এইমাত্র পাওয়া

অভিযোগ প্রমাণিত, তবুও বহাল তবিয়তে মাদ্রাসা সুপার

ফরিদপুরঃ জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার হিদাডাঙ্গা মোমেনা সুফিনাজ দাখিল মাদ্রাসার সুপারের বিরুদ্ধে নানা অজুহাতে ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট থেকে অবৈধভাবে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া মনগড়া ম্যানেজিং কমিটি বানিয়ে মিটিং ছাড়াই ভুয়া রেজুলেশন তৈরি করে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য, শিক্ষকদের টাইমস্কেলের নামে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।

এর আগেও তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির নানা অভিযোগ তদন্তসাপেক্ষে প্রমাণিতও হয়েছে। এরপরও অদ্যাবধি স্বপদে বহাল তবিয়তে মাদ্রাসা সুপার মো. নুরুল ইসলাম।

এদিকে মাদ্রাসা সুপারের এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ডুবতে বসেছে প্রতিষ্ঠানটি। এক সময় পরীক্ষা কেন্দ্র হিসেবে অনুমতি পেলেও সেটি বাতিল করা হয়েছে। মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরা সুপারের আচরণে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এসব ব্যাপারে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি ভুক্তভোগীদের।

এলাকার জনহিতৈষী সমাজসেবক ডা. সৈয়দ আসাদুজ্জামান ও তার ভাই সৈয়দ আবুল খায়েরের একান্ত প্রচেষ্টায় ১৯৮৬ সালে প্রায় এক একর জমির উপর গড়ে উঠে প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৮৯ সালে মাদ্রাসাটি সরকারের এমপিওভুক্তির স্বীকৃতি পায়। আর তার আগে ১৯৮৬ সালে সহ-সুপার পদে এখানে যোগদান করেন মো. নুরুল ইসলাম। এ সময় তিনি সাগের শাহ্ কাটাগড় দাখিল মাদ্রাসায় ইবতেদায়ি প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এই দ্বৈত পদে দায়িত্ব পালনকালেই ১৯৮৮ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি হিদাডাঙ্গা মাদ্রাসার সুপার হন। ৮ বছর দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারি বেতন গ্রহণের পর ১৯৯৬ সালে তিনি সাগের শাহ্ কাটাগড় দাখিল মাদ্রাসায় ইবতেদায়ি প্রধানের পদ থেকে ইস্তফাপত্র দাখিল করেন।

মাদ্রাসাটির একাধিক শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ সুপার মো. নুরুল ইসলামের অবিরত অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটি ডুবতে বসেছে। তারা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গত ১৩ মে ওই মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির তিনজন সদস্য এবং গ্রামবাসী পৃথকভাবে সুপারের বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ দেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে।

সেখানে উল্লেখ করা হয়, কিছুদিন পূর্বে সুপার মাদ্রাসার অফিস সহকারী, গেটম্যান ও আয়া পদে অর্থের বিনিময়ে কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এখন তিনি সহ-সুপার, কম্পিউটার শিক্ষক ও নৈশপ্রহরী পদে নিয়োগ দিয়ে আবারও টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ম্যানেজিং কমিটির মিটিং না করেই তিনি মনগড়া রেজুলেশন তৈরি করে পরবর্তীতে সদস্যদের সই-স্বাক্ষর নিয়ে একইভাবে সবকিছু করছেন। কমিটির সদস্যদের থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর গ্রহণসহ নানা অভিযোগ স্বীকার করে সুপার নুরুল ইসলামের স্বহস্তে লেখা একটি মুচলেকাও পাওয়া গেছে, যা তিনি সাবেক সভাপতি প্রায়ত ডা. সৈয়দ আসসাদুজ্জামানের কাছে জমা দিয়েছিলেন।

মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য মো. জালাল শেখ বলেন, তিনি নিয়োগের মিটিংয়ে ছিলেন না। পরে বলছেন যে, নিয়োগের মিটিং হইছে। এরপর সুপার সহস্রাইল বাজার থেকে তার স্বাক্ষর নিয়েছেন। এ ছাড়া শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যেই রেজুলেশন করছে সেই মিটিংও হয় নাই।

মো. জামাল বিশ্বাস নামে আরেকজন সদস্য বলেন, এই মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির কোনো নির্বাচন হয়নি। সিলেকশনে তিনি সদস্য হয়েছেন। মাদ্রাসার মিটিংয়ে অনেক সময় তাকে ডাকে না। যখন ডাকে না তখন বাড়িতে গিয়ে স্বাক্ষর নিয়ে আসেন সুপার। এই যে কয়েকদিন আগে নিয়োগ সার্কুলার দিয়েছেন সে বিষয়েও আমাকে জানাননি।

মো. নজরুল মন্ডল নামে অপর এক সদস্য বলেন, সুপার কখনো তাদের মিটিংয়ে ডাকেন না। কোনো কাজে তিনি আমাদের জানেন না। নিজেই মিটিংয়ের রেজুলেশন করে পরে সই-স্বাক্ষর করে নেন। তার ব্যাংক হিসাবে আগে কত টাকা জমা ছিল আর এখন কত টাকা আছে তা দেখলেই সব প্রমাণ মিলবে। আর আমাদের সভাপতি মাদ্রাসায় আসেন না। ঢাকায় গিয়ে তার স্বাক্ষর নিয়ে আসেন সুপার।

মাদ্রাসার সহকারী মৌলানা মো. লুৎফর রহমান, সহকারী শিক্ষিকা আফরোজা খানম ও সহকারী শিক্ষক জাকারিয়া শিকদার অভিযোগ করেন, তাদের নিকট থেকে মাদ্রাসার সুপার টাইমস্কেলের করানোর জন্য কারও কাছে ৩৫ হাজার, আবার কারও কাছ থেকে ২০ হাজার করে টাকা নেন। তার অন্যায়-অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় তিনি দু’জন শিক্ষকের নামে মিথ্যা, মনগড়া অভিযোগ করে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য একটি ভুয়া রেজুলেশন তৈরি করেন।

সরেজমিনে পরিদর্শনকালে মাদ্রাসায় উপস্থিত ছাত্রছাত্রীরা সুপারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন। কয়েকজন দাখিল পরীক্ষার্থী বলেন, তাদের কাছ থেকে ফরম পূরণে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়েছে। নির্বাচনী পরীক্ষায় ফেল দেখিয়ে প্রতি বিষয়ের জন্য ৫০০ টাকা করে নিয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ, তাদের শ্রেণিকক্ষে বিদ্যুতের সুইচগুলো নষ্ট। ফ্যান চলে না। অথচ মাসে মাসে তাদের কাছ থেকে এসবের জন্য টাকা নেওয়া হয়। স্কুলের টিনের চালে অসংখ্য ছিদ্র। বৃষ্টি এলে মাদ্রাসা ছুটি দিয়ে দেয়। শ্রেণিকক্ষগুলো অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন। ভাঙা বেঞ্চ ও চেয়ারটেবিল গাদা করে রাখা হয়েছে ক্লাস রুমের মধ্যেই। মাদ্রাসার তিনটি বড় বড় টিনের ঘর পরিত্যক্ত অনেক দিন। প্রধান ফটকটি দীর্ঘদিন অকেজো থাকলেও সেটি সারানো হয় না। এসব ছাত্রছাত্রীরা ক্ষোভের সঙ্গে জানান, তারা সকলেই গরিব ঘরের ছেলেমেয়ে। অথচ মাদ্রাসার সুপার টাকা ছাড়া তাদের কোনো কাজই করেন না। তাদের সাথে খুবই দুর্ব্যবহার করেন।

মাদ্রাসার বিভিন্ন শিক্ষক, অভিভাবক ও সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাদ্রাসা শুরু থেকে এ পর্যন্ত আয় ব্যয়ের কোনো হিসাব দেখানো হয়নি। ম্যানেজিং কমিটি গঠনে ঝামেলা রয়েছে। নিয়োগগুলো অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে করা হচ্ছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ার বাছাই কমিটির কোনো মিটিং হয় না। মাদ্রাসাটিতে ফরম পূরণ, রেজিস্ট্রেশন, জন্মসনদ, প্রত্যয়নপত্র ইত্যাদি খাতের টাকা রশিদে জমা নেওয়া হয় না। বর্তমান কারিকুলাম অনুযায়ী, মাদ্রাসাটির শ্রেণিকক্ষ উপযোগী নয়। শ্রেণিকক্ষে উপকরণের অভাবে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুপার মো. নুরুল ইসলাম মিলু বলেন, শিক্ষকদের কাছ থেকে টাইমস্কেলের নামে টাকা আদায় এবং নিয়োগের টাকা গ্রহণের অভিযোগ সঠিক নয়। কমিটির মিটিং না করেই সভার রেজুলেশন তৈরির অভিযোগ সঠিক নয়। নিয়োগ কমিটির সভার রেজুলেশনে যাদের স্বাক্ষর রয়েছে তারা সকলেই উপস্থিত ছিলেন। সভাপতি সাহেব নিজেও ওই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন।

এ ব্যাপারে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. মোজাম্মেল হক বলেন, মাদ্রাসার সর্বশেষ নিয়োগ প্রক্রিয়ার আবেদনগুলো পর্যালোচনা করে কিছু অসঙ্গতি দেখা গেছে। এজন্য নিয়োগ প্রক্রিয়াটি বাতিল করে আবারও নতুন করে সার্কুলার দিয়ে নিয়োগ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া মাদ্রাসার অবকাঠামোর যে সকল সমস্যা রয়েছে সে ব্যাপারে মাদ্রাসাটির অনুকূলে এ পর্যন্ত কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আর কি কি খাতে তা ব্যয় করা হয়েছে সেগুলোও দেখব। এর আগেও সুপারের ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে একাধিক অভিযোগের নথি আমাদের হাতে এসেছে যাতে সে দোষী প্রমাণিত, সেগুলিও আমরা খতিয়ে দেখব, এরপর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ইতোপূর্বে আরও যেসব অভিযোগ সুপারের বিরুদ্ধে

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এর আগে ২০০১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সাতজন সদস্য, ২০০৩ সালের ২৪ আগস্ট ম্যানেজিং কমিটির পাঁজন সদস্য এবং ২০০৬ সালের ২২ জুলাই মাদ্রাসার দাতা সদস্য ডা. সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুপার মো. নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে একের পর এক লিখিত অভিযোগ দেন। দাতা সদস্য ডা. সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুপারের বিরুদ্ধে তিনি আটটি অভিযোগ উত্থাপন করেন। দীর্ঘ তদন্ত ও শুনানি শেষে ওই বছরের ২৬ নভেম্বর তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অরুণ চন্দ্র মহোত্তম লিখিত প্রতিবেদন দেন। তিনি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ম্যানেজিং কমিটি গঠনে কর্তৃপক্ষের আদেশ লঙ্ঘন, অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতির দায় এবং সুপারের অদক্ষতার কারণে বেসরকারি মাদ্রাসা শিক্ষকের চাকরি বিধি ১৯৭৯ এর ১১ নং অনুচ্ছেদের চ, ছ, জ ধারা মোতাবেক সুপার মো. নুরুল ইসলামের এমপিওভুক্তি বাতিলসহ তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হলো।

অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হয়, নুরুল ইসলাম তৎকালীন সহ-সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে সুপার হন। সরকারি বিধি অনুযায়ী, একই ব্যক্তি একাধিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকতে পারেন না। যা সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত ও অবৈধ ছিল। মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত করার জন্য তিনি শিক্ষকদের কাছ থেকে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকাও গ্রহণ করেন যার কোনো হিসাব তিনি দেখাতে পারেননি। এভাবে প্রতিষ্ঠানটির হাজার হাজার টাকা তিনি খরচ করে কাঁচা ভাউচারের মাধ্যমে সহ-সভাপতির স্বাক্ষর দেখালেও পরবর্তীতে সহ-সভাপতি জানান যে, তিনি এসব স্বাক্ষর করাননি। এসব আয়-ব্যয়ের খরচ তিনি ম্যানেজিং সভায় তা কখনোই পাস করাননি। মাদ্রাসায় অনুপস্থিত থেকেও তিনি দীর্ঘদিন হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন।

অপরদিকে, সুপার মো. নুরুল ইসলাম এবং মাদ্রাসার সহ-সভাপতি সৈয়দ আবুল খায়েরের বিরুদ্ধে অভিযোগটি তদন্ত করে তৎকালীন সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ মতামত দেন যে, সুপার মো. নুরুল ইসলাম জালিয়াতি করে ভুয়া দলিলের মাধ্যমে মাদ্রাসার সহ-সভাপতিকে হয়রানির চেষ্টা করেছেন।

দেখা গেছে, সুপারের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেই তার বিরুদ্ধে মনগড়া রেজুলেশন তৈরি করে খড়গ চালান সুপার নুরুল ইসলাম। সভাপতি কার্যত ঢাকায় থাকেন। তাকে নানাভাবে ভুল বুঝিয়ে এখন সুপার নিজেই সর্বেসর্বা প্রতিষ্ঠানটির।

সর্বশেষ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দাবি, এই স্বেচ্ছাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ সুপারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা হোক। সুত্রঃ কালবেলা

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০১/০৬/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.