ঢাকাঃ দেশের মেডিকেল কলেজগুলোয় শিক্ষক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। মৌলিক বিষয়ে চাহিদার প্রায় অর্ধেক পদই বর্তমানে খালি। এর মধ্যে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ৪১ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য। আর বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় এ সংখ্যা প্রায় ৪৯ শতাংশ। শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় এমবিবিএস কোর্সের শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যারা পাশ করছেন, তারা সব বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে চিকিৎসাব্যবস্থায়।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১০৩টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি। এগুলোয় বিভিন্ন পদমর্যাদার শিক্ষকের পদ রয়েছে ৪ হাজার ৭৮৮টি। এর বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ২ হাজার ৮৫৯ জন। শূন্যপদ রয়েছে ২ হাজার ১২২টি। অর্থাৎ ৪৪ দশমিক ৩২ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপক পদমর্যাদার শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে সবচেয়ে বেশি। অধ্যাপকের পদ রয়েছে ৭০৯টি। এর মধ্যে ৪৭০টি খালি। অর্থাৎ মোট অধ্যাপক পদের ৬৬ দশমিক ২৯ শতাংশ খালি। সহযোগী অধ্যাপকের পদ রয়েছে ১ হাজার ১৬৯টি। এর মধ্যে ৭০৯টি খালি রয়েছে। মোট পদের ৬০ দশমিক ৬৫ শতাংশই খালি। এছাড়া সহকারী অধ্যাপক পদ রয়েছে ১ হাজার ৭১৯টি। এর বিপরীতে ৬২৬টি খালি অর্থাৎ ৩৬ দশমিক ৪১ শতাংশ খালি। প্রভাষক পদ রয়েছে ১ হাজার ১৮০টি। এর বিপরীতে ৩১৫টি পদ খালি রয়েছে। মোট পদের ২৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ খালি।
সরকারি খাতের মেডিকেল কলেজগুলোয় এমবিবিএস (ব্যাচেলর অব মেডিসিন অ্যান্ড ব্যাচেলর অব সার্জারি) কোর্সে প্রতিবছর চার হাজার ৩৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এ সংখ্যা আরও ১ হাজার ৩০ জন বাড়ানো হয়েছে। ফলে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তি হবে ৫ হাজার ৩৮০ জন। অর্থাৎ শিক্ষক পদের অর্ধেক খালি থাকলেও শিক্ষার্থী ভর্তি কিন্তু বাড়ছে। শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে এবং শিক্ষকদের নতুন পদ সৃষ্টি না করে শিক্ষার্থী ভর্তি বাড়ানোর ফলে শিক্ষক সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করবে।
সূত্র জানায়, আইন না মানায় চলতি বছর ৬টি বেসরকারি মেডিকেলের ভর্তি কার্যক্রম ও অনুমোদন বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। দেশে এখন ৬৬টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এসব মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তির আসন সংখ্যা রয়েছে ৬ হাজার ২০৭টি। এগুলোয় প্রায় ৯ হাজার শিক্ষক দরকার হলেও আছেন মাত্র ৪ হাজার ৬২৬ জন। অর্থাৎ ৪ হাজার ৩৭৪ জন শিক্ষকের পদ খালি। মোট পদের বিপরীতে খালি ৪৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। বেসিক বিষয়ে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি থাকায় কলেজগুলো পৃথকভাবে শিক্ষক সংখ্যার তথ্য পাওয়া যায়নি। চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষক না থাকায় তাদের শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেডিকেল কলেজগুলোয় শুধু যে শিক্ষক সংকট রয়েছে তা নয়, অবকাঠামো থেকে শুরু করে পরীক্ষাগার, হোস্টেলসহ সবখানেই সংকট রয়েছে। এছাড়া লোকবলের ঘাটতি রয়েছে সব শাখায়। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এসব মেডিকেল কলেজের শিক্ষক পদোন্নতির বিধান শিথিল করা, প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ, উচ্চশিক্ষার সহজ সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হবে। মেডিকেল শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষক ও সরঞ্জামাদির সংকট থাকায় এমবিবিএস কোর্সে সম্পূর্ণ শিক্ষা তারা পাচ্ছেন না। নানা ঘাটতি নিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) জানিয়েছে, একটি মেডিকেল কলেজে অনেক বিভাগ থাকে। তবে মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ন্যূনতম ১১টি বিষয় থাকা বাধ্যতামূলক। সেগুলো হলো অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, কমিউনিটি মেডিসিন, ফরেনসিক মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, প্যাথোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, সার্জারি, মেডিসিন এবং গাইনি ও অবস। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এমবিবিএস (ব্যাচেলর অব মেডিসিন, ব্যাচেলর অব সার্জারি) ও বিডিএস (ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি) ডিগ্রি দেওয়া হয়, সেগুলোর একটি সাধারণ নীতিমালা হলো প্রতি ১০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক থাকতে হবে। আর প্রতি ২৫ শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম একজন পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী শিক্ষক থাকতে হবে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি খাতের কোনো চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ শর্ত পূরণ করতে পারছে না। এতে চিকিৎসা শিক্ষার মান পড়ে যাওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শিখন প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এমবিবিএস শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক মোট আটটি মৌলিক বিষয় রয়েছে। বিষয়গুলোকে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রাণ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। অথচ এসব বিষয় পড়ানোর মতো শিক্ষক নেই অনেক মেডিকেল কলেজে। এর মধ্যে রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, জামালপুর মেডিকেল কলেজ, পাবনা মেডিকেল কলেজ, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ, সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজ, মাগুরা মেডিকেল কলেজ, নওগাঁ মেডিকেল কলেজ, শহিদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ, নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজ, নীলফামারী মেডিকেল কলেজ, চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ, শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ, নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ এবং শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক পদে একজন শিক্ষকও নেই। এছাড়া ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ, যশোর মেডিকেল কলেজ, পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ, শহিদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, টাঙ্গাইল, শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক পদে মাত্র একজন করে শিক্ষক রয়েছেন।
শিক্ষক সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল বলেন, মেডিকেল কলেজগুলোয় যে শিক্ষক সংকট রয়েছে, তা সমাধানের চেষ্টা চলছে। অনেক শিক্ষক চাকরি ছেড়ে দেন, অনেকে ছুটিতে চলে যান। ফলে শিক্ষক সংকট তৈরি হয়। তাই শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া দ্রুত করার চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক পদে শিক্ষক না থাকলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। কারণ শিক্ষার্থীদের মেশিনের মাধ্যমে তৈরি করা যায় না, তাদের হাতেকলমে ধারাবাহিকভাবে শেখাতে হয়। ইতোমধ্যে আমরা ১৭টি মেডিকেলে হল নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। মেডিকেল সরঞ্জামাদির বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক মেডিকেলে উন্নতমানের সরঞ্জামাদির সংকট রয়েছে। আমরা এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। প্রাইভেট মেডিকেল কলেজেও নানা ঘাটতি রয়েছে। সমস্যা থাকার কারণে চলতি বছর আমরা ৬টি মেডিকেল বন্ধ করে দিয়েছি। সরকারি মেডিকেলে এমবিবিএস কোর্সে আসন বৃদ্ধি করার কারণে শিক্ষক সংকট আরও বাড়বে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ধারাবাহিকভাবে এই আসন বাড়ানো হয়েছে। তাই খুব বেশি সমস্যা হবে না। যুগান্তর
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৫/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.