এইমাত্র পাওয়া

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ২৬ হাজার স্কুল শিক্ষকের চাকরি বাতিল!

ঢাকাঃ পশ্চিমবঙ্গে এক সঙ্গে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও কর্মচারীর চাকরি বাতিল হয়ে যাওয়ায় সংকটে পড়েছে সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা।

সুন্দরবন অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকা ঝড়খালির বিরিঞ্চিবাড়ি সুরেন্দ্রনাথ বালিকা বিদ্যালয়। স্কুলটিতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। সেখানকার ছাত্রীর সংখ্যা ৪৯৮ জন।

গত সপ্তাহে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যখন নির্দেশ দিল, ২০১৬ সালে নিযুক্ত প্রায় ২৬ হাজার স্কুল শিক্ষক ও কর্মচারীর চাকরি বাতিল করতে হবে, তখনই ঝড়খালির ওই স্কুলটির প্রধান শিক্ষিকা অরুসীমা মিত্রর মাথায় হাত পড়ে।

তিনি বলেন, ‘‘আমার হয়তো যেসব সহকর্মী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চাকরি বাতিল হলো, তাদের কথাই প্রথমে মাথায় আসা উচিত ছিল রায়টা শুনে। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার প্রথমে মনে হয়েছিল আমার ছাত্রীদের কী হবে! ওদের কে পড়াবে এখন?’’

শিক্ষক নেই, পড়াবে কে?

ওই স্কুলটিতে প্রায় ৫০০ জন ছাত্রীর জন্য এমনিতেই নয়জন শিক্ষক ছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি বাতিল হয়ে গেছে তার মধ্যে চার জনের।

প্রধান শিক্ষিকা অরুসীমা মিত্র বলেন, ‘‘নয় জন শিক্ষক দিয়েই কোনোমতে স্কুলটা চলছিল। প্রত্যেককেই প্রচুর কাজের চাপ নিতে হয়। আমি নিজেও ক্লাস নেই নিয়মিত। কিন্তু এখন যেটা হলো, তাতে তো স্কুল চালানোটাই ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ল।’’

একই অবস্থা পশ্চিমবঙ্গের হাজার হাজার স্কুলে।

কোথাও মোট শিক্ষকের অর্ধেক সংখ্যক, কোথাও আবার একজনই শিক্ষক ছিলেন, তারও চাকরি বাতিল হয়ে গেছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে।

কোনো স্কুলে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এসে অবস্থা সামাল দিচ্ছেন। সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই পোস্ট করছেন যে, তারা বিনা পারিশ্রমিকে স্কুলে পড়াতে চান।

কোথাও আবার কর্মী নেই বলে স্কুলের ঘণ্টা বাজাতে হচ্ছে প্রধান শিক্ষককেই।

তিনি বলেন, শুধু তার স্কুল নয়, পুরো রাজ্যের স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থাটাই প্রায় ধসে পড়েছে এই রায়ের ফলে।

তার কথায়, ‘‘আমাদের বিজ্ঞানের শিক্ষক নেই, ভূগোলের শিক্ষক নেই। আগামী বছর যে ছাত্রীরা উচ্চ মাধ্যমিক দেবে, তাদের কে পড়াবে এখন? ওদের ভবিষ্যতটা কী হবে, সেটা ভেবেই তো দুশ্চিন্তা হচ্ছে।’’

প্রধান শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষিকাদের একটি সংগঠন অ্যাডভান্সড সোসাইটি ফর হেডমাস্টার্স অ্যান্ড হেড মিসট্রেসেসের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক চন্দন মাইতি বলেন, ‘‘এমনিতেই বছর দশেক ধরে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ হয়নি, অনেক শিক্ষক অবসর নিচ্ছেন, পদ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। এর ওপরে এই রায়ের ফলে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর চাকরি বাতিল যোগ হলো। এর ফল যেটা হবে ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে আসা বন্ধ করে দেবে। অনেক স্কুলে তারা আসছেও না।’’

তিনি বলেন, ‘‘এমনিতেই স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ে অনেক ছাত্র-ছাত্রী, তার ওপরে যদি শিক্ষক না থাকে তাহলে তো তারা আরও স্কুলে আসবে না’’।

যোগ্য-অযোগ্য শিক্ষক সবারই চাকরি গেছে

সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছে, প্রায় ৭ হাজারের কাছাকাছি ব্যক্তি যারা কথিতভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি পেয়েছিলেন, তাদের সঙ্গেই নিজেদের মেধার ভিত্তিতে যারা চাকরি পেয়েছিলেন তাদেরও চাকরি বাতিল হয়ে গেছে।

মেধার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়া শিক্ষকদের ‘যোগ্য’ এবং দুর্নীতি করে, অর্থাৎ কথিতভাবে ঘুষ দিয়ে যারা চাকরি পেয়েছিলেন তাদের ‘অযোগ্য’ বলে মনে করা হয়।

অনেকে নিয়োগ পরীক্ষায় সাদা খাতা জমা দিয়েও শিক্ষকের চাকরি পেয়েছেন বলে অভিযোগ।

এই দুর্নীতি নিয়ে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআই তদন্ত করেছে। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জী, তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতাসহ পশ্চিমবঙ্গের স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক ব্যক্তিই গ্রেফতার হয়েছেন।

তবে সুপ্রিম কোর্টের কাছে সর্বশেষ মামলায় যোগ্য এবং অযোগ্যদের আলাদা করে দেখানো হয়নি।

তাই কে নিজের মেধায় আর কে ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন, তা নির্ণয় না করতে পেরে শীর্ষ আদালত সবারই চাকরি বাতিল করে দিয়েছে।

শিক্ষকরা বলছেন, সরকারের তরফে কেন ‘যোগ্য’ এবং ‘অযোগ্য’ শিক্ষকদের পৃথক করা গেল না! এর আগে তো সেই হিসাব দেওয়া হয়েছিল।

দক্ষিণ ২৪ পরগণার ধোসা চন্দনেশ্বর নবীনচাঁদ হাই স্কুলের শিক্ষক মেহবুব মণ্ডল প্রশ্ন তুলছিলেন, ‘‘এর আগে তো সুপ্রিম কোর্ট নিজেই বলেছিল যে যোগ্য – অযোগ্যদের মাপকাঠি কী হবে, সেটা তারা ঠিক করে দেবে। সিবিআই-এর রিপোর্টেই তো আছে, কারা টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছে। তা সত্ত্বেও যোগ্য-অযোগ্যদের আলাদা করা গেল না কেন?’’

তিনি যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চের আহ্বায়কও।

তিনি আরও বলেন, ‘‘আবার এই সেদিন মমতা ব্যানার্জীও বললেন, যোগ্য শিক্ষকদের চাকরী ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য যেমন তিনি যথাসাধ্য করবেন, আবার অযোগ্যদের কথাও কিন্তু তিনি ঘুরিয়ে বলেছেন। তাদেরও পুনর্বাসনের একটা চেষ্টা করা হবে। এটা কিন্তু আমরা মানব না কিছুতেই’’।

রাজনীতির শিকার শিক্ষকরা

এদিকে শিক্ষকরা বলছেন তাদের চাকরি নিয়ে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হচ্ছে।

মেহবুব মণ্ডল বলেছেন, ‘‘একদিকে যোগ্য শিক্ষকদের যেমন বাদ দিয়ে দিল, অন্যদিকে সেই সুপ্রিম কোর্টই কিন্তু অতিরিক্ত শূন্য পদ যেটা তৈরি করেছিল রাজ্য সরকার, সেটা নিয়ে সিবিআই তদন্ত খারিজ করে দিল।

অর্থাৎ রাজ্য মন্ত্রিসভা পেছনের দরজা দিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের আবারও নিয়োগের যে একটা পরিকল্পনা করেছিল, সেটা জিইয়ে রাখা গেল। রাজ্য মন্ত্রিসভা তদন্তের হাত থেকে বেঁচে গেল।

তিনি বলেন, ‘‘আমাদের মতো কিছু সাধারণ মানুষকে বলি দিয়ে পরের বছরের বিধানসভা নির্বাচনের আগে একটা রাজনৈতিক খেলা চলল’’।

তার কথায় তাদের চাকরি হারানোটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা, অভিযোগের মূল আঙ্গুল রাজ্য সরকারের দিকেই।

ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস শিক্ষকদের চাকরি বাতিল হওয়ার জন্য বিজেপি এবং সিপিআইএমের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছে।

প্রধান শিক্ষকদের সংগঠনের নেতা চন্দন মাইতি বলেছেন, তার ৩৪ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় এরকম বড় বিপর্যয় তিনি দেখেননি।

শিক্ষকদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ ও লাথি

একদিকে যখন শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের চাকরি বাতিল নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক চলছে পশ্চিমবঙ্গে, তার মধ্যেই উঠে এসেছে বুধবার কলকাতায় শিক্ষকদের একটি বিক্ষোভে পুলিশের লাঠিচার্জ ও একজন শিক্ষককে পুলিশের লাথি মারা ঘটনাও।

সেই ভিডিও সংবাদমাধ্যমে প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিন্দার ঝড় উঠেছে।

এতটাই বিতর্ক তৈরি হয়েছে যে ঘটনাটি নিয়ে কলকাতার পুলিশ কমিশনার এবং রাজ্যের মুখ্য সচিবকে সংবাদ সম্মেলন করতে হয়েছে।

সেখানে আবার পুলিশ কমিশনার মনোজ ভার্মা বলেছেন, ‘হাল্কা বল প্রয়োগ’ করা হয়েছে।

যদিও যে পুলিশ কর্মী এক শিক্ষককে লাথি মেরেছিলেন, তাকে তদন্তের মুখে পড়তে হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার অবশ্য পুলিশ একটি ভিডিও প্রকাশ করে বলেছে, কলকাতার কসবা এলাকায় স্কুল পরিদর্শকের যে দফতরে শিক্ষকরা বিক্ষোভ দেখাতে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে পেট্রল দিয়ে আগুন জ্বালানোর মতো কথা শোনা গিয়েছিল। সেজন্যই সরকারি সম্পত্তি রক্ষা করতে তারা লাঠি চালিয়েছেন।

অন্যদিকে বৃহস্পতিবার চাকরি হারা শিক্ষক-কর্মচারী এবং নাগরিক সমাজের অনেক মানুষ কলকাতায় একটা মিছিল করেছেন।

এই পরিস্থিতিতেই শুক্রবার শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে চাকরি হারা শিক্ষকদের বৈঠক হওয়ার কথা আছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১১/০৪/২০২৫


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading