নিজস্ব প্রতিবেদক।।
ডিম ও মুরগির বাজারের অস্থিরতা সামাল দিতে উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে পণ্যগুলোর যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নির্ধারিত দাম বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমন উদ্যোগে বাজারে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরবে বলে প্রত্যাশা করেছিলেন ভোক্তারা। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি। কারণ, সরকার নির্ধারিত যৌক্তিক মূল্যের ধার ধারছে না বিক্রেতারা। উল্টো দাম আরও বেড়েছে। এতে হতাশ ও ক্ষুব্ধ ভোক্তারা।
যৌক্তিক মূল্যে ডিম কিনতে বাজারে গিয়ে গতকাল হতাশ হতে হয়েছে কদমতলী এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবি মো. আনিস রহমানকে। তিনি বলেন, খুচরায় সরকার নির্ধারিত দামে ফার্মের ডিমের ডজন ১৪২-১৪৩ টাকা বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ টাকা। দাম তো কমেনি উল্টো আরও বেড়েছে। এ কেমন কথা। তিন দিন আগেও ১৫৬ টাকা কিনেছি।
এলাকার ডিমের খুচরা বিক্রেতা মো. শাজাহান বলেন, কত দাম বেঁধে দেয়া হলো, সেভাবে বাজার চলে না। পাইকাররাই সোমবার দাম বাড়িয়েছে। তাই খুচরায়ও বেড়ে গেছে।
গত রবিবার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এক চিঠিতে জানানো হয়, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ডিম, ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও পোলট্রি খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মতামতের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের জন্য ডিম ও মুরগির এই যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছে।
নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী, প্রতি পিস ডিমের মূল্য উৎপাদক পর্যায়ে ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, পাইকারিতে ১১টা ০১ পয়সা এবং খুচরায় ১১ টাকা ৮৭ পয়সা। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি উৎপাদক পর্যায়ে ১৬৮ টাকা ৯১ পয়সা, পাইকারিতে ১৭২ টাকা ৬১ পয়সা এবং খুচরায় ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা। আর প্রতি কেজি সোনালি মুরগি উৎপাদক পর্যায়ে ২৬০ টাকা ৭৮ পয়সা, পাইকারিতে ২৬৪ টাকা ৫৭ পয়সা এবং খুচরায় ২৬৯ টাকা ৬৪ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। অথচ বাজারে এর থেকে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাজার ও দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশিরভাগ দোকানে ফার্মের বাদামি ডিমের ডজন বিক্রি হয়েছে ১৬৫ টাকা। কোথাও কোথাও এর চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। অথচ, সরকার নির্ধারিত প্রতি পিস ডিমের দাম ১১ টাকা ৮৭ টাকা ধরে প্রতি ডজন ডিম খুচরায় বিক্রি হওয়ার কথা ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ডজনে নির্ধারিত দামের চেয়ে ২২ টাকা ৫৬ পয়সা বেশি গুনতে হচ্ছে ভোক্তাকে।
এর আগে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ডিম আমদানির অনুমতি দিলেও দর কমেনি, উল্টো বেড়েছে। গত সপ্তাহে প্রায় আড়াই লাখ পিস ডিম আমদানি হলেও তার প্রভাব পড়েনি বাজারে।
তেজগাঁও পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্যার কারণে অনেক খামার নষ্ট হয়েছে। এর প্রভাব সরবরাহে পড়েছে। তাই দাম বাড়তি। আর ভারত থেকে সম্প্রতি যে ডিম এসেছে, তা রাজধানীর বাজার পর্যন্ত পৌঁছায়নি। এ ছাড়া চাহিদার বিপরীতে এ ডিম খুবই কম। তাই বাজারে আমদানির প্রভাব পড়েনি।
এদিকে মুরগির বাজারের চিত্রও একই। রাজধানীর খুচরা বাজারে কোনো কোনো দোকানে ব্রয়লারের কেজি ১৯৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। তবে বেশিরভাগ দোকানে ১৯০ টাকা বিক্রি হয়েছে। অথচ, নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী বিক্রি হওয়ার কথা ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে ভোক্তাদের ১০ টাকা ৪১ পয়সা বেশি গুনতে হচ্ছে। যেখানে গত সপ্তাহেও ব্রয়লারের কেজি ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা বিক্রি হয়েছে। নির্ধারিত মূল্যের বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে সোনালি মুরগিও।
শুধু দাম নির্ধারণ করলেই হবে না, সেটির বাস্তবায়নও নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, আগেও বিভিন্ন পণ্যের দাম বেঁধে দিতে দেখা গেছে। কিন্তু বাস্তবায়ন হতে দেখিনি। তাই যৌক্তিক মূল্যে বিক্রি হচ্ছে কি না, ভোক্তারা সে দামে পাচ্ছে কি না, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। মূল্য বাস্তবায়নে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করতে হবে। এ ছাড়া সরকার যে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারণ করছে, সেটা কতটা সঠিক, সেটাও যাচাই করা প্রয়োজন।
এদিকে প্রান্তিক খামারিরা বলেছেন, বিক্রয় মূল্য বেঁধে দেওয়ার আগে সরকারকে উৎপাদন পর্যায়ে খরচ কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। নইলে যতই উদ্যোগ নেওয়া হোক না কোনো, সুফল মিলবে না।
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, উৎপাদন খরচ কমানোর সুযোগ রয়েছে। ফিড ও একদিনের বাচ্চার বাজারে করপোরেটদের যে সিন্ডিকেট রয়েছে, তা ভেঙে দিয়ে এগুলোর যৌক্তিক মূল্য বেঁধে দিতে হবে আগে। খামারিরা এগুলো যৌক্তিক দামে পেলে ডিম ও মুরগির দাম এমনিতেই কমে আসবে। এটা না করে ডিম-মুরগির দাম যতই নির্ধারণ করা হোক, কাজে আসবে না।
সুমন আরও বলেন, প্রান্তিক খামারিদের বাদ দিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বরাবরই বড় খামারি বা করপোরেট সংগঠনগুলো থেকে তথ্য নেয় এবং তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়। এতে সঠিক ও প্রকৃত তথ্য উঠে আসে না। আমরা বারবার বলে আসছি, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারিদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে। না হয় প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে না।
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.