এইমাত্র পাওয়া

‘শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে পুনর্বিন্যাস দরকার’

ঢাকাঃ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে প্রায় সাত মাস অতিবাহিত হলো। এই সময়ে সরকারের বড় সাফল্য ছিল বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার কমিশন গঠন করা এবং সেগুলোর রিপোর্ট নিশ্চিত করা। যেমন- শ্বেতপত্র কমিটি, সংবিধান কমিশন, নির্বাচন ও আরও কয়েকটি কমিশন ইতোমধ্যে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। আশা করি, প্রয়োজনীয় সংস্কারের পথ তৈরিতে রিপোর্টগুলো ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে, গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বিপরীত যাত্রাও গত কয় মাসে দেখা গেছে। গণ-অভ্যুত্থানে যারা নিহত ও গুরুতর আহত হয়েছেন তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই দরিদ্র বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বা কর্মজীবী। নিহতদের পরিবার এবং আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই নেওয়ার কথা। আমরা দেখেছি, তা এখনো অগোছালো অবস্থায় আছে।

ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের কারণে সংখ্যালঘু অনেক মানুষ নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে দিনরাত কাটাচ্ছেন এখনো। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার, বহু শ্রমিককে বকেয়া মজুরির জন্য এখনো পথে নামতে হচ্ছে। বেশির ভাগ জিনিসপত্রের দাম এখনো ক্রয়ক্ষমতার ওপরেই আছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী; যাদের এই সরকারের না চেনার কথা নয়। এ ছাড়া আবার শুরু হয়েছে চাঁদাবাজি, যা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে কাজ করে। পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে চার-পাঁচটা গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশের বাজারের বেশকিছু পণ্য সরবরাহ। এই যে কতিপয় গোষ্ঠীর বাজার নিয়ন্ত্রণ, এটা আগের সরকার ভাঙার বদলে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। বর্তমান সরকারও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এই চাঁদাবাজি নতুন করে শুরু হওয়া কিংবা অলিগোপলির নিয়ন্ত্রণ অর্থনীতির ওপরে, এটাকে ভাঙা বর্তমান সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু এতে সরকারের বিশেষ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

প্রকৃতপক্ষে হাসিনা সরকারের সময় বাংলাদেশের অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর করে ফেলা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া কাজ করার বদলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওপরের আদেশেই কাজ হতো। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবার ঠিক জায়গায় নিয়ে আসা এবং জনস্বার্থে পুনর্বিন্যাস করাটা হচ্ছে বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

বাংলাদেশের অর্থনীতির নীতিগত কাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি। অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, তারা খুব ভালো করে জানেন যে, ব্যাংকিং খাতে কীভাবে অনিয়ম হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ তদারকিতে কীভাবে কতিপয় গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যাংকিং নীতিমালা তৈরি করেছে এবং পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। তারা জানেন কতিপয় গোষ্ঠীর ঋণের নামে ব্যাংক লুট, অসম্ভব মাত্রায় কতিপয় গ্রুপকে আর্থিক সুবিধা দিতে গিয়ে পুরো আর্থিক খাতে কী ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংককে একটা কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানো, যেসব ব্যাংক রাজনৈতিক ও কতিপয় গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলোকে পুনর্গঠন, পুনর্বিন্যাস বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন্ধ করে দেওয়া, মূল্যস্ফীতি ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় মুদ্রানীতি প্রণয়ন- এগুলো করার জন্য কমিশনের সংস্কার কর্মসূচি বা কমিশনের রিপোর্টের অপেক্ষা করার দরকার নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কার যদি ঠিকমতো হয়, ব্যাংকিং ক্ষেত্রে অনিয়মগুলো যদি দূর হয়, বাজারে মুদ্রাব্যবস্থা যদি সুস্থ অবস্থায় আসে, ডলার এক্সচেঞ্জ রেট স্বাভাবিক অবস্থায় আসে, এসবই মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ এখনো বিশ্বের মধ্যে নিকৃষ্ট। হাসিনা আমলের পরিবেশ বিধ্বংসী প্রাণবিনাশী প্রকল্প এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি এখনো অব্যাহত আছে। যানজট, দুর্ঘটনা বা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত আছে। এর মধ্যে সরকার নতুন ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ করে জনজীবনে আরও বোঝা চাপিয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে দায়মুক্তি আইন সরকার স্থগিত করলেও এই দায়মুক্তি আইনের অধীনে যেসব প্রাণবিনাশী প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যেসব জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি করা হয়েছে সেগুলো অব্যাহত রাখা হবে বলে জানানো হয়েছে। আমি মনে করি যে, এটা ভুল একটা সিদ্ধান্ত। যেসব প্রকল্প ও চুক্তি বাংলাদেশের জনগণের জন্য বিপজ্জনক, বাংলাদেশের প্রাণপ্রকৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ এবং বড় আর্থিক বোঝা তৈরি করতে পারে- এসব প্রকল্প এবং চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন দরকার। এবং যেগুলো খুবই ক্ষতিকর, সেগুলো বাতিল করা দরকার। যেমন- আমি উদাহরণ হিসেবে নির্দিষ্ট করে রামপাল ও রূপপুরের কথা বলব।

এগুলো বাতিল করলে কিছু আর্থিক ক্ষতি হবে ঠিকই, কিন্তু বাতিল না করলে আর্থিক ক্ষতি হবে আরও বেশি, সেই সঙ্গে হবে প্রাণপ্রকৃতি ও মানুষের জীবনের হবে বড় ক্ষতি। সেজন্য এগুলোর বোঝা থেকে কীভাবে বাংলাদেশ ও মানুষকে রক্ষা করা যায়- সেটা নিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া শুরু করা এই সরকারেরই দায়িত্ব। অন্যদিকে বৈষম্যবাদী রাজনীতির নড়াচড়া ক্রমেই বাড়ছে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে খাটো বা অস্বীকার করে এই জনপদের মানুষের লড়াইয়ের ঐতিহ্যকে খারিজ করা, সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকে মহিমান্বিত করার প্রবণতা ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। জোরজবরদস্তি, ট্যাগিং, মব ভায়োলেন্স ও নারীবিদ্বেষী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন মাত্রায়। যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির কর্তৃত্বে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির ধারা দখল, লুণ্ঠন ও দুর্নীতির পথ তৈরি করেছিল, সেই ধারাও অব্যাহত রাখা হচ্ছে। বলাই বাহুল্য, গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গেলে এসবের পরিবর্তন হতে হবে।

দেশের পানি, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে, পাট, শিক্ষা, চিকিৎসা ও অবকাঠামোর ক্ষেত্রে তাদের ঋণ আছে অনেক এবং তাদের বিভিন্ন ধরনের নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা আছে। সেই নীতিমালার ধারাতেই ব্যাপক দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। এদের সমর্থিত যেসব প্রকল্প আছে, সেই প্রকল্পগুলোর বিস্তারিত অনুসন্ধান দরকার। সেই অনুসন্ধানে যদি দেখা যায় যে, এসব প্রকল্পের কারণে অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক বোঝা তৈরি হয়েছে কিংবা জনগণের প্রয়োজনের বিপরীতে কতিপয় গোষ্ঠীকে সুবিধা দিয়েছে, তাহলে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবিকেও জবাবদিহির আওতায় আনার একটা প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এটা না করলে অর্থনীতির ধারার কোনো পরিবর্তন হবে না।

মোট কথা, সরকারকে আস্থা তৈরি করতে হবে। অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সরকার যে সম্প্রতি হঠাৎ করে গত সরকারের স্টাইলে মানুষের ওপর ভ্যাট ও করের বোঝা চাপিয়ে দিল তা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আস্থা কমাবে, আরও কঠিন অবস্থা তৈরি করবে তাদের জন্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকারের পতন পর্যন্ত অর্থনীতির যে গতি বা ধারা ছিল, সেখানে অচিন্তনীয় মাত্রায় কতিপয় গোষ্ঠীর লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল। ফলে দীর্ঘমেয়াদি অনেক ক্ষতি হয়েছে। এতে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যেতে থাকে। অতিব্যয়ে করা ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলোর জন্য ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়তে থাকে। মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় ব্যাপকভাবে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার উঁচু দেখালেও তা কর্মসংস্থানের সমস্যা কমাতে পারেনি।

অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতের দামও বাড়ে। এর সঙ্গে সম্পদ কেন্দ্রীভবন, বৈষম্য বৃদ্ধি- এগুলো যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করে, তাতে শেখ হাসিনা সরকারের পতন না ঘটলে, এই সংকটগুলো আরও বেশি ঘনীভূত হতো, তাতে সন্দেহ নেই। এসব ঋণ শোধের চাপ সামনে আরও বাড়বে। তবে জনগণের নামে একটা ভূমিকা নিতে পারে সরকার। বলতে পারে, এগুলো যেহেতু অনির্বাচিত সরকার জনসম্মতির বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেরা কমিশন পাওয়ার জন্য এবং কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা নেওয়ার জন্য নিয়েছে, যেহেতু দুর্নীতি, লুটপাট ও পাচার হয়েছে এর বড় অংশ। সেহেতু এর দায়িত্ব আমরা কেন নেব? এই প্রশ্ন তুলতে হবে। দরকষাকষি করে সময় বাড়াতে হবে, সুদ এবং আসল পরিমাণ কমাতে হবে।

শিক্ষা নিয়ে যথাযথ উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন অবশ্যই দরকার। তবে তা যেন নতুন সমস্যা তৈরি না করে সেদিকে নজর রাখতে হবে। যেকোনো রাজনৈতিক দলের দাপট দূর করা উচিত। রাজনৈতিক সচেতনতা, সুস্থ বিতর্ক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ইত্যাদি বিষয়গুলো অবশ্যই থাকতে হবে। অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে মৌলিক কিছু পার্থক্যের সূচনা করতে হবে সরকারকে। যেমন আগের সরকার নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সামরিক-বেসামরিক আমলা ও পুলিশকে অনেক বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। এবং কতিপয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে খুলে দেওয়া হয়েছে ব্যাংক ও অনান্য আর্থিক খাত।

বিপরীতে যারা বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য ও চাপের সম্মুখীন হয়েছে তার মধ্যে প্রধানত হচ্ছে সর্বজনের জন্য প্রয়োজনীয় খাতসমূহ। যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ, নিয়োগ, অবহেলার কারণে এখানে একটি নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। এর পাশাপাশি শ্রমিকদের কথাও আমরা বলতে পারি। শিক্ষার্থী ও শ্রমিক- এই দুই জনগোষ্ঠী আর্থিকভাবেও বড় ধরনের বঞ্চনার শিকার হয়েছে। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে গেলে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বরাদ্দের বর্তমান চিত্র পরিবর্তন করে তা আন্তজার্তিক মানে নিয়ে আসতে হবে। জিডিপির শতকরা কমপক্ষে ৬ ভাগ বরাদ্দের ধারা তৈরি করলে ব্যয় বাড়বে বর্তমানের ৩ থেকে ৫ গুণ। তার যথাযথ ব্যবহারের জন্য এই দুটো খাতে বড় ধরনের পুনর্বিন্যাস দরকার আছে। পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও এর প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা তৈরির জন্য পুরো ব্যবস্থার বদল দরকার। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের বৈষম্যের ভিত তৈরি করে। শিক্ষা হতে হবে সব নাগরিকের অধিকার, তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই।

লেখক: শিক্ষাবিদ আনু মুহাম্মদ

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০১/০৩/২০২৫ 


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.