শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ রাজধানীর দনিয়ার এ কে হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক আবু জামিল মো. সেলিমের বেতন স্কেল ২২ হাজার টাকা হলেও তিনি ঈদে বোনাস পাবেন ৫ হাজার ৫০০ টাকা। তাঁর মতোই সারাদেশের এমপিওভুক্ত কয়েক লাখ শিক্ষক আসন্ন ঈদে উৎসব ভাতা বা বোনাস পাবেন মূল বেতনের চার ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ সিকিভাগ।
তবে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা বোনাস পাবেন মূল বেতনের ৫০ শতাংশ। যেমন– রাজধানীর মীরপুর সিদ্ধান্ত হাই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী (দপ্তরি) সুলতান আহমেদের বেতন স্কেল ৮ হাজার ৫০০ টাকা। তিনি ঈদে বোনাস পাবেন এর অর্ধেক; অর্থাৎ ৪ হাজার ২০০ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুই দশকের বেশি আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সারাদেশের প্রায় ৫ লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী নামমাত্র উৎসব ভাতা পাচ্ছেন। তার আগে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারের কাছ থেকে উৎসব ভাতা পেতেন না। ২০০৩ সালের জুলাইয়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ড. এম ওসমান ফারুকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বোনাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওই বছরের অক্টোবরে তা কার্যকর হয়। তখন সিদ্ধান্ত হয়, শিক্ষকদের দেওয়া হবে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ। তবে দুই ঈদে (অথবা পূজায়) ২৫ শতাংশ করে ভাগ করে তা দেওয়া হবে। সেই থেকে প্রতি ঈদে শিক্ষকরা ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা পাচ্ছেন। আর কর্মচারীদের জন্য ওই সভায় শতভাগ বোনাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দুই ঈদে ৫০ শতাংশ করে তা দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত যখন হয় তখন সরকারের কাছ থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ৯৫ শতাংশ বেতন দেওয়া হতো। পরে ২০০৫ সালে সরকার ৫ শতাংশ বাড়িয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতনের শতভাগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়; কিন্তু উৎসব ভাতা বাড়েনি।
শিক্ষকরা জানান, ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মূল বেতনের ৮০ শতাংশ দিত সরকার। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তা ৯০ শতাংশে উন্নীত করে। ২০০৫ সালে চারদলীয় জোট সরকার তা শতভাগে উন্নীতের ঘোষণা দিলেও বাজেটে ৯৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করে। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তা শতভাগে নিয়ে যায়। দেখা যায়, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন স্কেল ধাপে ধাপে শতভাগে উন্নীত হলেও, উৎসব ভাতা বাড়েনি।
আগের সেই নিয়মে এবারও ঈদুল ফিতরে ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা পাচ্ছেন বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। তবে এবার ঈদের আগেই তারা তা হাতে পাবেন। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এরই মধ্যে উৎসব ভাতা চূড়ান্ত করেছে। এবার ৩০ হাজারের বেশি এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীকে ২৪০ কোটি টাকা উৎসব ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে এপ্রিল মাসের বেতন হিসাবে তারা পাবেন ৭৮৩ কোটি ৫১ লাখ ৪ হাজার ৭৫০ টাকা।
মূল বেতনের ২৫ শতাংশ বোনাস পাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে কলেজের অধ্যক্ষদের বেতন স্কেল ৫০ হাজার টাকা, উপাধ্যক্ষ ও উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের অধ্যক্ষদের ৪৩ হাজার টাকা, সহকারী অধ্যাপকের ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা, টাইম স্কেলপ্রাপ্ত প্রভাষক ও স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ২৯ হাজার টাকা, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের ২৩ হাজার টাকা, প্রভাষক/গ্রন্থাগারিক, সহকারী শিক্ষকদের (টাইম স্কেলপ্রাপ্ত) ২২ হাজার টাকা, প্রদর্শক/সহকারী গ্রন্থাগারিক/শরীরচর্চা শিক্ষক/সহকারী শিক্ষকদের (টাইম স্কেল ব্যতীত) ১৬ হাজার টাকা এবং সহকারী শিক্ষকদের (বিএড ব্যতীত) ১২ হাজার ৫০০ টাকা।
অন্যদিকে, ৫০ শতাংশ বোনাস পেতে যাওয়া কর্মচারীদের মধ্যে টাইম স্কেল পাওয়া তৃতীয় শ্রেণির কর্মীদের বেতন স্কেল ৯ হাজার ৭০০ টাকা, টাইম স্কেল ছাড়া তৃতীয় শ্রেণির কর্মীদের ৯ হাজার ৩০০ টাকা, ল্যাব সহকারীর ৮ হাজার ৮০০ টাকা, টাইম স্কেল পাওয়া চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন স্কেল ৮ হাজার ৫০০ টাকা এবং টাইম স্কেল ছাড়া চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন স্কেল ৮ হাজার ৩৫০ টাকা।
বেসরকারি শিক্ষকদের এই উৎসব ভাতা সম্পর্কে প্রবীণ শিক্ষক নেতা ও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, ‘দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক চাইলে সরকারকে অবশ্যই শতভাগ উৎসব ভাতা দিতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতিতেও শিক্ষকদের বৈষম্য কমিয়ে আনার কথা বলা আছে। সরকারি শিক্ষকরা তিন বছর অন্তর একটি বিনোদন ভাতা পান। অথচ বেসরকারি শিক্ষকদের তা দেওয়া হয় না। তাদেরও ভাতাটি দেওয়া উচিত।’ শিক্ষকদের গবেষণা ভাতা চালুর প্রস্তাব করে তিনি বলেন, ‘যোগ্য লোকদের শিক্ষকতায় এনে ভালো বেতন-ভাতা দিতে হবে। তাহলেই দক্ষ শিক্ষক দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়া যাবে।’
স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু বলেন, ‘শিক্ষকদের ২৫ শতাংশ ঈদ বোনাস দেওয়ার কথাটা শুনতেও খারাপ লাগে! অথচ টাকা খুব বেশি নয়; কারণ বছরে মাত্র দুটি বোনাস।’
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসব-ভাতা সরকারের দেওয়ার কথা নয়। কারণ সরকারের কাছ থেকে তারা অনুদান পান, বেতন-ভাতা নয়। শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা বলে উৎসব ভাতার একটা অংশ সরকারের কাছ থেকে অনেকটা জোর করে এনে বেসরকারি শিক্ষকদের দেওয়া হয়।’
তবে উৎসব ভাতা দিলে পুরোটাই দেওয়া উচিত বলে মনে করেন শিক্ষক নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. শাহজাহান আলম সাজু। তিনি বলেন, ‘বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের শতভাগ উৎসব ভাতা দেওয়ার বিষয়টি সরকারের পরিকল্পনায় আনা উচিত। এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে সমাধান বের করা যেতে পারে। কারণ সরকারের সক্ষমতা বেড়েছে। নানা ইতিবাচক দিকে আমরা এগোচ্ছি।’
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০১/০৪/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.