নিজস্ব প্রতিবেদক।। পটুয়াখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের নামে সরকারের কয়েকশ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। জেলার কলাপাড়া উপজেলায় আশুগঞ্জ কয়লাভিত্তিক ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প ২০২১ সালে বাতিল করা হলেও এরই মধ্যে এই প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ৮শ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
এদিকে প্রকল্পটি বাতিল হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অধিগ্রহণকৃত তিন ফসলি জমি ও ভিটেমাটি ফেরত দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। অন্যদিকে আশুগঞ্জ পাওয়ার কোম্পানি একই স্থানে এলএনজি বা সোলার বেজ একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের প্রস্তাবনা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে শিগগির জমা দিবেন বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক।
২০১৮ সালে আশুগঞ্জ ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের লক্ষ্যে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ৯৮০ একর জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। অধিগ্রহণ করা এসব জমির অধিকাংশই তিন ফসলি। পরে ২০২১ সালে কয়লাভিত্তিক এ প্রকল্প বাতিল করা হয়। এরই মধ্যে এই প্রকল্পে সরকারের নিজস্ব তহবিলের ৭৭০ কোটি টাকাসহ ৮৫৩ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
সরেজমিন কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নের দেবপুরে প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এখনও দিগন্ত বিস্তৃত তিন ফসলি জমিতে সবুজ ধানের ক্ষেত। সেই তিন ফসলি জমি ভেকু মেশিন ব্যবহার করে বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেই সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে দুই শতাধিক পরিবারকে। তুলে দেওয়া হয়েছে সীমানা প্রাচীর।
উচ্ছেদের দগদগে ক্ষতচিহ্ন এখনও স্পষ্ট। পুকুরে, ডোবায় পড়ে আছে ঘরের চালা, বেড়া। পরিবেশ অধিদপ্তরকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভরাট করা হয়েছে শত বছরের খাল। বাতিল প্রকল্পে অধিগ্রহণের নামে শত শত একর জমি দখল করায় দুর্ভোগে পড়েছেন স্থানীয় সাধারণ মানুষ, যাদের অধিকাংশই পায়নি ক্ষতিপূরণের অর্থ। অথচ প্রকল্পের নামে লুটপাটের এ স্বর্গরাজ্য তৈরি করেছে আশুগঞ্জ পাওয়ার কোম্পানি।
দেবপুর এলাকার স্থানীয় কৃষক নেতা মো. ফরিদ তালুকদার (৬৮) জানান, ধানখালী ইউনিয়নে বিগত সরকার তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য পর্যায়ক্রমে জমি অধিগ্রহণ করে। এর মধ্যে পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের জন্য ১ হাজার একর, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প আরপিসিএল ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের জন্য ৯৫০ একর এবং আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রে নির্মাণের জন্য ৯৮০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। প্রথম দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে বড় প্রতিবাদ না হলেও আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হলে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন স্থানীয় সাধারণ মানুষ।
২০১৮ সালে তিন ফসলি জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে তারা সংবাদ সম্মেলন, মিছিল, সমাবেশসহ উচ্চ আদালতে মামলা করেন। পরে তৎকালীন সরকারের (আওয়ামী লীগ) স্থানীয় সংসদ সদস্য দলীয় ক্যাডার বাহিনী এবং পুলিশ দিয়ে বাদীর ওপর চাপ তৈরি করে মামলা প্রত্যাহার করান। এর পরই ভেকু মেশিন দিয়ে ঘরবাড়ি ভেঙে জমি দখল শুরু করে আশুগঞ্জ পাওয়ার কোম্পানি।
ফরিদ তালুকদার বলেন, বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের নামে সরকারের শত শত কোটি টাকা লুটপাট করা হচ্ছে এখানে। বিশেষ করে বাতিল হওয়া প্রকল্পে ৮৫০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমি ফেরত দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
একই এলাকার ফরিদা বেগম (৪৫) বলেন, তিনি রান্নাঘরে রান্না করছিলেন। কেবল মাত্র তরকারিতে মসলা দিয়েছেন। এরই মধ্যে কোম্পানির লোকজন ভেকু মেশিন লাগিয়ে তার ঘর ভাঙতে শুরু করে। ওই সময় তার স্কুলপড়ুয়া দুই মেয়ে ঘরের মধ্যে ছিল। তড়িঘড়ি করে মেয়েদের নিয়ে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছেন তিনি। ঘরের কোনো মালামালই রক্ষা করতে পারেন নি তিনি। এখন বাঁধের পাশে ঘর উঠিয়ে কোনোমতে জীবনযাপন করছেন।
তিনি জানান, এখনও ক্ষতি পূরণের কোনো টাকা পাননি। দেওয়া হয়নি পুনর্বাসনের ঘরও। আগে তার হাঁস-মুরগি, গরু-মহিষ, পুকুর ভরা মাছ, গোলাভরা ধান ছিল। এখন তিনি ছিন্নমূল। এমন উন্নয়ন এলাকার মানুষ চায় না বলে দাবি করেন তিনি। প্রকল্প বাতিল হওয়ায় নিজেদের তিন ফসলি জমি ফেরত চান তারা।
গাছের নিচে বসে ইলিশ জাল সেলাই করছিলেন জেলে রিয়াজ (৩৫)। তার সঙ্গে বসা ছিলেন স্থানীয় আবদুল হক হাওরাদার (৭০), আরেফিন হাওলাদার (৩২), হারুন হাওলাদার (৪৩) ও আমীর হোসেন (৪৫)। তারা জানান, প্রকল্প এলাকার মধ্যে শত বছরের পুরনো প্রবাহমান একটি খাল ছিল। সেই খালটি বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়েছে।
এতে বর্ষা মৌসুমে পুরো এলাকার পানি নামতে পারে না। জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে ফসল পচে যায়। বার বার আশুগঞ্জ পাওয়ার কোম্পানির লোকজনকে বলার পরও তারা পানি নামার কোনো ব্যবস্থা করেনি।
পটুয়াখালী ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট আশুগঞ্জ সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট ভূমি অধিগ্রহণ, ভূমি উন্নয়ন ও সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. কামরুজ্জামান ভূঞা জানান, এখনও চূড়ান্ত কোনো পরিকল্পনা সরকারের তরফ থেকে ঠিক করা হয়নি।
সরকারের সর্বশেষ পরিকল্পনা ছিল এলএনজি বেজ বা সোলার বেজ একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট এখানে নির্মাণ করা হবে। যদি বর্তমান সরকারের অনুমোদন পাওয়া যায়, তাহলে আড়াই থেকে তিন বছরের মধ্যে এখানেই সোলার বেজ পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ করা যাবে। তিনি বলেন, যেহেতু আশুগঞ্জ পাওয়ারের হাতে প্রায় ২ হাজার একর জমি আছে; সে কারণে এখানে নতুন কোনো না কোনো প্রকল্প হবে।
জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্ষতিপূরণের টাকা এককালীন জেলা প্রশাসকের তহবিলে জমা দেওয়া হয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে প্রকৃত জমির মালিকদের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে টাকা দেওয়া হয়। এখানে আশুগঞ্জ পাওয়ারের কোনো হাত নেই বলে জানান তিনি।
পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফিনের কাছে এ বিষয়ে জানাতে চাইলে বলেন, তিনি অল্প কিছুদিন হয় দায়িত্বে এসেছেন। এ মুহূর্তে সব তথ্য তার হাতে নেই।
তবে তিনি জানান, আশুগঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্টে অধিগ্রহকৃত জমির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত ১৭৫টি পরিবারের পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজ ৯০ বাগ শেষ হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হলে পরিবারগুলোকে ঘরের চাবি হস্তান্তর করা হবে।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এ/১২/১১/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.