এইমাত্র পাওয়া
মোঃ কাওছার আলী শেখ। ছবিঃ সংগৃহীত

কোটি টাকা দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত বিটিএ সেক্রেটারি কাওছার

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ কোটি টাকার আর্থিক দুর্নীতি, জাল সনদের মাধ্যমে নিজ আত্মীয়কে নিয়োগ প্রদান, এমপিওভুক্তির আশ্বাস দিয়ে অর্থ আদায়, প্রতিষ্ঠানের কাজে সময় না দিয়ে জমি ব্যবসায় নিজেকে ব্যস্ত রাখাসহ একাধিক অভিযোগে রাজধানীর উত্তর যাত্রাবাড়ীর সবুজ বিদ্যাপীঠ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ কাওছার আলী শেখকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটি। নিজেকে অধ্যক্ষ দাবি করা প্রধান শিক্ষক মোঃ কাওছার আলী শেখ বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বিটিএ) এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক।

বরখাস্তের নোটিশ সূত্রে জানা গেছে,  মোঃ কাওছার আলী শেখ  ৩১ মে ২০১২ ইং তারিখ থেকে “সবুজ বিদ্যাপীঠ উচ্চ বিদ্যালয়”- এর প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালিন বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপিত হলে ২৭ ফেব্রয়ারী ২০২৩ ইং তারিখের ম্যানেজিং কমিটির সভায় প্রতিষ্ঠানের অডিট সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

সে মোতাবেক অডিট সম্পন্ন করার লক্ষ্যে নির্ধারিত ফার্মের অডিট দল তার নিকট ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ের আর্থিক তথ্য-উপাত্ত চাইলে অডিট কমিটিকে কোন রকম তথ্য উপাত্ত প্রদান করেননি এবং সহযোগিতা করেননি। অডিট দলের দাখিলকৃত প্রতিবেদনে ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের আয়ের খাতের দুর্নীতির ১ কোটি ৪২ লাখ ৭ হাজার ৪৮৯ টাকা এবং  ব্যয়ের খাতের দুর্নীতি ১ কোটি ৪৩ লাখ ৪৭ হাজার ২৫০ টাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়।

এছাড়াও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে এমপিও নাম করে অর্থ আত্মসাৎ এবং ২০২০ সালে শিক্ষকদের প্রভিডেন্ড ফান্ডের ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা  আত্মসাতের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এরপর দুইবার কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হলেও প্রধান শিক্ষক সন্তোষজনক জবাব প্রদানে ব্যর্থ হয়।

এতে আরও বলা হয়, এমতাবস্থায়, আর্থিক দুর্নীতি, জাল সনদের মাধ্যমে নিজ আত্মীয়কে নিয়োগ প্রদান, এমপিওভুক্তির আশ্বাস দিয়ে অর্থ আদায় সহ প্রতিষ্ঠানের কাজে সময় না দিয়ে জমি ব্যবসায় নিজেকে ব্যস্ত রাখার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে অবহেলার কারণে “স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষকগণের চাকুরির শর্ত বিধিমালা” এর ১৬ অনুযায়ী মোঃ কাওছার আলী শেখকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।

এছাড়াও ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের আয়ের খাতের ১ কোটি ৪২ লাখ ৭ হাজার ৪৮৯ টাকা এবং  ব্যয়ের খাতের দুর্নীতি ১ কোটি ৪৩ লাখ ৪৭ হাজার ২৫০ টাকা এবং ২০২০ সনের শিক্ষকদের প্রভিডেন্ড ফান্ডের আত্মসাৎকৃত ১ লাখ ৯৮ হাজার অনতি বিলম্বে প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে জমা করার প্রদান করার জন্য বলা হলো। অন্যথায় বিধি মোতাবেক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন কাওছার শেখ। একাধিক বাড়ি করার পাশাপাশি বিলাসিতার জন্য কিনেছেন দামি গাড়িও। হয়েছেন একটি ডেভেলপার কোম্পানির মালিক। এসব বিষয়ে গত ১৩ সেপ্টেম্বর প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনির কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাজী আবুল কালাম অনু। অভিযোগপত্রে কমিটির ৮ সদস্যের স্বাক্ষর রয়েছে।

লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মো. কাওছার আলী শেখ ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১১ বছর যাবত নিজের আস্থাভাজন ম্যানেজিং কমিটি দিয়ে বিদ্যালয়টি পরিচালনা করেছেন। অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমেই তিনি এই এলাকাতেই বিশাল সম্পদের পাহাড় গড়েন এবং ডেভলপার ব্যবসা গড়ে তুলেন। পরে ২০২১ সালে এডহক কমিটি এবং তারপর পূর্নাঙ্গ নতুন কমিটি গঠনের পর নতুন ম্যানেজিং কমিটি বিগত ১০ বছরের অডিট করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ সময় অডিট রিপোর্টে আর্থিক অসঙ্গতি ও বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে আসে।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সেশন চার্জ, মাসিক বেতন ও পরীক্ষার ফিস এবং ছাত্র ছাত্রীদের সঠিক তথ্য ও নথিপত্র বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক অডিটের চাহিদা অনুযায়ী উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এখানে আরও বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সেশন চার্জ, মাসিক বেতন ও পরীক্ষার ফিস বাবদ অডিটে ১২ কোটি ৯৫ লক্ষ ১৮ হাজার ৫০০ টাকার আয় হলেও অডিট নিরীক্ষীত তথ্যে ১১ কোটি ৫৩ লক্ষ ১১ হাজার ১১ টাকা পাওয়া যায়। এখানে ১ কোটি ৪২ লক্ষ ৭ হাজার ৪৮৩ টাকার কোন হদিস মেলেনি। বিশাল এই আর্থিক অসঙ্গতির কোন জবাব দিতে পারেননি প্রধান শিক্ষক কাওছার শেখ ।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সেশন চার্জ, মাসিক বেতন ও পরীক্ষার ফিস ও অন্যান্য আয়ের সঙ্গে ১ কোটি ৪৩ লক্ষ ৪৭ হাজার ২৫০ টাকা মওকুফ সমন্বয় হয়েছে। তন্মধ্যে ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে ১ কোটি ১ লক্ষ ৪৮ হাজার ৫৫০ টাকা মওকুফ করা হলেও শিক্ষার্থীদের মওকুফের আবেদন এবং ম্যানেজিং কমিটির অনুমতি নেই। এখানেও আর্থিক অসঙ্গতি পাওয়া গেছে।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাহিদা বেগমের থেকে এমপিওভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৬ লক্ষ টাকার মধ্যে ৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা প্রধান শিক্ষক আত্মসাৎ করেন এবং এমপিওভুক্ত করতেও ব্যর্থ হন বলেও অভিযোগে বলা হয়েছে। এছাড়া ২০২০ সালের ওই বছরেই করোনাকালীন সময়ে শিক্ষকদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের ১ লক্ষ ৯৮ হাজার টাকা নগদ বিতরণের নামে ব্যাংক থেকে নগদ উত্তোলন করলেও শিক্ষকদের হিসাবে জমা বা ক্যাশ প্রদান করেননি।

জানা গেছে, ২০১১ সালে বিদ্যালয়টির তৎকালীন প্রধান শিক্ষক অবসরে গেলে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব পান বিদ্যালয়টির তৎকালীন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক তাসলিমা বেগম। ভারপ্রাপ্তের দায়িত্বকালীন সময়ে তিনি হজে গেলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পান মোঃ কাওছার শেখ। এরপর হজ থেকে তাসলিমা বেগম ফেরত আসার আগেই তিনি নিজেই প্রধান শিক্ষক নিয়োগ বাগিয়ে নেন। আর এই প্রধান শিক্ষক পদে বসেই শুরু করেন অনিয়ম দুর্নীতি। জিরো থেকে বনে যান হিরো, গড়েন অঢেল সম্পদ বাড়ী-গাড়ী, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ।

জানা গেছে, বিটিএর নেতৃত্বে সম্প্রতি জাতীয়করণের আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষকদের ব্যাপক সাড়া পড়ে। ধারাবাহিক আন্দোলনে প্রতিটি জেলা থেকে চার পাঁচটা বাসে করে শিক্ষকরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হন। আন্দোলন চালিয়ে নিতে প্রায় ৪৫ জেলা থেকে মোটা অংকের অর্থ জমা দেন বিটিএ সেক্রেটারী কাওছার শেখের কাছে। আন্দোলনে যোগদান করা শিক্ষকরা নিজের অর্থে আন্দোলনে আসেন এবং হোটেলে থাকেন। আন্দোলনে যোগ দেওয়া এই শিক্ষকদের জন্য তেমন কোনো অর্থ ব্যয় না হলেও শিক্ষকদের থেকে পাওয়া মোটা অংকের অর্থ তিনি হাতিয়ে নেন। যা সংগঠনটির কাছে হিসাব বুঝে দেননি তিনি। শুধু তাই নয়, আন্দোলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনির নামে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নেগেটিভ মন্তব্য করেছেন তিনি। গুঞ্জন রয়েছে শিক্ষামন্ত্রীর নামে নেগেটিভ মন্তব্য করার জন্য বিরোধী মতাদর্শের বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাত রয়েছে তার পিছে।

জানা গেছে, গত অক্টোবর মাসে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপ‌জেলা বাংলাদেশ শিক্ষক স‌মি‌তি (বিটিএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপ‌তি আব্দুস সামাদ মোল্লাকে মৃত দে‌খি‌য়ে কেন্দ্র থে‌কে নতুন সভাপ‌তি হি‌সে‌বে ফলদা রামসুন্দর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ‌্যাল‌য়ের প্রধান শিক্ষক জাফর ইকবাল শাহীনকে ভারপ্রাপ্ত সভাপ‌তি বানা‌নো হ‌য়ে‌ছে। আর এই কমিটির অনুমোদন দিয়েছিলেন বিটিএর এই সেক্রেটারি কাওছার শেখ। অভিযোগ রয়েছে, তার যোগসাজসেই জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে এই কমিটি করা হয়েছিল।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক মো. কাওছার আলী শেখের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হাজী আবুল কালাম অনু গণমাধ্যমকে বলেন,  আমরা নিবন্ধিত ফার্ম দিয়ে ১০ বছরের অডিট করানোর উদ্যোগ গ্রহণ করি। অডিটে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির তথ্য মেলে। তাকে দু’দফা শোকজ করা হলেও তিনি কোন জবাব দেননি। এই প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ে সময়মত আসেন না, অনেক সময়ই বিদ্যালয়ে এসে স্বাক্ষর করে বের হয়ে যান। তিনি কম্পিউটার অপারেটর থেকে সহকারী শিক্ষক (আইসিটি) পদে তার নিজ জেলার বাসিন্দা হোসেন শেখকে জাল সনদের মাধ্যমে  নিয়োগ প্রদান করেন। ২০২৩ সালের ২৫ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চিঠি ইস্যু করেছে শিক্ষা প্রশাসন।

এ দিকে এই দুর্নীতিগ্রস্থ প্রধান শিক্ষককে বরখাস্তের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বাশিস) সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সবুজ বিদ্যাপীঠ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও বিটিএ সাধারণ সম্পাদক- জনাব কাউসার শেখকে সাময়িক বরখাস্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। অবিলম্বে চাকরিতে পুনঃবহাল করতে হবে। এটি একটি গভীর ষড়যন্ত্র। জাতীয়করণের আন্দোলন সংগ্রাম করলেই বিপদ! এজন্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে শিক্ষক সমাজকে! কাউসার শেখকে চাকরিচ্যুত করার প্রতিবাদে তীব্র আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলা উচিত। নতুবা কোন দিন জাতীয়করণের ঘোষণা আসবে না।

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৩/১১/২০২৩

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.