শবে কদরে ভুলেও বাদ দেবেন না যেসব আমল

ঢাকাঃ লাইলাতুল কদর। মহিমান্বিত এক রাত। পুরো রমজানের মূল আকর্ষণ হলো শবে কদর। এ রাতকে ঘিরেই সবকিছু। কেননা মহিমান্বিত এ রাতেই মহান আল্লাহ বান্দার মুক্তির জন্য নাজিল করেছেন কোরআনুল কারিম। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আমি একে অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। (সুরা দুখান: ৩)।

পবিত্র কোরআনের সুরাতুল কদরে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি কি জানেন, লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাতে ফেরেশতারা ও জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর নির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করেন। এ রাতের ফজর পর্যন্ত প্রশান্তি বর্ষিত হয়। (সুরা কদর: ১-৫)

হাজার মাসের চেয়ে উত্তম অর্থ শুধু যে একহাজার মাসের চেয়ে উত্তম-বিষয়টি এমন নয়, বরং অনেক বেশি বোঝাতেও হাজার শব্দটা ব্যবহার করা হয়। তারপরও আমরা যদি এখানে শুধু এক হাজার মাসই ধরি এর সময় দাঁড়ায় ৮৩ বছর ৪ মাস। তার মানে ৮৩ বছর ৪ মাস পর্যন্ত ইবাদত করার যে ফজিলত বা সওয়াব পাওয়া যায় তা এই এক রাতের ইবাদতেই মহান আল্লাহ প্রদান করে থাকেন।

এই রাতকে ‘লাইলাতুল কদর’বলার কারণ হচ্ছে, এ রাতের পূর্বে আমল না করার কারণে যাদের কোনো সম্মান মর্যাদা, মূল্যায়ন ছিল না তারাও তওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে এ রাতে সম্মানিত ও মহিমান্বিত হয়ে যান। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন) রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে ইবাদতের মধ্যে রাত জাগবে, তার আগের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি: ৩৫)

রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেন, এ মাসে (রমজানে) এমন একটি রাত আছে, যা হাজার রাতের চেয়ে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে সত্যিই বঞ্চিত হলো। (সুনানে নাসায়ি: ২১০৮)

রাতটির এত বড় মর্যাদার কারণ হলো— এ রাতেই পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আমি একে অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। (সুরা দুখান: ৩)

শবে কদরের কিছু মাসনুন আমল এখানে তুলে ধরা হলো—

১. পরিচ্ছন্ন হওয়া: লাইলাতুল কদরের বরকত লাভের প্রধান শর্ত হলো ভেতর ও বাইরের পবিত্রতা লাভ এবং একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়া। আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলি বলেন, উত্তম হলো- যে রাতে কদর অনুসন্ধান করা হবে, তাতে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, গোসল-সুগন্ধি-উত্তম কাপড়ের মাধ্যমে সৌন্দর্যবর্ধন করা। আর বাহ্যিক সৌন্দর্য সৌন্দর্যের জন্য যথেষ্ট নয়, যদি না মানুষের ভেতরটা সুন্দর হয়। মানুষের ভেতর সুন্দর হয় তওবা ও আল্লাহমুখী হওয়ার মাধ্যমে। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা- ১৮৯)

২. মাগরিব, ইশা ও ফজর নামাজ জামাতে আদায় করা: কদরের রাতে মাগরিব, এশা ও ফজর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা উচিত। তাহলে হাদিস অনুযায়ী শবে কদরের ফজিলত লাভ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি এশা ও ফজর জামাতের সঙ্গে পড়ে, সে যেন সারা রাত দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে।’ (মুসলিম: ৬৫৬)

৩. রাত জেগে ইবাদত: সারারাত নিজে ইবাদত-বন্দেগি করা এবং পরিবারের সবাইকে ইবাদত করার জন্য জাগিয়ে দেওয়া। বছরের অন্য কোনোরাতে সারারাত জেগে ইবাদত করার ব্যাপারে এত বেশি গুরুত্ব নবীজির জীবনীতে দেখা যায় না। সাধারণত তিনি এশার নামাজের পরে বেশি দেরি করতেন না, দ্রুত ঘুমিয়ে যেতেন এবং মধ্যরাতে জেগে ইবাদত করতেন। কিন্তু শবে কদরে তিনি সারারাত জেগে ইবাদত করতেন এবং পরিবারের অন সদস্যদেরও উদ্বুদ্ধ করতেন। আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন, ‘যখন রমজানের শেষ ১০ রাত আসত, তখন নবী কারিম (স.) কোমরে কাপড় বেঁধে নেমে পড়তেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত জেগে থাকতেন। আর পরিবার-পরিজনকেও তিনি জাগিয়ে দিতেন।’ (বুখারি: ১০৫৩)

৪. কোরআন তেলাওয়াত করা: পবিত্র কোরআনের তেলাওয়াত কদরের রাতের বিশেষ আমল। কেননা এই রাতেই কোরআন নাজিল হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আমি কোরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে।’ (সুরা কদর: ১)

পুরো রমজানজুড়েই কোরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব রয়েছে। হাদিসে এসেছে, জিব্রাইল (আ.) প্রত্যেক রমজানে নবীজির সাথে কোরআন তেলাওয়াতে অংশ নিতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রমজান মাসের প্রতি রাতে জিব্রাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে উপস্থিত হতেন এবং তাঁরা উভয়ই পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করে একে অপরকে শোনাতেন।’ (বুখারি: ৬) সুতরাং রমজানের শেষ দশকে বিশেষ করে বিজোড় রাতগুলোতে আমরা যেন বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করি এবং শবে কদরে কোরআন তেলাওয়াতের মতো আমল মিস না করি।

৫. কিয়ামুল্লাইল করা: রমজানের শেষ দশকের বিশেষ ইবাদতের নাম কিয়ামুল্লাইল। কেননা এর সঙ্গে শবে কদরের সম্পর্ক রয়েছে। একারণেই কিয়ামুল্লাইল শব্দটির সঙ্গে কদর শব্দটি জুড়িয়ে দিয়েছেন রাসুলুল্লাহ (স.)। বুখারির বর্ণনায় তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘কদরের রাতে যে কিয়ামুল্লাইল করে বিশ্বাস নিয়ে এবং নাজাতের প্রত্যাশায়, আল্লাহ তাআলা তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (বুখারি: ১৯০১, ২০১৪; মুসলিম: ১৮১৭)

সুতরাং আমরা যেন কদরের রাতে কিয়ামুল্লাইল বা লম্বা সময় ধরে সালাত আদায় করি। লম্বা সময় দাঁড়িয়ে ক্বেরাত পড়া ও দীর্ঘ সেজদা করা কিয়ামুল্লাইলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নবীজির কিয়ামুল্লাইল সম্পর্কে আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নামাজে দাঁড়িয়ে নবীজি এত দীর্ঘ সময় তেলাওয়াত করতেন যে, তাঁর পা মোবারক ফুলে যেত।’ (দ্রষ্টব্য- সহিহ মুসলিম: ২৮১৯, ২৮২০)

৬. কদরের রাতের দোয়া: আয়েশা (রা.) রাসুলুল্লাহ (স.)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি জানতে পারি লাইলাতুল কদর কোনটি, তাহলে আমি সে রাতে কী বলব? তিনি বলেন, ‘তুমি বলো, উচ্চারণ: ‘আল্লা-হুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী’। অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করাটা আপনার পছন্দ। অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। (সুনানে তিরমিজি: ৩৫১৩)।

সুতরাং সারাদিন-রাত বেশি বেশি এই দোয়া করবেন। এই দোয়াটি হাঁটা-চলা-শোয়া অবস্থায় করা যায়।

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৬/০৪/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Check Also

মাত্র এক মিনিটে করা যায় যেসব আমল

নিউজ ডেস্ক।। অফিস বা কর্মস্থলে ইবাদত-বন্দেগি ও নেক আমলের তেমন সুযোগ-সময় পাওয়া যায় না। অফিসে …