই পারে। সাংবিধানিকভাবে জনগণকে সব ক্ষমতার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করলেও, সেই জনগণের কাছে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা কোথায়? আগামী দিনের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকারকে আরো সুবিবেচক হতে হবে।সুত্র বাংলাদেশের খবর
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.