নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়তলীর ডাঃ ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক স্বপন কুমার নাথ পাঠদানের শর্তে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এক্সটেনশন করলেও একদিন ক্লাস না করেও ২০ হাজার টাকা বেতন নিয়ে কলেজের উপদেষ্টা হিসেবে নানা অপকর্ম করে চলেছেন। কলেজটির ল্যাব সহকারীকে পদত্যাগ পত্র দিতে বাধ্য করা, অর্থ আদায়, অবৈধভাবে দশ কোটি টাকার সম্পদ অর্জন, উপবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলক বেতন আদায়, তথ্য গোপন করে নিজের মেয়েকে উপবৃত্তি দেওয়া, ছাত্রী-সহকর্মীর সাথে যৌন কেলাংকারীসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে স্বপন কুমার নাথের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, কলেজটির ল্যাব সহকারী মোঃ ইসমাইল হোসেন ২০২২ সালের ফেব্রুযারীতে নিয়োগ পেলে এবং নিয়োগ পাওয়ার পর এমপিওভুক্তির জন্য তার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন তৎকালীন উপাধ্যক্ষ স্বপন কুমার নাথ। মোঃ ইসমাইল হোসেন ১৫ হাজার টাকা ব্যবস্থা করে দিতে পারলেও পাঁচ হাজার টাকা দিতে না পারায় স্বপন কুমার নাথের বিভাগভাজন হয়ে পরেন। পরবর্তীতে গত ২২ নভেম্বর ২০২৩ ইং তারিখে অবসরে গিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠনাদের শর্তে (প্রাপ্যতা না থাকলেও) সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে এক্সটেনশন করিয়ে এনে উপদেষ্টা হিসেবে নিজেকে জাহির করেন কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং গভর্নিং বডির সভাপতির যোগসাজসে। এরপর থেকে ল্যাব সহকারী মোঃ ইসমাইল হোসেনকে দিয়ে ল্যাবের বাইরে বাথরুম পরিস্কার করানোর কাজ, টেবিল পরিস্কারের মত কাজ করতে বাধ্য করান। যা ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের অফিস সহায়ক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর দায়িত্ব। এই ল্যাব সহকারী তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন ছাড়া এসব কাজ করতে না চাইলে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করান।
শুধু কর্মচারীদের সাথে বাজে ব্যবহারই নয়, অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক হয়েও কলেজে খুঁটি গেরে বসা স্বপন কুমার নাথের বিরুদ্ধে রয়েছে একই কলেজের নারী সহকর্মীর বিরুদ্ধে নারী কেলেংকারীর মত অভিযোগও।
জানা গেছে, গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীর উপবৃত্তি না দিয়ে নিজের মেয়েকে উপবৃত্তির তালিকায় অন্তভূর্ক্ত করেছেন স্বপন কুমার নাথ। উপাধ্যক্ষ হিসাবে ২০০৯ সালে যোগদান করে, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে তার মেয়ে মন্দিরা নাথ, রোলঃ ২০২, বিএসএস, শিক্ষাবর্ষ ২০১২-১৩। একই কলেজে ছাত্রী হিসাবে উপবৃত্তি পাইয়ে দেন। যেখানে শর্ত হলো শিক্ষার্থীর পিতার জমির পরিমান ০.২ শতকের কম ও বার্ষিক আয় ১ লক্ষ টাকার কম হতে হবে। কিন্তু উপাধ্যক্ষ হিসেবে স্বপনের মাসিক বেতন ছিল সেসময় ৪০ হাজার টাকার ও বেশি ছিল। সে হিসাবে বার্ষিক আয় ৫,০০,০০০ টাকার বেশি। ভূমি আছে ৩০ শতক, ৩ তলা একটি বাড়ি, ঔষধের ফার্মেসী এবং একটা মার্কেট রয়েছে। যার বাজার মূল্য অন্তত ১০ কোটি টাকা।
দশ কোটি টাকার সম্পদ থাকা স্বত্বেও তথ্য গোপন করে উপবৃত্তির তালিকায় স্বপন কুমার নাথের মেয়ে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা বলছে, “সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বা বেতন মওকুফ থাকবে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের অনুকূলে স্কিম ডকুমেন্ট মোতাবেক নির্ধারিত হারে টিউশন ফি বা বেতন দেওয়া হবে। উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনোক্রমেই টিউশন ফি বা বেতন আদায় করা যাবে না।” কিন্তু স্বপন কুমার নাথ ভারপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ থাকাকালীন উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলক বেতন আদায় করেছেন। বেতন আদায়কালে তিনি সভাপতির দোহাই দিয়ে অভিভাবকদের বাধ্য করেছেন বেতন দিতে।
উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎ
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে শুধু মাত্র এমপিওর অংশ প্রাপ্ত হয়েও স্বপন কুমার নাথ চট্টগ্রামে গড়েছেন অন্তত দশ কোটি টাকার সম্পদ। আর এই টাকার কোন বৈধ উৎস নেই। চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর কাট্টলী মোস্তফা হাকিম কলেজ সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে তার ৮ শতক জমি এবং ৬ শতক জমির উপর রয়েছে তিন তলা বাড়ী এছাড়া ঔষদের ফার্মেসী ও একটি মার্কেট রয়েছে চট্টগ্রামের বড় পাইকারী বাজার ও পাহাড়তলী বাজারে। যার বর্তমান বাজার মূল কম করে হলে দশ কোটি টাকার উপরে।
কলেজটির উপদেষ্টা স্বপন কুমারের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি এবং কলেজের সহকারী লাইব্রেরিয়ানের সাথে অবৈধ সম্পর্ক অভিযোগ রয়েছে। সভাপতি ও অধ্যক্ষের আস্তাভাজন হওয়ায় যা সবার মুখে মুখে হলেও বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি তার।
ভালো শিক্ষক যাদের পাঠদানে কলেজের পড়াশোনার মান এবং ফলাফল বৃদ্ধি পায় এমন শিক্ষকদের গভর্নিং বডির আবেদনের প্রেক্ষিতে অবসরের পরেও শর্ত স্বাপেক্ষে পাঠদানের অনুমতি দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু পাঠদানের জন্য এক্সটেনশন করিয়ে এনে পাঠদান না করিয়ে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে আসছে তিনি।
কলেজে কোথায় কে কি করবেন। কে অবসরের যাবেন, কে থাকবেন সব ঠিক করে দেন স্বপন কুমার নাথ।
সাবেক উপাধ্যক্ষ ও সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার নাথ গত ২২ নভেম্বর ২০২৩ ইং তারিখে অবসরে গেলেও তাকে প্রতিষ্ঠানটির পাঠদানের স্বার্থ দেখিয়ে পুনরায় সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে (প্রাপ্যতা না থাকা স্বত্বেও) এক বছরের জন্য এক্সটেনশন করিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডি। তবে পাঠদানের কথা বলে মেয়াদ শেষে অতিরিক্ত এক বছরের জন্য আনা হলেও তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের উপদেষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ হাজার টাকা সম্মানী নিচ্ছেন এবং সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক (পাঠদান করানোর জন্য) হিসেবে ১৫ হাজার টাকা। কলেজটি মূলত তিনিই সব। তার কথায় সবই হয় এখানে।
স্বপন কুমার নাথ কলেজের একাডেমিক ও প্রশাসনিক উপদেষ্টা তা নিজেই চিঠিতে উল্লেখ করেছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তাহমিনা বেগম।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকরির শর্তাবলি সংশোধিত রেগুলেশনে ২০১৯-এর ধারা- ১৫ (ক) তে বলা আছে, কোন শিক্ষকের বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হলে সেদিন থেকেই তিনি অবসরে যাবেন। তবে শর্ত থাকে যে বয়স ৬০ বছর অতিক্রম করলেও গভর্নিং বডি তাকে পাঠদানের স্বার্থে এক্সটেনশন করাতে পারবেন। সেটা শুধু পাঠদানের স্বার্থে। কিন্তু পাঠদানের স্বার্থ দেখিয়ে স্বপন কুমার নাথকে এক্সটেনশন করলেও তিনি কোন ধরণের পাঠদান না করিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের রুমের পাশের চেয়ারে বসছেন কোন ধরণের ক্লাস তিনি নিচ্ছেন না। এই স্বপন কুমার নাথই গভর্নিং বডিকে প্রভাবিত করেই ডিগ্রি (পাস) ৩য় বিভাগ ফলাফল থাকা কম যোগয়তা সম্পন্ন তাহমিনা বেগমকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে সবচেয়ে যোগ্য দেখিয়ে তাকে দায়িত্বে নিয়ে এসেছেন।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বপন কুমার নাথ শিক্ষাবার্তাকে বলেন, আমি এর আগেও শিক্ষাবার্তা’র সাথে কথা বলেছি। এখন আর কোন বক্তব্য দিতে পারব না।
কলেজটির গভর্নিং বডির সভাপতি ডাঃ মোঃ আরিফুল আমীন বলেন, অভিযোগ শুনে এবং শিক্ষাবার্তা’র পত্রিকার নাম শুনেই তিনি পারিবারিক কাজে ব্যস্ত আছে বলেই তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে দেন।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৮/০২/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.