অর্ধশত বেসরকারি কলেজের ল্যাব সহকারী একদিনও পাননি শীতকালীন ছুটি!
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ মোঃ রহমান (ছদ্মনাম) চাকরি করেন এমপিওভুক্ত একটি বেসকারি কলেজের ল্যাব সহকারী পদে। ইচ্ছে ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঘোষিত চলতি মাসের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ দিনের শীতকালীন ছুটিতে আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে বেড়াতে যাবেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ তাকে ছুটি দেননি। কর্মচারী হিসেবে তিনি কোন ছুটি পাবেন না ছাফ জানিয়ে দেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ছুটি শুধু শিক্ষকদের জন্য কর্মচারীদের জন্য নয় ঐ ল্যাব সহকারীকে জানান অধ্যক্ষ।
মোঃ রহমানের মত প্রায় সারাদেশের অর্ধশত কলেজের ল্যাব সহকারীদের মেলেনি কোন শীতকালীন ছুটি। শুধু শীতকালীন ছুটি নয় গত রমজান মাসে ২৬ দিন কলেজ ছুটি থাকলেও এসব ল্যাব সহকারীদের ছুটি মিলেছে মাত্র পাঁচ দিন, ঈদ-উল আযহার ছুটি দশ দিন হলেও মিলেছে চার দিন এবং দুর্গা পূজায় ১২ দিন ছুটি থাকলে শুধু মাত্র দশমীর দিন একদিন ছুটি পেয়েছেন তারা।
এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো অনুযায়ী, বেসরকারি উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক পর্যায়ের কলেজে পদার্থবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণীবিজ্ঞান, রসায়ন ও আইসিটি বিষয় অনুমোদন থাকলে এবং ল্যাব চালু থাকলে একজন করে ল্যাব সহকারী নিয়োগ দেওয়া যাবে।
সে অনুযায়ী একজন ল্যাব সহকারী শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রদত্ত ছুটি শিক্ষকদের মত করেই প্রাপ্য হবার কথা থাকলেও একজন কর্মচারী হিসেবে ল্যাব সহকারী এই ছুটি পাবেন না বলে প্রায় অর্ধশত কলেজ অধ্যক্ষ তাদের ছুটি না দিয়ে কলেজে উপস্থিত থাকতে বাধ্য করছেন এবং হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর নিচ্ছেন। অন্যথায় তাদের বেতন-ভাতা কাটা হবে বলে হুশিয়ার দিচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছুটি না পাওয়া এই তালিকার প্রায় দশটি কলেজ রয়েছে শুধু চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরীতেই। এগুলো হলো উত্তর কাট্টলী আলহাজ মোস্তফা-হাকিম ডিগ্রী কলেজ, লোহাগাড়ার আলহাজ্ব মোস্তফিজুর রহমান কলেজ ও বার আউলিয়া ডিগ্রি কলেজ, জোরালগঞ্জের বারইয়াহাট কলেজ, বোয়ালখালী সিরাজুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজ, সাতকানিয়ার চিব্বাড়ী এম এ মোতালেব কলেজ, রাউজানের হাজী বাদশা মাবেয়া কলেজ এবং পাহাড়তলীর একটি কলেজ। এছাড়াও যশোরের উপশহর মহিলা ডিগ্রি কলেজ ও নওগাঁর বলিহার ডিগ্রী কলেজ ছাড়াও প্রায় আরও চল্লিশ টি কলেজ রয়েছে যারা এই ছুটির একটি দিনও পাননি।
ছুটি না পাওয়া এসব ল্যাব সহকারীরা বলেন, যদি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা ছুটি পাওয়ার ক্ষেত্রে ল্যাব সহকারীদের জন্য কোন প্রজ্ঞাপন কিংবা বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয় সেক্ষেত্রে আমরা এই ছুটির সুবিধা পেতাম। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা ছুটি সবার জন্য হলেও অধ্যক্ষরা আমরা কর্মচারী বলে ছুটি পাবো না একই কথা বলে আমাদের ছুটি পাওয়া থেকে বঞ্চিত করছেন। আমরা এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের দৃষ্টি কামনা করছি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার চট্টগ্রামের কার্যালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক উত্তম খীসা শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, আসলে বিষয়টি মানবিক নয় পেশাগত। শিক্ষক পাবেন কর্মচারীরা পাবেন না বিষয়টি অমানবিক। আমার কাছেও তারা এসেছিলেন। আমি কলেজগুলোর অধ্যক্ষকে পরামর্শ দিতে পারি নির্দেশ দিতে পারি না। তাদেরকে ডিজি মহোদয়ের কাছে যেতে বলেছি যাতে সেখান থেকে কোন নির্দেশনা আসলে এটা কলেজগুলো প্রতিপালন করতে বাধ্য হয়। কলেজ প্রধানদের এক্ষেত্রে আন্তরিক হওয়া জরুরি।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার চট্টগ্রামের আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক অধ্যাপক রেজাউল করিম শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঘোষিত সরকারি বেসরকারি কলেজের ছুটির তালিকা আসলে সবার জন্য প্রযোজ্য আবার প্রযোজ্য না। যারা প্রশাসনিক দায়িত্বে আছে তারা সব ছুটি পান না। বেসরকারি কলেজের ল্যাব সহকারী পদে যারা কর্মরত আছে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে না আসলে ল্যাবের তো কোন কাজ থাকে না। সেক্ষেত্রে তারা ছুটি পাবেন কি'না জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তারা তো বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কথা বলে বেড়ান। তারা কর্মচারী হিসেবে ছুটি পাবেন না। এই কর্মকর্তা মনে করেন শিক্ষকরা ছুটি পেলেও এই ছুটি কর্মচারীরা পাবেন না।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক অধ্যাপক রেজাউল করিম ছুটি পাবেন না জানালেও শিক্ষা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ছুটি অবশ্যই পাবেন। অনেক সময় প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা কলেজ অধ্যক্ষ কিংবা উপাধ্যক্ষ ছুটির দিন কলেজে উপস্থিত থাকেন সে সময় রুটিন করে কর্মচারীদের কলেজে রাখেন। কিন্তু কাউকে বাধ্য করার সুযোগ নেই। আর ছুটির মধ্যে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করার কোন নিয়মনেই। স্বাক্ষর কিংবা না আসলে বেতন কাটা হবে বলা বিধিবহির্ভুত।
ছুটির দিনে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা কিংবা না আসলে বেতন কাটার বিষয়টি অমানবিক এবং বিধিবহির্ভুত বলে মনে করেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ঢাকার আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন। তিনি শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ছুটি শিক্ষক-কর্মচারী সবার জন্য প্রযোজ্য। ১৬ ডিসেম্বর, বড় দিন কিংবা সরকারি সুর্নিষ্ট ছুটির দিন সবাই পাবে। শীতকালীন অবকাশ কিংবা রমজানের ছুটি এই সব ছুটিতে প্রতিষ্ঠান প্রধান দাপ্তরিক কাজের জন্য অনেক সময় প্রতিষ্ঠানে থাকতে হয়। সেক্ষেত্রে কর্মচারীদের সমন্বয় করে এক জন করে অনেক প্রতিষ্ঠানে তারা আসেন। কিন্তু বাধ্যতামূলক কলেজে আসতে হবে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতে হবে এটা অমানবিক এবং বিধিবহির্ভুত। প্রতিষ্ঠান প্রধানকে অবশ্যই আন্তরিক হতে হবে। কারণ অধিকাংশ কর্মচারীরই পরিবার আছে তারা এই ছুটিগুলোতে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যান বা ব্যক্তিগত নানা কাজ করেন।
তবে ল্যাব সহকারীদের ছুটি অবশ্যই প্রাপ্য জানিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) বেসরকারি কলেজ শাখার সহকারী পরিচালক তপন কুমার দাস শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঘোষিত ছুটির তালিকা আলাদা কারও জন্য না সকল শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য। শিক্ষক পাবেন কর্মচারী পাবেন না এমন হবার কথা নয়। অবশ্যই ল্যাব সহকারীরা ছুটি পাবেন। এ বিষয়ে আমার নজরে আসলে বিষয়টি দেখব এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।