বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলিতে দক্ষ ও অতি দক্ষ জনসংখ্যা ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। জার্মানিতে প্রায় ৭৩ শতাংশ জনসংখ্যা দক্ষ। জাপানে ৬৬, সিংগাপুরে ৬৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০, চীনে ৫৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০. মালয়েশিয়ায় প্রায় ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি মাধ্যমে অধ্যয়ন করেন। বিপরীতে বাংলাদেশে সার্বিকভাবে স্বল্প দক্ষ ও দক্ষ জনশক্তি ৩৮ শতাংশ বলা হইলেও কারিগরিভাবে দক্ষ, মধ্যমানে দক্ষ কিংবা স্বল্প দক্ষ জনশক্তি মাত্র ১৪ শতাংশ। এই হতদশার অন্তর্নিহিত কারণ কী?
প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষা এখনো অবহেলিত ও অজনপ্রিয়। এই শিক্ষা সম্পর্কে জনমনে এখনো যেমন বিরূপ ধারণা রহিয়াছে, তেমনি এই শিক্ষাব্যবস্থায় রহিয়াছে নানান সমস্যা ও সংকট, যেমন-আমরা এতদিন ধরিয়া জানিয়া আসিতেছি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ড্রপআউট বা ঝরিয়া পড়িবার হার অধিক। এখন জানা যাইতেছে দেশের সরকারি ও বেসরকারি পলিটেকনিক বা কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতেও আশঙ্কাজনক হারে কমিতেছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
যেইখানে কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নের ভিত্তিতে আমরা উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিতেছি, সেইখানে এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের ড্রপআউটের কথা কি মানিয়া লওয়া যায়?
খবরে প্রকাশ, ২০২২ সালের পূর্বে সরকারি পলিটেকনিক কলেজগুলিতে শিক্ষার্থী ভর্তি হইয়াছিল ৪৯ হাজার ৮০০ জন; কিন্তু ২০২৩ সালে ভর্তি হইয়াছে মাত্র ৩৮ হাজার ৬০০ শিক্ষার্থী। অপর দিকে বেসরকারি পলিটেকনিক কলেজগুলিতে ২০২২ সালের পূর্বে ভর্তির সংখ্যা ছিল ৫২ হাজার: কিন্তু পরের বৎসরে ভর্তি হইয়াছে ৩০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ভর্তির সংখ্যাই কমিয়া গিয়াছে ৩৪ হাজারের অধিক। শতকরা হিসাবে এক বৎসরে এই শিক্ষা খাতে শিক্ষার্থী কমিয়াছে ৪০ শতাংশ।
বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। ইহার অন্যতম বড় কারণ- পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলিতে শিক্ষার্থী ভর্তিসংক্রান্ত বিরাজমান নানা জটিলতা। বিশেষত কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ হইতে কার্যকর করা নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি ও শিক্ষার মানের অবনতির কারণে ভয়ানক ক্ষতির সম্মুখীন হইয়াছে আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থা।
আমরা জানি, অর্ধশতাব্দীরও পূর্ব হইতে কারিগরিতে মোটামুটি দক্ষ জনশক্তি তৈরির উদ্দেশ্যে সরকারিভাবে কিছু পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয় আমাদের দেশে। সেইখান হইতে চার বৎসর মেয়াদের শিক্ষা সফলভাবে সম্পন্নকারীদের সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে উপসহকারী প্রকৌশলী হিসাবে নিয়োগ করা হয়। মূলত এই সকল ডিপ্লোমাধারী প্রকৌশলীরই প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। প্রত্যক্ষভাবে কাজ করিবার অভিজ্ঞতা থাকিবার কারণে তাহাদের অনেকে পরে উদ্যোক্তা হইয়া দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখেন। ইহা ছাড়া ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থীরা বিদেশে যাইয়া সাধারণ শ্রমিকদের তুলনায় দ্বিগুণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনয়ন করেন।
এই সকল ইতিবাচক কারণে প্রাইভেট সেক্টরে ইনস্টিটিউট স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার পর দেশে এই পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক প্রাইভেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। এই বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক; কিন্তু আমাদের দেশে কলেজে ভর্তির পর শুরু হয় পলিটেকনিকে ভর্তি প্রক্রিয়া।
ইহাতে শিক্ষার্থীরা পলিটেকনিকে ব্যর্থ হইলে অন্যত্র ভর্তির আর সুযোগ থাকে না। ফলে সরকারি পলিটেকনিকে ভর্তি ইচ্ছুক এবং অপেক্ষমাণ তালিকা হইতে তিন/চার বার আহ্বান করিয়াও সকল আসন পূরণ করা সম্ভব হয় না। বেসরকারি পলিটেকনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির অবস্থা আরো বেগতিক ও শোচনীয়। এইজন্য কলেজ ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলিতে একযোগে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দিতে হইবে।
দ্বিতীয়ত বেসরকারি পলিটেকনিকগুলিতে শিক্ষকের সংকটে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটিয়াছে। ফলে সার্টিফিকেট অর্জন করিয়াও মিলিতেছে না সম্মানজনক কর্মসংস্থান। ইহা এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা, যেইখানে হাতে কলমে শিক্ষা দিতে হয়। এই জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত, অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিক্ষক।
বৈশ্বিক বাস্তবতা ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদায় আমাদের কারিগরি শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা আজও অপ্রতুল। পশ্চাৎপদ শিক্ষা দান পদ্ধতি, যুগোপযোগী কারিকুলামের অভাব, নিম্নমানের প্রশ্ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন ব্যবস্থা, নকল ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন জালিয়াতি, ল্যাব ফ্যাসিলিটির স্বল্পতা, আর্থিক বরাদ্দের অভাব প্রভৃতি বহুমাত্রিক সংকট বিদ্যমান এই শিক্ষাব্যবস্থায়। তাই এই ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সুদৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এ/১৬/১১/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.