শতভাগ শিক্ষার্থী যদি বাংলা ও ইংরেজি পড়তে না পারে তবে শিক্ষককে কি শাস্তি পেতে হবে তা জানতে চাই। অসহায় শিক্ষক ফজরের নামাজ শেষে রান্নার কাজে লেগে পরেন। রান্না শেষ হতে না হতেই সকলকে খাবার বেরে দিয়ে নিজের জন্য কিছু খাবার নিয়ে চলে যান স্কুলে। স্কুলে পৌঁছতে হবে সকাল ৯টায়। এক দেড় ঘণ্টা আগে বের না হলে গাড়িটা মিস হবে এই টেনশনে পরতে হয় প্রায় শিক্ষককে। বিদ্যালয়ে পৌঁছেই হাজিরা খাতায় নামটা লিখেই শুরু করে দেন পাঠটিকা লেখা। কোন রকমে সংক্ষেপে পাঠটিকা লিখে দৌড় দেন ক্লাসে। হাতে থাকে বহুল আলোচিত one day one word এর খাতা ও শিক্ষার্থী হাজিরা খাতা। ক্লাসে ৪০/৪২ জন শিক্ষার্থী। শুরু হয় কুশল বিনিময়, শ্রেণীকরণ, আবেগ সৃষ্টি, পূর্ব পাঠ আলোচনা, পাঠ ঘোষণা, পূর্ব জ্ঞান যাচাই, উপকরণ প্রদর্শন, শিক্ষকের পাঠ, শিক্ষার্থী পাঠ, পাঠ চলাকালীন মূল্যায়ন, নিরাময়মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, one day one word আরো কত কি।
শুরু হতে লাগলো বিরতিহীনভাবে একের পর এক ক্লাস। এর মধ্যে আছে সমাবেশ। সমাবেশে কি কি করতে হয় তা তো সকলেই জানে। দুপুরে টিফিন বিরতিতে থাকবে ৩০ মিনিট। এই সময়ের মধ্যে খেতে হবে, নামাজ পরতে হবে, বাড়িতে সব ঠিক আছে কি না তা জানতে হবে, টয়লেট ব্যবহার করতে হবে আরো কত কি? ৩০ মিনিটে এতো কাজ করা কি আদতেই সম্ভব?
প্রাথমিক শিক্ষকরা তো আবার সবজান্তা। তাদের সংগীতের, শারীরিক শিক্ষা, চারু ও কারুকলা, ছড়া ও নৃত্য, ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম ক্লাস নিতে হবে। পারিনা বললে শিক্ষকের চলবেনা। প্রাথমিকের শিক্ষকদের সব জানতে হয়।
প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে কাব দল গঠন করতে হবে। শুধু কি তাই খুদে ডাক্তারের টিম গঠনও রয়েছে। এছাড়াও থাকছে বঙ্গবন্ধু বঙ্গমাতা ফুটবল টিম গঠন প্র্যাকটিস। সে সাথে আরো আছে বিদ্যালয় ভিত্তিক জাতীয় সংগীত প্রতিযোগিতা। শিক্ষার্থীদের কৃমিনাশক ওষুধ পর্যন্ত বিদ্যালয়ে বাচ্চাদের গুণে গুণে দিতে হবে।
প্রতি মাসে হোম ভিজিট তো আগেই কড়া নারে। মা সমাবেশ, এসএমসি মিটিং, উঠান বৈঠক তো আছেই। শিক্ষার্থীর শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবেই হবে যে করেই হোক। শিক্ষার্থীরা স্কুল ড্রেস না পরলেও শিক্ষকের দোষ।
বছরের শুরুতে শুরু হয় ভর্তি নেয়া, বই বিতরণ, বার্ষিক পরিকল্পনা ছক, ক্যাচমেন্ট এলাকার ছক, প্রাক প্রাথমিকের রুম সাজানো, প্রজেক্টরের ব্যবহার, উপবৃত্তির তালিকা তৈরি, উপবৃত্তির শিওর ক্যাশ ফরম পূরণ, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্ম সনদ সংগ্রহ কাজগুলো শিক্ষকদের করতে হয়।
এছাড়াও চাহিদা সম্পন্ন শিশুর প্রতি আলাদা যত্ন প্রতিটা শিক্ষক নিয়ে থাকেন।শিক্ষার্থীদের মারেননা, বকেননা, অপমানজনক কথা বলেননা। বাবা সোনা বলে ডাকে বাচ্চাদের। ফলে বাচ্চারা অতিমাত্রায় সাহস পায় অন্যায় ও অপরাধ করতে। কারণ সে জানে যায় করুক না কেন তার কিছুই হবেনা।
কয়েকদিন আগে এক বাচ্চা বললো আপা এক করতে যাবো। শিক্ষক বললো টয়লেটে যাও বাইরে যাবানা। ছাত্র এক দৌড়ে বাইরে গেল যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। একটু পরেই শিক্ষক দেখেন ছাত্রটি মাঠে ঘাস খাওয়া গরুর মুখে গিয়ে প্রস্রাব করলো। শিক্ষক চিৎকার দিয়ে ছাত্রকে ডাকতে লাগলো। ছাত্র হাসতে হাসতে এক দৌড়ে শিক্ষকের সামনে হাজির। শিক্ষক বুঝাচ্ছেন বাইরে প্রস্রাব পায়খানা করা ঠিক না। টয়লেটে যাবা। গরুটা তোমার এই কাজে কষ্ট পেয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ছাত্র শিক্ষকের কথায় যেন মজা নিচ্ছে হাসছে তো হাসছেই। ছাত্র ভাবছে শিক্ষক মনে হয় খুব পছন্দ করেছে তার এই কাজটি। কেননা শিক্ষক তাকে তো কিছুই বলছেনা। বাড়িতে ছাত্রের বাবা মা ভাবছেন যে শিক্ষক আমার বাচ্চাকে আদব কায়দা শেখান না। ভাবেন একবার এটাও শিক্ষকের দোষ?
সমাপনী পরীক্ষার ডিউটি, খাতা দেখা আরো কত কাজ সব শিক্ষক হাসি মুখে করেন। প্রতি বছর আদম শুমারি, শিশু জরিপ, ভোটার হালনাগাদকরণ, নির্বাচনের ডিউটিগুলোও প্রাথমিকের শিক্ষকরাই করেন।
সংক্ষেপে কেবল প্রাথমিকের শিক্ষকদের কাজের কিছু অংশ তুলে ধরলাম এ কারণে যে প্রাথমিকের শিক্ষকরা শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রে নয় বরং উল্লেখিত বিষয়সহ অন্য ডিপার্টমেন্টের কাজগুলোও করতে হয়। আমার মনে হয় এতো যোগ্যতা কেবল প্রাথমিকের শিক্ষকদেরই রয়েছে। তাই শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য বাড়তি যোগ্যতাগুলো থাকায় প্রাথমিকের শিক্ষকদের সবার উপরে বেতন দেওয়া উচিত।
কতটা ধৈর্য, কতটা মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয় একজন প্রাথমিক শিক্ষকের। সারাটাদিন পরিশ্রমের পর ৪টা ৩০ মিনিটে হাটা দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ি যেতে আবারো এক দেড় ঘণ্টা লাগবে। বাড়ি পৌঁছে শুরু হলো নিজের কাজ, বাড়ির অন্যান্য কাজ, বাচ্চাকে লেখাপড়া করানো। তারপর সকলের খাওয়া দাওয়া শেষে রাতের এক চিলতে ঘুম যেন স্বর্গের চেয়েও দামী তার কাছে। এতো কিছুর পরেও শিক্ষকের মূল্য কোথায়?
১১ গ্রেডের কথা শুনে অনেকে প্রাথমিকের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কথা বলছেন। শিক্ষকরা নাকি এসএসসি, এইচএসসি পাশ। ওদের হয়তো জানা নাই প্রাথমিকের শিক্ষকরা অনুমতি নিয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি পড়ালেখাও শেষ করেন। তবুও ধরে নিলাম শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নেয়। তাহলেও যে কোন মানুষ দীর্ঘদিন একই পেশায় থাকার ফলে তার অভিজ্ঞতা অন্য যে কোন পেশার মানুষের থেকে বেশি হয়। যেমন ধরুন আপনার মোটরসাইকেল নষ্ট হয়ে গেছে। আপনি এখন কি করবেন? নিশ্চয় নিজে নিজে গাড়িটা ঠিক করতে যাবেননা। অবশ্যই আপনি একজন মেকানিকের কাছে যাবেন। তাহলে বলুন তো একজন মেকানিকের কি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশের সার্টিফিকেট আছে? তাহলে শিক্ষাগত যোগ্যতায় কি আসে যায়।
এলাকায় অনেকে একসাথে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দেয়। কিন্তু টেকে কয়জন? বাকিরা তো টাকা পয়সা খরচ করে মাধ্যমিকে কিংবা কলেজে চাকরি নেন। অথচ যোগ্যতার পরীক্ষা কিন্তু প্রাথমিকের শিক্ষকদের দিতে হয়। আবার বেতন প্রাথমিকের শিক্ষকরাই সবচেয়ে কম পাই। কি সিস্টেম তাই-না! খুব অবাক হলেও এটা বাংলাদেশে সম্ভব। আমার মনে হয় এ কথা বিদেশিরা জানতে পারলে এ নিয়ে একটা হাস্যকর মুভি তৈরি করে ফেলতো।
উল্লেখিত কাজ ছাড়াও শিক্ষকরা যথাযথ মর্যাদায় দিবসগুলো পালন করেন। এছাড়াও ছুটি থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকরা ডেঙ্গুও জলাতঙ্ক দিবস পালন করতে চায় সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে।
সবচেয়ে বড় কথা প্রাথমিকের কাজ ও শিক্ষকের পরিশ্রম সম্পর্কে অনেকের অনেক কিছুই অজানা। তাই নানান জনে নানান কথা বলে। তবে প্রাথমিকের শিক্ষকরা সত্যিই অনেক পরিশ্রম করেন। তবুও কর্তৃপক্ষের মন পায়না। শিক্ষার্থীরা কেন ফেল করবে?শিক্ষার্থীরা কেন বাংলা ও ইংরেজি রিডিং পড়তে পারেনা? এতকিছুর দায় যেন শিক্ষকেরই। ভাবখানা এমন যে শিক্ষার্থীদের জন্ম যেন শিক্ষকরাই দিয়েছেন আর তাতে শিক্ষকরা অনেক বড় ভুল করেছেন।
এবার একটু বড় কথা বলবো। এইচএসসি পাশের পর শিক্ষার্থীরা ইউনিভার্সিটিগুলোতে পয়েন্টের উপর ভিত্তি করে ভর্তির ফরম পূরণ করতে পারে। তার মধ্যে ভালো স্টুডেন্টরাই ভর্তির চান্স পায়। একই চিত্র মেডিকেল ও ইন্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতেও। অথচ একটাবার ভেবেছেন কি আপনারা ভালো ভালো পড়া লেখা জানা মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে খুব সহজে এগিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু প্রাথমিকের শিক্ষকরা কাজ করে ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে। যাদের মানসিক বিকাশ পুরোপুরি ঘটেনি। বয়সের সাথে যাদের মানসিক বিকাশ ঘটছে। ভাবুনতো কত সেন্সিটিভ মাথা নিয়ে প্রাথমিকের শিক্ষকরা কাজ করেন। তাছাড়াও প্রাথমিকে রয়েছে চাহিদা সম্পন্ন শিশু, যাদের বিশেষ যত্নে পড়াতে হয়। যারা লেখা পড়ায় ভালো তাদের নিয়েও কাজ করতে হয় আবার যারা মেধাবী নন এবং লেখা পড়ায় দুর্বল সে সমস্ত শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রাথমিকের শিক্ষকদের কাজ করতে হয়। তাই বলি প্রাথমিকের শিক্ষকদের নিয়ে কোন কথা বলার আগে হাজারটাবার ভাববেন। আর যদি যোগ্যতা বা ক্ষমতা থাকে তাহলে ১ পয়েন্ট কিংবা ২ পয়েন্ট পাওয়া শিক্ষার্থীদের ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার বানিয়ে দেখান। যদি আপনি সৎ ও সত্যবাদী হয়ে থাকেন।
(শিক্ষকদের ফেসবুক গ্রুপ থেকে সংগৃহীত)
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.