ঈদুল আজহা মুবারক
ঈদুল আজহা বলিতে আমরা জিলহজ মাসের ১০ তারিখের আনন্দোত্সব কোরবানির ঈদকে বুঝিয়া থাকি। কোরবানির শব্দমূল ‘কুরব’ যাহার অর্থ ‘নৈকট্য লাভ করা’। এইদিন আমরা প্রিয়বস্তুকে কোরবানি দিয়া মহান আল্লাহর নৈকট্যলাভের চেষ্টা করিয়া থাকি। সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য এইরূপ উত্সর্গ প্রদান কোনো নূতন ঘটনা নহে।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম করিয়া দিয়াছি (২২ :৩৪)। এইজন্য আমরা মানব সভ্যতার ইতিহাসে দেখিতে পাই প্রথম কোরবানির ঘটনাটি আদিপিতা হজরত আদম (আ)-এর সময়কালেই হইয়াছিল। সুরা মায়িদায় আদমপুত্র হাবিল ও কাবিলের কোরবানি দেওয়ার চমত্কার বর্ণনা দেওয়া হইয়াছে। তবে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ)-এর সময় কোরবানির যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয় তাহা বিশ্বে নজিরবিহীন। তিনি স্বপ্নাদেশ পাইয়া প্রথমে কয়েক শত উট কোরবানি করেন।
পরে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী নিজপুত্র কলিজার টুকরা হজরত ইসমাইল (আ)কে কোরবানি করিবার জন্য ছুরি চালান। ইহা ছিল আসলে ইমানের এক কঠিন পরীক্ষা। তিনি ও তাহার প্রাণাধিক পুত্র সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলে তদস্থলে আল্লাহর মেহেরবানিতে অলৌকিকভাবে একটি দুম্বা কোরবানি হয়। কোরআন শরিফে এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রহিয়াছে সুরা আস-সাফফাতের ১০১-১০৮ নম্বর আয়াতে। সেই ঘটনার স্মারক ও হজরত ইব্রাহিম (আ)-এর সুন্নাত হিসাবে আমরা প্রতি বত্সর পবিত্র ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি করিয়া থাকি।
প্রকৃতপক্ষে ঈদুল আজহা ধর্মপ্রাণ মুসলমানের জন্য ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত একটি পরম আনন্দের দিন। আল্লাহর নিকট শর্তহীন আত্মসমর্পণই ইহার প্রধান শিক্ষা। মানবিক যুক্তি এখানে মূল্যহীন। ইসলামের এই মহান চেতনাকে ধারণ করিয়া ত্যাগ, তিতিক্ষা ও ধৈর্য্যের মধ্য দিয়া আমরা পরিপূর্ণ মানুষ হইয়া উঠিতে পারি।
অন্তরলোকের সংকীর্ণতা দূর করিতে পারি। ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা ইত্যাদির গুণে গুণান্বিত হইয়া ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতীয় জীবনকে গৌরবান্বিত করিতে পারি। শয়তানের প্ররোচনায় কোনো অশুভ শক্তির নিকট মাথা নত করা যাইবে না—ঈদুল আজহা এই বৈপ্লবিক বার্তাও আমাদের প্রদান করে।
এইজন্য কোরবানি দেওয়ার সময় আমরা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে এই আয়াতটি তিলাওয়াত করি :‘নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মরণ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য নিবেদিত (৭ :১৬২)।’ তিনিই আমাদের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক। তিনি কোরবানির মাধ্যমে আমাদের মনের পরীক্ষা নেন মাত্র। এইজন্য ইরশাদ হইয়াছে, ‘আল্লাহর নিকট এই কোরবানির গোশত ও রক্ত কিছুই পৌঁছে না, পৌঁছে শুধু তোমাদের তাকওয়া বা খোদাভীতি (২২:৩৭)।’
সামাজিক সমতা ও সম্প্রীতি রক্ষায় কোরবানির গোশত গরিব আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশি ও সমাজের দুঃখী মানুষের মধ্যে নিয়ম অনুযায়ী বিতরণ করিতে হইবে। সমাজ-সংসারের উন্নয়নে আত্মশুদ্ধি ও আত্মত্যাগের মহান দীক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে। নিজের মধ্যে বিরাজমান পশুশক্তি, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি রিপুগুলিকেও কোরবানি করিতে হইবে। ঈদুল আজহার পর আমাদের জীবনে কোরবানির এই শিক্ষার প্রতিফলন কতটা ঘটে তাহাই বড়ো কথা। পরিশেষে সবাইকে জানাই ঈদুল আজহার প্রীতি ও শুভেচ্ছা।—ঈদ মুবারক।