যশোরঃ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় যশোরে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি বাস্তবায়নে হরিলুটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। যশোরে সরকারি এ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এনজিও ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’ কাগজপত্র জাল-জালিয়াতি করে অন্তত দুই কোটি টাকা লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ঝরেপড়া শিশুদের জন্য এ প্রকল্পের স্কুলগুলোর বাড়িমালিকরা ভাড়া পাননি; বেতন বকেয়া রয়েছে শিক্ষক, সুপারভাইজারদের। শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে নিম্নমানের পোশাক, ব্যাগ। এভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি করে ওই টাকা লুটে নিয়েছে ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’।
অভিযোগকারীদের দাবি, দিশার অফিস জালিয়াতির কারখানা। প্রকল্পের যাবতীয় বিল-ভাউচার তাদের নিজেদের তৈরি করা। এমনকি প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের যে ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়েছে সেটিও নিজেরা তৈরি করেছেন। ব্যাংক থেকে স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করলেই তা ধরা পড়ে যাবে।
এসব বিষয় তুলে ধরে প্রকল্পের উপজেলা ম্যানেজার উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক বরারর অভিযোগ করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালককে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গোটা দেশের ঝরেপড়া শিশু-কিশোরদের শিক্ষার আওতায় আনতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় ২০২০ সালে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন (সাব-কম্পোনেন্ট ২.৫’ আউট অব স্কুল চিল্ড্রেন-(ওওএসসি) প্রোগ্রাম, পিইডিপি-৪) কর্মসূচি গ্রহণ করে। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক জেলা থেকে একটি লিড এনজিও নির্বাচন করা হয়। যশোরে লিড এনজিও হিসেবে ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’ ছয়টি উপজেলা ও যশোর পৌরসভায় (দুটি অঞ্চলে বিভক্ত করে ১ ও ২) প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। তবে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই সংস্থাটির বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
অভিযোগকারীদের দাবি, কার্যক্রম শুরুর আগে ঝরেপড়া শিশুর তথ্য সংগ্রহে জরিপকারীদের ৮০ শতাংশ টাকা এখনো পাওনা রয়েছে। শিক্ষক ও সুপারভাইজার নিয়োগে ব্যাপক অর্থবাণিজ্য করা হয়েছে। গত ৩০ জুন প্রকল্প শেষ হলেও শিক্ষক, সুপারভাইজারদের বেতন পরিশোধ করা হয়নি। ঝরেপড়া শিশুদের স্কুলের জন্য ভাড়া নেওয়া ঘরের ভাড়া পাননি মালিকরা।
সূত্র জানায়, যশোরের ছয়টি উপজেলার প্রায় ৪০০ স্কুলের এক বছরের ভাড়া বকেয়া রয়েছে। দেড় হাজার টাকা হিসেবে এ ৪০০ স্কুলের এক বছরের ভাড়া ৭২ লাখ টাকা। আর যশোর পৌরসভার ৬০টি কেন্দ্রে আড়াই হাজার টাকা করে দেড় বছরের ভাড়া দেওয়া হয়নি। এ ভাড়ার পরিমাণ ৩০ লাখ টাকা। অথচ ঠিকই এ টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে সংস্থাটি।
এছাড়া যশোর পৌরসভার ৬০টি স্কুলকেন্দ্রের ৬০ শিক্ষকের ১০ হাজার টাকা করে দুই মাসের বেতন বাবদ ১২ লাখ টাকা, ছয় উপজেলার ৪০০ শিক্ষকের পাঁচ হাজার টাকা করে দুই মাসের ৪০ লাখ টাকা, উপজেলার ৫০ জন সুপারভাইজারের ১৫ হাজার টাকা করে দুই মাসের ১৫ লাখ টাকা, পৌরসভার ছয়জন সুপারভাইজার ও উপজেলার আটজন ম্যানেজারের ২০ হাজার টাকা করে দুই মাসের সাত লাখ ২০ হাজার টাকা দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা উত্তোলন করে নিয়েছে বলে অভিযোগ।
যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বন্দবিলা ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে এ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রের জন্য ঘরভাড়া নেওয়া হয় ওই গ্রামের মোসলেম বিশ্বাসের। তিনি বলেন, স্কুলঘর ভাড়া নেওয়ার পর থেকে তিনি একদিনের ভাড়াও পাননি।
ওই কেন্দ্রের শিক্ষক মোসলেম বিশ্বাসের পুত্রবধূ জুইনা খাতুন বলেন, কেন্দ্রে প্রথম যে শিক্ষক ছিলেন, বেতন না পেয়ে তিনি ৪-৫ মাস পর চলে যান। এরপর তিনি কেন্দ্রের শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন। তিনিও পাঁচমাস পড়িয়ে কোনো বেতন পাননি।
একই উপজেলার ধর্মগাতি কেন্দ্রটি ওই গ্রামের জহুরুল ইসলামের বাড়িতে। জহুরুল ইসলামের ছেলে মাজহারুল ইসলাম জানান, তারাও কেন্দ্রের কোনো ভাড়া পাননি। তার স্ত্রী ঝরণা খাতুন ওই কেন্দ্রের শিক্ষিকা। তিনিও কোনো বেতন-ভাতা পাননি।
বাঘারপাড়ার জহুরপুর ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামের কেন্দ্রের শিক্ষক জেসমিন খাতুন জানান, তার আট মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। ভাড়া পাননি বাড়ির মালিক নাজিম মেম্বার।
জহুরপুর ইউনিয়নের বেতালপাড়া কেন্দ্রের বাড়ির মালিক মোক্তার হোসেনও কোনো ভাড়া পাননি। এ ইউনিয়নের সুপারভাইজার আব্দুর রহিম জানান, কোনো কেন্দ্রের বাড়িমালিক ভাড়া পাননি। কিন্তু দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে ঠিকই। তার নিজের বেতন এবং সোশ্যাল বেনিফিটের টাকাও বকেয়া রয়েছে।
এ বিষয়ে প্রকল্পের উপজেলা ম্যানেজার মো. আব্দুল্লাহ জানান, তার দুই মাসের বেতন এবং এক বছরের টিএ বিল পাওনা রয়েছে। তবে তিনি শুধু একা না; প্রত্যেক শিক্ষক, সুপারভাইজার ও ম্যানেজারের বেতন বকেয়া রয়েছে। ভাড়া পাননি বাড়ির মালিকরা। কিন্তু কাগজপত্র জাল-জালিয়াতি করে দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা ওইসব টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিম্নমানের পোশাক, ব্যাগ দিয়ে বরাদ্দের টাকা লুটপাট করেছে।
আব্দুল্লাহর ভাষ্য, দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার অফিস জালিয়াতির কারখানা। প্রকল্পের যাবতীয় বিল-ভাউচার তাদের নিজেদের তৈরি করা। শিক্ষক ও বাড়ি মালিকদের সই নিজেরা করে বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করে নিয়েছেন। এমনকি প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের যে ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়েছে তাও দিশার কর্মকর্তারা নিজেরা তৈরি করেছেন। ব্যাংক থেকে স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করলেই তা ধরা পড়ে যাবে। এইসব জাল কাগজপত্রের প্রমাণও তাদের কাছে রয়েছে। এজন্য তিনি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালককে প্রতিবেদন দাখিলেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রাহিমা সুলতানার সঙ্গে। তিনি বলেন, জাল-জালিয়াতি বা অনিয়ম-দুর্নীতির সব অভিযোগ মিথ্যা। যারা এ প্রকল্পে কাজ করতে পারেননি তারা এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছেন। তিনি দাবি করেন, প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের যাবতীয় হিসাব তাদের কাছে রয়েছে।
যশোর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালক হিরামন কুমার বিশ্বাস বলেন, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা ব্যুরো তাকে পত্র দিয়ে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলেছে। চাহিদা অনুযায়ী তিনি কাগজপত্র ও প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। জাগো
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৪/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.