ফিরোজ আলম:
মাদ্রাসা শিক্ষকদের বদলী নীতিমালা প্রণয়নে কর্মশালা আগামী ১৮ ই এপ্রিল বৃহস্পতিবার।শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলির জন্য নীতিমালা তৈরি করছে সরকার। আর এই বদলী নীতিমালা প্রণয়নে কর্মশালার আয়োজন করেছে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি প্রথা অত্যাবশ্যক সন্দেহ নাই।এটি কার্যকর হলে অনেক শিক্ষকের খরচ যেমনি সাশ্রয় হবে,পরিবারের সাথে বাস করার সুযোগ ও তৈরি হবে। কোন সন্দেহ নাই, পেশাগত গতি বৃদ্ধি করতে , দীর্ঘ সময় ধরে এক জায়গায় চাকুরি করার কারনে একর্গুঁয়েমি দূর করতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রুপিং বন্ধ করতে, পরিবার পরিজনের কাছাকাছি থাকতে, শিক্ষকদের মানসিক প্রশান্তি ধরে রাখতে ও অল্প বেতনের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আর্থিক সাশ্রয়ের জন্য বদলি প্রথা জরুরি দরকার এবং অত্যাবশ্যক।
বদলির সুফল:
১.অল্প বেতনে দীর্ঘ সময় ধরে নিজ এলাকা ছেড়ে দূর- দূরান্তে চাকরি করার ফলে শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক বিষন্নতা ও হতাশা কাজ করে।তাই শিক্ষা কাঠামোর উপর হতাশা এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় স্থবিরতার প্রভাব দূর করতে বদলী প্রথা সময়ের দাবী।
২. শিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নয়নে শিক্ষকদের সন্মানবোধ জরুরী।বদলী প্রথা সরকারি শিক্ষকদের ন্যায় সন্মানের প্রতীক।তাই বদলি প্রথা অতীব জরুরি ।
৩.শিক্ষকদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় চাহিদা ছাড়া
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চার হবেনা।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা যে সরকারি বেতন এবং সামান্য বাড়ি ভাড়াসহ সুবিধা পান তাতে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় চাহিদাতো মিটেই না ; তদুপরি সংসার চালানোর মৌলিক খরচ মেটাতে ও তাদেরকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় নিজ এলাকায় বদলীর সুযোগ থাকলে চাকুরীর পাশাপাশি বাড়ি ভাড়ার খরচ যেমনি বাঁচবে ,তেমনি পারিবারিক কাজ- কর্ম করলেও আর্থিক স্বাবলম্বী হওয়ার পথ তৈরি হবে।বর্তমানে একজন শিক্ষকের বাড়ি ভাড়া সর্বনিম্ন ৪০০০ টাকা থেকে ২০০০০ টাকা পর্যন্ত। সরকার শিক্ষকদের দেয় বাড়ি ভাড়া বাবদ মাত্র ১০০০ টাকা।
এমতাবস্থায় বদলী প্রথা সময়ের দাবী
৪.বর্তমানে মেধাবীরা শিক্ষকতার পেশায় কম ঝুঁকছে। কারণ বর্তমানে শিক্ষকদের সকল পেশার চাইতে শিক্ষকতা পেশায় সুযোগ সুবিধা কম।শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা নিয়ে ২০১৩ সালে গবেষণা করে ভার্কি ফাউন্ডেশন। গবেষণায় দেখা যায়, এশিয়ার দেশগুলোর সমাজ কাঠামোয় বিশেষ করে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরে শিক্ষদের বৃহৎ সম্মানের চোখে দেখা হয়। চিনাদের মধ্যে ৫০ ভাগ বাবা-মা তাদের বাচ্চাদের শিক্ষক হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেন।আমেরিকায় শতকরা ৩০ ভাগ বাবা-মা শিক্ষক হতে উৎসাহ দেন। কিন্তু এদেশে মাত্র ৫ ভাগ পিতা-মাতা সন্তানদের শিক্ষক হতে উৎসাহ দেন।এ সংখ্যাটা আগের তুলনায় এখন বাড়ছে।
সম্প্রতি Center for Educational Research রিসার্চ নামের একটি শিক্ষা গবেষণা মূলক প্রতিষ্ঠানের ৩৫৫ জন গার্ডিয়ানদের এক জরিপে জানা যায় শতকরা ৬৫ ভাগ বাবা-মা এবং তাদের সন্তানরা চান না শিক্ষকতা পেশায় যেতে। এদের মধ্যে বেশিরভাগের ইচ্ছা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বিসিএস ক্যাডার(প্রশাসনিক কর্মকর্তা)র দিকে। তাদের মাঝে শতকরা ৩০ ভাগ এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি কিংবা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করছেন। শুধুমাত্র শতকরা ৩ ভাগ বাবা-মায়েরা এবং তাদের সন্তানরা চান শিক্ষক হতে। শিক্ষক হতে না চাওয়ার কারণ হিসেবে তারা দেখিয়েছেন সমাজের শিক্ষকদের মর্যাদা হ্রাস এবং আর্থিক অনিশ্চয়তা।ফলে এইসব অনিশ্চয়তা মেধাবীদের শিক্ষকতায় আনতে পারছে না। শিক্ষকদের এ অনিশ্চয়তা দূর করতে বদলী আবশ্যক।
তবে খেয়াল রাখতে হবে বদলী প্রথায় বৈষম্য রাখা যাবেনা।কেউ পাবে কেউ পাবেনা যাতে তা না হয়।সকলকে সুযোগ থাকলে একবারের জন্য হলেও নিজ পছন্দের প্রতিষ্ঠানে বদলীর সুযোগ দিতে হবে।
বদলী প্রথার কুফল:
মনে রাখতে হবে বদলি প্রথার পর কিছু সমস্যা ও শুরু হবে।
ক• ধরে নিলাম একজন শিক্ষক যে প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন তার চাকুরীর বয়স আট বছর পূর্ণ হওয়ার সুবাদে তিনি জৈষ্ঠ্যতার ভিত্তিতে ঐ প্রতিষ্ঠানে সহকারি অধ্যাপক/জৈষ্ঠ্য প্রভাষক হয়েছিলেন।কিন্তুু যে প্রতিষ্ঠানে তিনি বদলি হবেন সে প্রতিষ্ঠানে তার থেকে বেশি সময় ধরে চাকরি করা আরেকজন প্রভাষক ১:১ ঘৃনিত প্রথা চালু থাকায় সহকারি অধ্যাপক/জৈষ্ঠ্য প্রভাষক হতে পারেনি।ফলে আগের প্রতিষ্ঠানে দশ বছর চাকরি করে তিনি যদি তার থেকেও বেশি চাকরি করা কিন্তু সহকারি অধ্যাপক /জৈষ্ঠ্য প্রভাষক থেকে বঞ্চিত শিক্ষকের প্রতিষ্ঠানে আসেন তাহলে সেটি অগ্রহনযোগ্য হবে সন্দেহ নাই।
অন্যদিকে এটি জনবল কাঠামো ২০২০(সংশোধিত) এবং আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রবিধান ২০২০ এর আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হবে।জনবল কাঠামো ২০২০(সংশোধিত) ও আরবি বিশ্ব: প্রবিধান ২০২০(সংশোধিত) মতে প্রভাষকদের মধ্যে ৮ বছর পূর্ণ হওয়া প্রভাষক গন ১:১ প্রথা অনুযায়ী সহকারি অধ্যাপক/জৈষ্ঠ্য প্রভাষক হবেন।ফলে বদলি প্রথা চালুর আগেই ১:১ প্রথা বাতিল বাতিল করে সকল প্রভাষকের জন্য ৮ বছর ফূর্তিতে সহকারি অধ্যাপক/জৈষ্ঠ্য প্রভাষক প্রথা চালু রাখতে হবে।।
খ• বদলি প্রথা চালু হলে মফস্বল এলাকার অনুন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা আর্থিক সুবিধার আশায় ভাল প্রতিষ্ঠানে চলে যাবেন বা যাওয়ার চেষ্টা করবেন।এই ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী পরিবারের শিক্ষকরা অনেক এগিয়ে থাকবেন।অন্যদিকে অনুন্নত প্রতিষ্ঠানে কোন শিক্ষক যেতে চাইবেন না, তাদের কে সেখানে দেওয়া হলেও তিনি মন দিয়ে কাজ ও করবেন না।
কারন সেখানে আর্থিক সুবিধা কম।ফলে এক সময় ভাল শিক্ষক এবং ভাল তদারকির অভাবে ঐ মফস্বলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ পিছিয়ে পড়বে সন্দেহ নাই।তাই বদলি প্রথার আগেই বাড়ি ভাড়া ও আর্থিক সুবিধা সরকারি শিক্ষকদের ন্যায় নিশ্চিত করা জরুরি।
গ• বদলি প্রথা চালু হলে সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহ তার গুনগত মান হারাতে পারে। সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহ কোন বিষয়ে কোন শিক্ষক কত দক্ষ সে অনুযায়ী বিষয় বন্টন হয় এবং লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঐ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিক্ল্পনা ঠিক করে।এখন বদলি প্রথা চালু হলে কম দক্ষ শিক্ষক যিনি হয়ত ভাল প্রশিক্ষন পান ই নাই,তিনি সেরা প্রতিষ্ঠানে বদলি হলে ঐ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার গুনগত মান হুমকির মুখে পড়বে।
তাই বদলি প্রথার আগে শিক্ষকদের গুনগত মান ও প্রশিক্ষন বাধ্যতামুলক এবং জরুরী।
ঘ• বদলি প্রথা চালু হলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা নিজেদের পছন্দের স্থান বিশেষ করে নিজ এলাকায় কিংবা শহর এলাকায় যেতে চাইবে।কারন সেখানে চাকরির পাশাপাশি স্থায়ীভাবে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার কোন পথ তৈরি হবে।এভাবে একসাথে দুই কাজে মনযোগ দিলে এতে শিক্ষার গুনগত মান হুমকির মুখে পড়বে।অন্যদিকে শিক্ষক যেখানে বদলি হতে চায় তাকে সেখানে না দিয়ে দূরে কোথাও দিলে তার মনক্ষুন্নভাব ও তৈরি হবে।
তাই সরকারি শিক্ষকদের ন্যায় বদলির আগে আর্থিক সুবিধা নিশ্চিতের জন্য মাদ্রাসাসহ এমপিওভুক্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করন জরুরি।
ঙ• বদলি প্রথা চালু হলে মাদ্রাসা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।কারন সারাদেশে কোটা প্রথা বন্ধ হলে ও বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ এবং ২৯ নং অনুচ্ছেদ লংঘন করে মাদ্রাসাতে এখনো কোটা প্রথা চালু আছে প্রিন্সিপাল, ভাইস প্রিন্সিপাল ও সুপার নিয়োগে।এর ফলে অযোগ্য সুপার, প্রিন্সিপাল, ভাইস প্রিন্সিপ্যাল এর অধীনে চাকরি করা যোগ্য , সুযোগ্য জেনারেল শিক্ষকরা স্কুল- কলেজে চলে যাবেন।
কারন মাদ্রাসাতে কোটা প্রথার কারনে যেমনি জেনারেল শিক্ষকরা প্রশাসনিক পদে যেতে পারবেন না, তেমনি ১: ১ প্রথার কারনে পদান্নতি থেকে ও বঞ্চিত হবেন।তাই তারা স্কুল- কলেজে চলে গেলে মাদ্রাসা শিক্ষা তলানিতে পৌছবে।উল্লেখ্য যে বর্তমানে আরবি বিষয়ের তুলনায় মাদ্রাসাতে জেনারল বিষয় ই বেশি। অন্যদিকে দেশে অসংখ্য স্কুল- কলেজ জাতীয়করন হলেও মাদ্রাসা একটি ও জাতীয়করন হয়নি।হওয়ার সম্ভাবনা ও ক্ষীণ।
কারন মাদ্রসার দুটি শিক্ষক সংগঠন জাতীয়করন প্রশ্নে বিভক্ত।জমিয়াতুল মোদার্রেসিন (হুজুরদের সংগঠন) জাতীয়করন প্রশ্নে নীরব অন্যদিকে মাদ্রাসা জেনারেল টিচার্স এসোসিয়েশন জাতীয়করন প্রশ্নে সরব এবং আন্দোলনে সক্রিয়।তাই বদলি প্রথার আগে সকল এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করন জরুরি
তাই বলব এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি শিক্ষার এবং শিক্ষকদের উৎকর্ষতা সাধনে কার্যকর ঔষধ হিসেবে কাজ করবে সন্দেহ নাই।তাই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য বদলি প্রথা চালু আজ সময়ের যৌক্তিক দাবি।কিন্তু বদলি প্রথা চালু করার আগে উপরিউক্ত সমস্যা সমাধান ও অপরিহার্য।বদলি প্রথা চালুর আগে উপরে উল্লেখিত সমস্যার সমাধান না করলে মহাসংকটে পড়তে পারে শিক্ষার গুনগত মান।
লেখক-শিক্ষাবিদ ও কলামিষ্ট
ফিরোজ আলম, বিভাগীয় প্রধান,আয়েশা (রা:) মহিলা কামিল (অনার্স,এমএ) মাদ্রাসা, সদর, লক্ষীপুর।
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.