কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম।।
বিশ্ব যখন আধিপত্যবাদী শক্তির কাছে পরাস্ত,যখন নিরীহ সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রশক্তির যাঁতাকলে পিষ্ট,যখন সংঘাত ও যুদ্ধবিগ্রহে মারা পড়ছিলো লাখো লাখো মানুষ তখনই বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র,মানবাধিকার, সাম্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। দেশে দেশে বিদ্যমান সংঘাত, সংঘর্ষ এবং যুদ্ধকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হলেও বাস্তবতার নিরিখে জাতিসংঘ তার সেই সব উদ্দেশ্য পূরণে কতটুকু সফল হয়েছে তা দৃশ্যমান।পরিমাপ করলে ব্যর্থতার ভাগই বেশি হবে। জাতিসংঘ বিভিন্ন সময় ব্যবহৃত হয়েছে বড় রাষ্ট্রগুলোর প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে।তাই যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ করার জন্য ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হলেও বিশ্ব থেকে যুদ্ধ বিগ্রহ পুরোপুরি বন্ধ হয়নি বরং কোন কোন ক্ষেত্রে বেড়েছে এবং বৃহৎ শক্তিগুলোর স্বার্থ রক্ষা হয়েছে!পাশাপাশি বেড়েছে হিংসা, বৈষম্য, যুদ্ধ, সংঘাত, হানাহানি এবং প্রাণহানি।
যে উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা হয় তা থেকে এখনো যোজন যোজন দূরে বিশ্বসংস্থাটি। নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা রক্ষার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জাতিসংঘ তা কেবল কাগজেকলমে সীমাবদ্ধ।পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দুর্বল ও নিরীহদের উপর সবলদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে অ্যাকশানে যেতে পারেনি জাতিসংঘ।
মায়ানমার,কাশ্মীর,ফিলিস্তিন,সিরিয়া,ইয়েমেন,আফগানিস্তান সহ বিভিন্ন দেশে চলমান অস্থিরতা নিরসন করতে পারেনি সংস্থাটি।মিয়ানমার সরকারের অত্যাচারের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিংগা মুসলমানদের সেদেশে ফেরত পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ।মিয়ানমারের অত্যাচারের বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
কাশ্মীরের জনগণের অধিকার হরণের ব্যাপারে কোন ভূমিকা চোখে পড়েনি।স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইসরাইলের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি।ক্ষেত্রবিশেষে দায়সারা গোছের বিবৃতি দিয়ে ক্ষান্ত হয়েছে কিংবা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে জাতিসংঘ।নিরাপত্তাহীনতা আর অশান্তিতে থাকছে পৃথিবীর বহু মানুষ।যে কারণে জাতিসংঘের প্রতি মানুষ আস্থা হারাচ্ছে।যদিও বছর বছর অধিবেশন অনুষ্ঠান আর দেশে দেশে সাহায্য প্রদান করে যাচ্ছে সংস্থাটি।মৌলিক কাজ সম্পাদনে ব্যর্থ হচ্ছে।হয়তো বিশ্বযুদ্ধ ঠেকানো সম্ভব হয়েছে।এরপরও ক্ষুধা,দারিদ্র কিংবা অধিকার রক্ষায় আশানুরূপ সফলতা দেখাতে পারেনি।তাই এর সংস্কার ও কার্যকর ভূমিকার দাবি উঠছে। জাতিসংঘের কাছ থেকে বিশ্ববাসী আরো বেশি দায়িত্বশীল এবং গঠনমূলক ভূমিকা আশা করে।পরাশক্তিগুলোর বলয় থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনভাবে চলার পদক্ষেপ নিতে হবে।জাতিসংঘের স্থায়ী পাঁচ সদস্য দেশ যুক্তরাষ্ট্র,রাশিয়া,বৃটেন,ফ্রান্স ও চীনের প্রভাববিস্তারকে উপেক্ষা করে নিজেদেরকে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে।যখনই জাতিসংঘে বৃহৎ পাচঁটি রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রস্তাব এসেছে তখনই তারা নিজেদের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে সেই প্রস্তাবকে বাতিল করেছে।এমন হলে জাতিসংঘের ভূমিকা অবশ্যই সমালোচনার সম্মুখীন হবে।
জাতিসংঘের কোনো সাফল্য নেই, এই কথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। অবশ্যই তার গুরুত্বপূর্ণ কিছু সাফল্য আছে। এটা বলাই বাহুল্য, বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য জাতিসংঘের মতো বিশ্ব সংস্থার প্রয়োজন রয়েছে এবং তা হবে বিশ্ববাসীর আস্থার জায়গা। আমরা চাই, জাতিসংঘের মাধ্যমে বিশ্বে সত্যিকার গণতন্ত্র , সাম্য ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হোক।।বৃহৎ রাষ্টসমূহের খবরদারি ও যুদ্ধ থেকে জাতিসংঘ যেন ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে রক্ষার জন্য কাজ করে যায়। বিশ্বব্যাপী বিরাজমান ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং মানবতা বিধ্বংসী যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘের বলিষ্ট ভূমিকাই কাম্য।জাতিসংঘকে অবশ্যই শক্তিশালী হতে হবে যাতে পরাশক্তিগুলোর দিকে না তাকিয়ে নিজেই বিশ্বব্যাপী সংঘাত -সংঘর্ষ বন্ধে উদ্যোগ নিতে পারে।মানুষের মাঝে শান্তি ও আস্থা ফেরাতে এর বিকল্প নেই। জাতিসংঘ বৃহৎ শক্তির তল্পিবাহক না হয়ে জাতি-ধর্ম- নির্বিশেষে সবার এবং সকল রাষ্ট্রের আশা ভরসার প্রতীকে পরিণত হোক সেটাই কামনা।
★লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.