শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে পরিচালনা কমিটির একশ্রেণির সদস্যের নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানের সভাপতির থেকে শুরু করে সদস্যদের বিরুদ্ধেও স্বেচ্ছাচারী ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানের অর্থ লুট, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ-বাণিজ্য করার অভিযোগ রয়েছে।
নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিস্ফোরক তথ্য শেয়ার করেছেন মাহমুদুল হক নামে এক উপজেলা এসিল্যান্ড। পাঠকদের জন্য তার স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘প্রসঙ্গ ম্যানেজিং কমিটি
তখন আমি একটি উপজেলার এসিল্যান্ড এবং ঘটনাচক্রে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসারও। সে সূত্রে একটা হাইস্কুলের ম্যানেজিং (এডহক) কমিটির সভাপতি। একদিন প্রধান শিক্ষক কমিটির একজন সদস্যকে নিয়ে আমার অফিসে এসে বললেন, কমিটির একটা মিটিং দেখাতে হবে। প্রধান শিক্ষক সঙ্গীয় ভদ্রলোককে এলাকার বিশিষ্ট বিদ্যোৎসাহী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ফরমায়েশি সভার এজান্ডায় আর্থিক কয়েকটা ইস্যূ পাশ করানোর ছিলো। সেসবে না গিয়ে প্রধান শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করলাম, পড়ালেখা কেমন চলছে? তিনি বললেন বেশ ভালো, গতবছর এসএসসিতে বেশ ভালো করেছে, এবারও ভালো ফলাফল হবে আশাকরি। আমি প্রশ্ন করলাম, এবছর যারা পরীক্ষা দিবে তাদের কতোজন ইংরেজি পড়তে পারে? অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে তিনি বললেন, আমার ৩৩ বছরের শিক্ষকতা জীবনে কেউতো এপ্রশ্ন করেনি। তাও হিসেব করে তিনি বললেন, ১০% শিক্ষার্থী ভালোভাবে পড়তে পারে। সদস্য ভদ্রলোক কোন কথাই বললেন না। কিছুটা চুপসে গেলেন। কারণ ভদ্রলোকের স্কুলের শিক্ষা নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। ভাববেন না শুধু ঐ স্কুলের এ অবস্থা। মফস্বলের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চিত্রও প্রায় একই।
আরেকটা স্কুলে দেখলাম একজন সভাপতি হতে না পেরে হাইকোর্টে রিট করলেন। রিট করতে কতো টাকা লাগে? টাকা খরচ শুধুই কি সামাজিক মর্যাদার জন্য, নাকি অন্য কিছু?
এমূহুর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি নিয়ে কতো মামলা উচ্চ আদালতে বিচারধীন রয়েছে এটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে একটা স্কুলের এডহক কমিটির সভাপতি হয়ে দেখলাম ফান্ডে খুব বেশি টাকা নেই। কিন্তু কয়েকমাস পরে দেখি ফান্ডে ১০ লক্ষাধিক টাকা। আলাদিনের চেরাগ দিয়ে নয়, শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি মিলে এতো টাকা হয়েছে। বুঝতে আর কিছু বাকি রইলো না।
একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দু’জনের নাম বিদ্যোৎসাহী হিসেবে সুপারিশ করা হলো। দুটো দলে বিভক্ত ঐ এলাকার মানুষ। প্রভাবশালীরা বিপরীতমুখী চাপ প্রয়োগ করতে লাগলেন। এটা নিষ্পত্তি করতে সেকি লঙ্কাকাণ্ড!!
আরেকটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি থাকার পরও তিনি স্কুলে যেতে পারেন না, সহসভাপতি স্বাক্ষর করেন। কতো যে দরবার! সেটা নিয়ে কোর্ট কাচারী! “
আরেকটা প্রাইমারী স্কুলে সভাপতির ভয়ে প্রধান শিক্ষক স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিলেন। তিনি আমাকে ফোন করে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। আমার হস্তক্ষেপে কোনমতে রফা হলো।
একটা হাইস্কুলে ভোটের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে দায়িত্ব দিলাম প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে। তিনি সভাপতি নির্বাচন করার জন্য স্কুলে গেলেন। একজন প্রভাবশালী সভাপতি প্রার্থী ভিতরে বসে রইলেন। শিক্ষা অফিসার আমাকে বললেন, স্যার কি করবো? আমি বললাম খুব ভদ্রভাবে তাকে বাইরে যেতে বলেন, নইলে ভোটের কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয় জানিয়ে দেন। তিনি তাই করলেন এবং ভদ্রলোক বাইরে যাওয়ার পর ভোট হলো। যথারীতি তিনি হেরে গেলেন। সেখানেই তিনি চিৎকার চেচাঁমেচি শুরু করলেন। নানা জায়গায় ঐ অফিসারের বিরুদ্ধে বিচার দিলেন। আখেরে কোন লাভ হয়নি।
আরেকটা স্কুলে সভাপতি নির্বাচনে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বেশ বেকায়দায় পড়লেন। নানামুখী চাপ ছিলো।আমি পুলিশ পাঠিয়ে শিক্ষা অফিসারকে বললাম, আইনানুগ কাজ করেন, বাকিটা আমি দেখবো। নির্বাচন হলো কোন সমস্যা ছাড়াই।
প্রাইমারী কি হাইস্কুল, মাদ্রাসা কিংবা কলেজ সবখানে কমিটিতে যাওয়ার জন্য এ সৃষ্টিছাড়া অসুস্থ প্রতিযোগিতা শিক্ষাব্যবস্থাকে আসলে কি দিচ্ছে??
এবার পজিটিভ কথা বলি। অনেক ম্যানেজিং কমিটির লোকজন দেখেছি যাঁরা শিক্ষা বিস্তারে অসাধারণ ভূমিকা রাখছেন। তবে সংখ্যাটা খুব বেশি নয়।
এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যারা শিক্ষায় অবদান রাখতে পারেন, সমাজকে আলোকিত করতে পারেন। তারা স্কুল ম্যানেজিং কমিটির ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেন না।
সবকিছু নষ্টদের অধিকারে ছেড়ে দেয়া যায়না। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।’
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.