নিজস্ব প্রতিবেদক।। নতুন শিক্ষাবর্ষের ছয় দিন অতিবাহিত হয়েছে গতকাল সোমবার। কিন্তু এখনও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী বিনামূল্যের পাঠ্যবই পায়নি। ফলে পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্সনের পিডিএফের প্রিন্ট কপির প্রতি ঝুঁকেছে শিক্ষার্থীরা। এটি ডাউনলোড করে প্রিন্ট করাতে গিয়ে উচ্চমূল্য দিতে হচ্ছে অভিভাবকদের। এ ছাড়া ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করতে গিয়ে পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি। তবে দরিদ্র ও সীমিত আয়ের অভিভাবকদের পক্ষে পিডিএফ প্রিন্ট নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তৈরি হচ্ছে বৈষম্য।
২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ৬ কোটি ৪৩ লাখ ৪৭ হাজার ৭৬২ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই ছাপার কাজ করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের প্রথম দিনে মাত্র ছয় কোটি বই দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বাকি ৩৪ কোটি বই দিতে ফেব্রুয়ারি মাস পার হয়ে যেতে পারে। এ সময়ের মধ্যে নতুন পাঠ্যবই হাতে না আসা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের জন্য পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্সন উদ্বোধন করা হয়েছে। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে গত বুধবার শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ‘পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্সন উদ্বোধন ও মোড়ক উন্মোচন’ করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বছরের প্রথম দিন সব শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই পৌঁছাতে না পেরে
দুঃখ প্রকাশ করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা।
তবে সন্তানের জন্য ছাপানো বই না পেয়ে দুঃখ বেড়েছে অভিভাবকদের। অনলাইনের পিডিএফ প্রিন্ট করতে বিনামূল্যের বইয়ে উচ্চমূল্য দিতে হচ্ছে তাদের। অনেক অভিভাবক অভিযোগ করেন, পিডিএফ প্রিন্ট করাতে গিয়ে বইপ্রতি তাদের খরচ হচ্ছে সাড়ে ৩শ থেকে সাড়ে ৫শ টাকা। কোনো শ্রেণির বইয়ে খরচ পড়ে আরও বেশি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সালেহা বেগম গতকাল বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা (চারুপাঠ) বইয়ের পৃষ্ঠা হচ্ছে ১০৯টি। এই বইটি দোকানে প্রিন্ট করতে গেলে প্রতি পৃষ্ঠা ৩ টাকা করে লাগে ৩২৭ টাকা। এর সঙ্গে যোগ করতে হয়েছে স্পাইরাল বাইন্ডিং ৫০ টাকা। সব মিলিয়ে এই বইটির জন্য আমার খরচ করতে হয়েছে ৩৭৭ টাকা। বিজ্ঞান বইয়ের পৃষ্ঠা হচ্ছে ১৩৮টি। বইটির জন্য খরচ হচ্ছে ৪৬৪ টাকা। খরচ বেশি হওয়ায় তিনি আর কোনো বই প্রিন্ট করতে চান না বলেও জানান এই অভিভাবক।
বনশ্রী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে এক কম্পিউটারের দোকানি মিঠু জানান, পেনড্রাইভ থেকে ডকুমেন্ট প্রিন্ট করতে চাইলে প্রতি পৃষ্ঠা ১০ টাকা চার্জ। আর দশ থেকে একশ পৃষ্ঠার একটি স্পাইরাল বাইন্ডিয়ে আমরা নিই ৫০ টাকা। স্পাইরাল বাইন্ডিয়ে সর্বনিম্ন চার্জ ৩০ টাকা। তিনি বলেন, কেউ এক-দেড়শো পৃষ্ঠা প্রিন্ট করলে প্রতি পৃষ্ঠা ৩ টাকা করে নিই। চলতি সপ্তাহে বই প্রিন্ট করার কাজই হচ্ছে বলেও জানান এই দোকানি।
রাজধানীর মতিঝিল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মিজানুর রহমান বলেন, তার ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন। এখনও স্কুলে ক্লাস শুরু হয়নি। আগামী ১২ তারিখ থেকে ক্লাসে যাবে। অনলাইনে পিডিএফ বই প্রিন্ট করতে দুই থেকে তিন হাজার টাকা লাগবে বলে তিনি পিডিএফ প্রিন্ট করেননি। অভিযোগ করে এই অভিভাবক বলেন, নিশ্চয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার প্রতি উদাসীন ছিল। তারা তো জানেই প্রতি বছর বই দিতে হয়। এবার কেন তারা প্রস্তুতি নেয়নি?
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক মিশু চৌধুরী বলেন, বছরের শেষদিকে সরকার পরিবর্তন হয়ে এই গোলমাল তৈরি হয়েছে। সবকিছুই পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবর্তনের ভালো-মন্দ দুটোই আমাদের দেখতে হচ্ছে। এখন একটাই প্রত্যাশা, অন্তত জানুয়ারি মাসের মধ্যে যেন আমাদের সন্তানরা সব বই হাতে পায়।
ধানমন্ডি আইডিয়াল আদর্শ স্কুলের শিক্ষক মো. সাজ্জাদুল ইসলাম জানান, এনসিটিবি ওয়েবসাইটে (যঃঃঢ়ং://হপঃন.ঢ়ড়ৎঃধষ.মড়া.নফ/) বইয়ের পিডিএফ কপি ডাউনলোড করতে ঝামেলা হচ্ছে। ডাউনলোড ক্লিক করলে বার্তা দিচ্ছে ‘একই সময়ে অনেক ভিজিটর, ডাউনলোডের জন্য অপেক্ষা করুন’। একাধিকবার চেষ্টা করে ষষ্ঠ শ্রেণির দশটি বিষয়ের পাঠ্যবই প্রিন্ট করা গেছে।
বই বিলম্বের কারণ হিসেবে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানিয়েছেন, গত বছর যখন বইয়ের কাজ শুরু করা হয়েছিল, সেটা অনেক দেরিতে হয়েছে। অনেক বই পরিমার্জন করতে হয়েছে। তবে উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি যে কবে নাগাদ সব শ্রেণির শিক্ষার্থী তাদের সব বিষয়ের পাঠ্যবই হাতে পাবে।
এ বিষয়ে গতকাল এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক মো. হাফিজুর রহমান জানান, রাত-দিন ছাপাখানায় পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ চলছে। আশা করছি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব বই ছাপা শেষ হবে। বই ছাপানোর কার্যক্রম তদারকির জন্য এনসিটিবির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাত-দিন নিরলস পরিশ্রম করছেন।
পাঠ্যবই ছাড়া শিক্ষার্থীদের ক্লাসে শিক্ষকরা নানা বিষয়ে বেসিক ধারণা দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ এমাম হোসাইন। তিনি বলেন, তার স্কুলে এক জানুয়ারি থেকে পুরনো শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হলেও ১২ জানুয়ারি থেকে ভর্তীকৃত নতুন শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হবে।
শিক্ষাবার্তা /এ/০৭/০১/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.