কুষ্টিয়ায় যুবকের ৯ টুকরা লাশ: হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা কে এই সজীব?
নিজস্ব প্রতিবেদক, কুষ্টিয়াঃ জেলার শহরতলি হাটশ হরিপুর পদ্মা নদীর চর থেকে ৯ টুকরা লাশ উদ্ধার হওয়া মিলন হোসেন (২৭) হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা এস কে সজীব। চাঁদার দাবিতে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাবেক সহ-সভাপতি এসকে সজিবের নেতৃত্ব এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ।
কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস্) পলাশ কান্তি নাথ জানান, গত বুধবার সকালে মিলন বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন। ওইদিন সন্ধ্যায় তার স্ত্রী মুমো খাতুন কুষ্টিয়া মডেল থানায় জিডি করেন। জিডির প্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। মুঠোফোনের একটি কললিস্টের সূত্রধরে প্রথমে মিলনের এক বন্ধুকে আটক করা হয়। পরে তার স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, আরেক বন্ধু সজিবের নেতৃত্বে মিলনকে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তীতে শুক্রবার বিকালে অভিযান চালিয়ে সজীবসহ আরও চারজনকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা মিলনকে হত্যা করে লাশ টুকরো টুকরো করে নদীর চরে পুঁতে রাখার বিষয়টি স্বীকার করেন।
তিনি আরও জানান, জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে টাকার দাবিতে মিলনকে হত্যা করা হয়েছে। জড়িতরা সবাই একে অপরের পরিচিত। মিলন বাড়ি থেকে অনলাইনে কাজ করত। নিখোঁজের দিন তাকে মুঠোফোনে ডেকে হাউজিং এলাকার একটি বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। ওইদিন রাতেই তাকে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ গুম করার সুবিধার্থে ধারালো অস্ত্র দিয়ে লাশ টুকরো টুকরো করে নদীর চরে পুঁতে রাখা হয়েছিল। আর এই পুরো হত্যাকাণ্ডটির নেতৃত্ব দিয়েছে তারই বন্ধু সজীব।
হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা কে এই এস কে সজীব
শিক্ষাবার্তার অনুসন্ধানে জানা যায়, এস কে সজীবের নাম সজীব শেখ। তিনি জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি (বহিষ্কৃত)। পাশাপাশি পুলিশের তালিকাভুক্ত কিশোর গ্যাং-প্রধান তিনি। তাঁর বাবার নাম মিলন শেখ। শহরের আড়ুয়াপাড়া এলাকার হরিবাসর এলাকায় তাঁদের বাড়ি। ছোটকাল থেকেই উৎশৃঙ্খল সজীব লেখাপড়ায় প্রথমিক পাঠ শেষ করতে পারেনি। সজীব ছোট বয়সেই কিশোর গ্যাং এর সাথে জড়িয়ে পড়ে। এর জন্য বিভিন্ন সময় সজীবের বাবা মাকে বিচারে সম্মুখিন হতে হয়েছিলো। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য থেকে এক সময় কিশোর গ্যায়ের নেতৃত্ত্ব আসে সজবের হাতে। তখন থেকেই শহরের হাউজিং এলাকায় চাঁদাবাজি, মারপিট, মাদকের কারবারসহ নানা অপকর্ম শুরু করেন। এরপর
ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এস কে সজীব কলেজে পড়ালেখা না করেও হঠাৎ করে ছাত্রলীগের পদ পেয়ে যান। ইয়াসির আরাফাত ও সাদ আহাম্মেদের নেতৃত্বাধীন কমিটিতে ২০১৭-১৮ সালের দিকে প্রথম সহসম্পাদকের পদ পান। তখন থেকেই শহরের হাউজিং এলাকায় কিশোর গ্যাং তৈরি করে এলাকায় চাঁদাবাজি, মারপিট, মাদকের কারবারসহ নানা অপকর্ম শুরু করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাউজিং এলাকার কয়েক বাসিন্দা জানান, সজীবের নামে অনেক অভিযোগ রয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে একটি কিশোর গ্যাং পরিচালিত হয়। মিলন নামে যাকে হত্যা করা হয়েছে, তিনিও তাঁদের মতোই ছিলেন। তাঁদের কাজ ছিল ছেলে-মেয়েদের ব্ল্যাকমেল করে চাঁদা দাবি করা।
এরপরও নেতাদের সুপারিশে জেলা ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটিতে সহসভাপতির পদ পেয়ে যান তিনি। এরপর সজীব আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। শহরে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতে দেখা যায়। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ হাফিজ চ্যালেঞ্জের ওপর হামলাসহ নানা অপকর্মের কারণে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ছাত্রলীগের নেতারা জানান, ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তুষারের হাত ধরে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন সজীব। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনের সময় নির্বাচনী প্রচারণায়ও অংশ নেন। সেখানে তাঁকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। ওই মঞ্চে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ইয়াসির আরাফাত, সাধারণ সম্পাদক মানব চাকীসহ অন্য নেতারাও ছিলেন।
দলের একটি সূত্র জানায়, এস কে সজীবকে নেতারা নানা অপকর্মে ব্যবহার করেন। তাঁর ক্যাডার বাহিনী আছে। মিছিল-মিটিংয়ে কিশোরদের নিয়ে আসেন। আগে ছাত্রলীগ করলেও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নতুন কমিটিতে তুষার সভাপতি হলে আবার তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় নানা অপকর্ম করে আসছিলেন। তুষারের ডানহাত হিসেবে পরিচিত সজীব তুষারের কুস্টিয়া বালুমহল দেখাশোনা করেন। স্বেচ্ছাসেবক লীগের নতুন সভাপতি তুষারের সের্টারের সমস্ত অপকর্ম করে থাকে।
জানা গেছে, এসকে সজীব কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি। কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভাঙচুর ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মারধরের অভিযোগে তাকে বহিষ্কার করা হয়। সেই মামলায় কারাগারে ছিলেন তিনি।
পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে সজীবের নামে কুষ্টিয়া মডেল থানায় মাদক, চাঁদাবাজি, হামলাসহ নানা অভিযোগে পুরোনো সাতটি মামলা আছে। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে এক নারী ইন্টার্ন চিকিৎসককে মারধরের মামলায় তাঁর দুই বছরের সাজাও হয়েছিল।
উল্লেখ্য গত ৩ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশহরিপুর ইউনিয়নের পদ্মার চর থেকে মিলন হোসেন নামে এক যুবকের ৯ টুকরা মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। শুক্রবার গভীর রাত থেকে শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত চরে অভিযান চালিয়ে লাশের এসব টুকরা উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পলাশ কান্তি নাথ। নিহত মিলন হোসেন (২৭) কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বাহিরমাদি গ্রামের মাওলা বক্স সরদারের ছেলে। তিনি স্ত্রী মিমো খাতুনকে নিয়ে কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন।
টেক্সটাইল প্রকৌশলে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করতেন। গত বুধবার সকালে এক যুবকের ফোন পেয়ে তিনি শহরের ভাড়া বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। ওইদিন সন্ধ্যায় মিলনের স্ত্রী কুষ্টিয়া মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
নিহত মিলনের স্ত্রী মিমো খাতুন বলেন, ‘মিলনের ব্যবসায়িক পার্টনার সজল ওই দিন সকালে মোবাইল করে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর থেকেই মিলনের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি’। ‘আমি আগে জানতাম না যে সজল একজন অস্ত্রধারী ও মাদক সম্পৃক্ত ব্যক্তি। জানলে আমি মিলনকে ওর সঙ্গে মিশতে দিতাম না। সজল খুব ভয়ংকর লোক, ওর একটা গ্যাং আছে। ওরাই মিলনকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। আমি ওদের ফাঁসি চাই।’
পুলিশ জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা সবাই একে অপরের পরিচিত। মিলন বাড়ি থেকে অনলাইনে কাজ করতেন। নিখোঁজের দিন তাকে ফোনে ডেকে হাউজিং এলাকার একটি বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। ওই রাতে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ গুম করতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ঠান্ডা মাথায় লাশ টুকরা টুকরা করা হয়। চারটি মোটরসাইকেলে সাতজন সাতটি পলিথিন ব্যাগের ভেতর লাশের ৯ টুকরা অংশ নিয়ে বের হন। নদীর পাড় থেকে হেঁটে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে পদ্মার মধ্যে বালুর ভেতর চারটি স্থানে লাশের টুকরাগুলো পুঁতে রাখেন তারা। এই পুরো হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি এস কে সজীব।
সজীব এর আগে র্যাবের হাতে ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে এক নারী ইন্টার্ন চিকিৎসককে মারধরের মামলায় তার দুই বছরের সাজাও হয়েছিল। সজীবের বিরুদ্ধে সাতটি মাদকসহ বিভিন্ন থানায় অন্তত ১২টি মামলা রয়েছে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৪/০২/২০২৪