এইমাত্র পাওয়া

শিক্ষা ক্যাডারের আবু কাইয়ুম শিশিরই যেন শিক্ষা উপদেষ্টা, মাউশি ডিজি তার ‘অধীনস্থ’!

আল আমিন হোসেন মৃধা: “আপনি কি অমক স্কুলের প্রধান শিক্ষক, আপনি এটা করেছেন কেন? আমি কিছুই শুনতে চাইনা আমি মাউশির ডিরেক্টর, ২৪ ঘন্টার মধ্যেই এইটা করবেন আমার যেন দ্বিতীয়বারের মত আর কল করতে না হয়” এভাবে কখনও একজন এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে ফোন করে হুমকি দেন কখনও দেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপারভাইজারকে, জেলা শিক্ষা অফিসার এমনকি মাউশির আঞ্চলিক উপপরিচালককেও ফোন দিয়ে হুমকি ধমকি প্রধান করেন তিনি। কোন কাজ থেকে টাকা পেলে মাউশির ডিজির অনুমোদন না নিয়ে একটা চিঠি ইস্যু করে ছুটে চলেন গ্রাম-গঞ্জে, জেলা-উপজেলার বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বলছিলাম মাউশির মনিটরিং এন্ড ইভালুয়েশান উইংয়ের পরিচালক কাজী মোঃ আবু কাইয়ুমের কথা। জোয়ারে গা ভাসিয়ে চলার মত রাজনৈতিক জোয়ারে রঙ বদলানো বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ১৪ ব্যাচের অধ্যাপক কাজী মোঃ আবু কাইয়ুম যাকে সবাই চেনেন মুলত “শিল্পপতি শিশির স্যার” নামে। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা হয়েও তিনি আওয়ামী লীগ আমলের প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার, রয়েছে গার্মেন্টস, খামারসহ একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। 

জানা গেছে, ২০ বছর ব্যাকডেটে নিয়োগ (নিয়োগ ২০২২ সালে) দেখিয়ে ২০২৩ সালে জালিয়াতির মাধ্যমে এমপিওভুক্ত হন জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলাধীন ভাটিখেওয়ারচর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষক। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ময়মনসিংহ আঞ্চলিক কার্যালয়ের তদন্তে এই জালিয়াতির স্পষ্ট ধরা পরে। জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পেরে স্কুলটির বর্তমান প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) এই ছয় শিক্ষকের বেতন-ভাতা আটকে দেন। শুধু বেতন-ভাতা নয় এই ছয় শিক্ষকের এমপিও’র এরিয়ার প্রায় ২০ লাখ টাকাও আটকে দেন প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির (ইউএনও) পরামর্শে। এই এরিয়ার অর্থ ছাড় করা  এবং তদন্তের বিষয়টি মিমাংশা করে দেওয়ার (এরিয়ার প্রাপ্ত অর্থের অর্ধেক টাকা দেওয়ার শর্তে) দায়িত্ব অধ্যাপক শিশিরকে দেন জালিয়াতি করে এমপিও বাগানো এই ছয় শিক্ষক। টাকার গন্ধ পেয়ে ‘বেহুঁশ’ শিশির গত ১৮ জুন ২০২৫ খ্রিস্টাবে তার দপ্তরের ল্যান্ডফোন থেকে ফোন করে প্রধান শিক্ষককে বেতন ও এরিয়ার ছাড়ার অর্থ ছাড়ের জন্য ২৪ ঘন্টার দেন। এরপর উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার, জামালপুর জেলা শিক্ষা অফিসার এবং মাউশির ময়মনসিংহের ডিডিকে (মাধ্যমিক) ফোন করে প্রধান শিক্ষককে দিয়ে বেতন-ভাতা ও এরিয়ার অর্থ ছাড় করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। যেহেতু এই তদন্ত করেছেন ময়মনসিংহ ডিডি অফিস তাই ময়মনসিংহের ডিডিকে সেই তদন্ত বাতিল করে নতুন করে তদন্তের চিঠি ইস্যুর চাপ দিলেও তিনি (ডিডি) ডিরেক্টর শিশিরের কথা না শোনায় অভিযুক্ত শিক্ষকদের দিয়ে এবং নিজ উপজেলার ইসলামপুরের (জামালপুর) গুঠাইল বাজারের অপর এক ব্যক্তিকে দিয়ে নিজের দপ্তরে (মনিটরিং এন্ড ইভালুয়েশান উইং)  অভিযোগ নিয়ে নিজের স্বাক্ষর এবং নিজেই তদন্তকারী কর্মকর্তা হয়ে ডিডির বিরুদ্ধে সরেজমিনে তদন্তে যান(মাউশির ডিজির অনুমোদন ছাড়াই নিজের দপ্তর থেকে তিনি এই তদন্তের চিঠি ইস্যু করেন)।  গত ২৯ জুন ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে তদন্ত করেন তিনি। তদন্ত করে এমনকি প্রধান শিক্ষক সহ সংশ্লিষ্টদের চাপ দিয়ে বেতন-ভাতা ছাড় করাতে ব্যর্থ হয়ে এবার মাউশির ইমআইএস সেল থেকে বেতন-ভাতা ছাড় করান তিনি। আইবাস ডাবল প্লাস সফটওয়ারে প্রতিষ্ঠান থেকে ঐ ছয় শিক্ষকের তথ্যের ভুল (ব্যাংক একাউন্ট ইনভেলিড) সংশোধন না করলেও তিনি ইএমআইএস সেল থেকে গত জুন মাসের বেতন ছাড় করান। শুধু জামালপুর জেলা নয়, পুরো ময়মনসিংহ বিভাগের যত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের তদন্ত হয়েছে সব অভিযুক্ত শিক্ষকদের বাঁচাতে তিনি অগ্রভূমিকায় আছেন। 

এ বিষয়ে অধ্যাপক শিশিরের ভাষ্য, তিনি মাউশির ডিরেক্টর হিসেবে প্রয়োজনে যে কাউকে কল দিতে পারেন। তাছাড়া বিএনপির একজন সংসদ সদস্য তাকে অনুরোধ করেন। তাই তিনি ফোন করেছেন। 

মাউশির মাধ্যমিক শাখার তদন্তের স্বঘোষিত দায়িত্বে শিশির

মাধ্যমিক পর্যায়ের বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ ও আর্থিক দুর্নীতি কিংবা কোন অনিয়মের অভিযোগ মাউশিতে জমা হলে তার ফাইল  যায় মাউশির মাধ্যমিক শাখায়। নিয়মানুযায়ী মাধ্যমিক শাখা সেই ফাইল মাউশির মহাপরিচালকের অনুমোদন নিয়ে তদন্তের চিঠি ইস্যু করে তা জেলা শিক্ষা অফিসার কিংবা মাউশির আঞ্চলিক উপ-পরিচালক (মাধ্যমিক) কে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেয়। সেই প্রতিবেদনের আলোকে পুনরায় ডিজির অনুমোদন নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করে মাউশির মাধ্যমিক শাখা। মনিটরিং এর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে শিক্ষার মান মূল্যায়ন এবং দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দেওয়ার দায়িত্বে থাকা ‘অনিক’ কর্মকর্তা মনিটরিং এন্ড ইভালুয়েশান উইংয়ের পরিচালক অধ্যাপক শিশির ব্যস্ত মাধ্যমিকের তদন্ত নিয়ে। তদন্ত মানেই আর্থিক লেনদেন। এসব তদন্তের জন্য মাউশির মহাপরিচালকের অনুমোদনও প্রয়োজন হয় না তার। গত ১ জুন ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার দক্ষিণখানে অবস্থিত হাজী বিল্লাত আলী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নিজ দপ্তরে অভিযোগ নিয়ে নিজের স্বাক্ষরেই তদন্তের চিঠি ইস্যু করে নিজেই তদন্তকর্মকর্তা বনে সরেজমিনে তদন্ত করেন তিনি। তদন্তের চিঠিতে মাউশির মহাপরিচালকের অনুমোদনক্রমে লিখলেও এ বিষয়ে কিছুই জানেন না মাউশি ডিজি। অভিযোগ রয়েছে তদন্তে গিয়ে ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নিকট থেকে ৫ লাখ টাকা নেওয়ার।

#মাউশির মাধ্যমিকের শিক্ষা কর্মকর্তা নাজিমের তদন্ত ফাইলে ঘুস-দুর্নীতি ও অবৈধ ব্যবসা নিয়ে আসন্ন প্রতিবেদনে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়#

মাউশির কর্মকর্তারা বলছেন, মাধ্যমিক পর্যায়ের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন প্রধান শিক্ষক কিংবা শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তা আমলে নিয়ে তদন্তের চিঠি ইস্যু করবে মাউশির মাধ্যমিক শাখা। এখানে মনিটরিং শাখা থেকে তদন্তে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। 

শেখ হাসিনার পক্ষে শিক্ষা ভবনে মিছিল করা শিক্ষা ক্যাডারের ১৬ কর্মকর্তার কাছ থেকে ৮৬ লাখ টাকা আদায় 

গত বছরের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘এ যুগের রাজাকার’ উল্লেখ করে মন্তব্য করেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। এর পরপরই বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ৩ আগস্ট চট্টগ্রামে নওফেলের বাসভবনে হামলা চালায়। এই হামলার প্রতিবাদে পরদিন ৪ আগস্ট শিক্ষাভবনে বিক্ষোভ করেন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। প্রথমে তারা শিক্ষাভবন চত্বরে স্লোগান দিয়ে মহড়া দেন। এরপর প্রধান ফটকের সামনে জড়ো হয়ে ‘চলছে লড়াই চলবে, শেখ হাসিনা লড়বে’, ‘শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’, ‘শিক্ষামন্ত্রীর (নওফেল) বাসায় হামলা কেন, খুনি খালেদা জবাব দে’—এমন বিভিন্ন স্লোগান দেন। ওই মিছিলে অংশ নেন প্রায় ৪০ জন ক্যাডার কর্মকর্তা, যারা ওই সময় ডিআইএ, মাউশি এবং বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন। ওই দিনের আলোচিত মিছিলে নেতৃত্ব দেন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও শিক্ষা ক্যাডারের ৩১তম ব্যাচের কর্মকর্তা মুকিব মিয়া, যিনি আওয়ামী লীগের লিফলেট বিতরণ করে কারাগারে আছেন। এছাড়া এই মিছিলের সম্মুখ সাড়িতে ছিল পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের ১৬ জন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা যারা বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের পদধারী নেতা ছিলেন। 

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শিক্ষা প্রশাসনের জাতীয়তাবাদী প্যানেল থেকে প্রথম সিঙ্গেল অর্ডারে ডিআইএ’র পরিচালক পদে পদায়ন পান (২৪ আগস্ট)  প্রফেসর কাজী কাইয়ুম। পদায়নের মাস খানেক পরেই শিক্ষা ভবনে মিছিল করা ডিআইএ’র ১৬ জন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাকে শোকজ করেন। শোকজের পর চলে দেন দরবার। ১৬ জনের মধ্যে ৭ জন কর্মকর্তা দেন জনপ্রতি ১০ লাখ টাকা আর বাকি ৬ জন কর্মকর্তা দেন ৩-৪ লাখ টাকা করে। প্রায় ৮৬ লাখ টাকা আদায় করে সেই শোকজের ফাইল গায়েব করে দেন এই কর্মকর্তা। সে সময় গণমাধ্যমকে শিশির বলেছিলেন, “৪ আগস্ট শুধু ডিআইএ নয়, শিক্ষাভবনের অনেকেই স্লোগান দিয়েছেন। অন্য দপ্তরগুলো কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। এখন আমি যদি ব্যবস্থা নিতাম তাহলে সমালোচনা হতো।” 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিআইএ’র তৎকালীন একজন উপ-পরিচালক বলেন, শিক্ষা ভবনে মিছিল করা ডিআইএ’র কর্মকর্তাদের প্রথমে শোকজ করা হয়। এরপর দরকষাকষি করে টাকা উত্তোলন করেন তিনি। এই টাকা উত্তোলন করে দেন ডিআইএ’র সাবেক যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস।  প্রায় কোটি টাকা নেওয়ার পর শোকজের কাগজপত্র গায়েব করে ফেলেন তিনি। 

শুধু এই মিছিল করাদের নিকট থেকে অর্থ আদায়ই নয় সারাদেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক এবং প্রশাসনিক অনিয়ম ও দুর্নীতি ধরার দায়িত্বে থাকা ডিআইএর পরিচালক অধ্যাপক কাইয়ুম শিশির মিনিস্ট্রি অডিটের প্রতিটি ট্যুর বিক্রি করতেন। এই ট্যুর বিক্রি ও ঘুস-বাণিজ্যের আধিপত্য বিস্তারে ডিআইএ’র যুগ্ম পরিচালক আবুয়াল কায়সারের সাথে দ্বন্দ্ব ও বিশৃঙ্খলায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। পদায়নের তিন মাস না যেতেই ঘুস দুর্নীতিতে জড়িয়ে পরায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২১ নভেম্বর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে তাকে ময়মনসিংহের মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজে বদলি করে।

ঘুস দুর্নীতির  সুনির্দিষ্ট অভিযোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বদলি করলেও ফের মাউশির পরিচালক পদে পদায়ন

মিছিল করা ক্যাডার কর্মকর্তাদের থেকে অর্থ আদায়, ডিআইএ’র ট্যুর বিক্রি ও ঘুস-বাণিজ্যের আধিপত্য বিস্তারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গত ২১ নভেম্বর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে তাকে ময়মনসিংহের মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজে বদলি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।  ২৫ নভেম্বর তিনি দপ্তর থেকে নিয়মমাফিক ছাড়পত্র নিলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট তার বদলি তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন। সেই আদেশ নিয়ে গত ৮ ডিসেম্বর ভোরে ডিআইএ-তে আসেন তিনি এবং জোর করে তার অফিসকক্ষ দখল করেন। তার বিরুদ্ধে ডিআইএর পক্ষ থেকে শাহবাগ থানায় জিডিও করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে বদলির আদেশ বহাল রাখে। এরপর শিশির ময়মনসিংহের মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজে যোগদান করলেও একদিনও কলেজটিতে উপস্থিত হননি। এর মাস দুয়েক পরেই তিনি মাউশির মনিটরিং এন্ড ইভালুয়েশান উইংয়ের পরিচালক পদে পদায়ন পান। ঘুস দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, আওয়ামী ক্যাডার কর্মকর্তাদের থেকে কোটি টাকা আদায়, শিক্ষা ক্যাডার ও নিজ দপ্তরে অর্থের বিনিময়ে পদায়ন করাতে একটি বলয় গড়ে তোলার চেষ্টা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বদলির আদেশকে চ্যালেঞ্জ করেও তিনি মাউশির পরিচালক পদে পদায়ন পাওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠে শিক্ষা ক্যাডারে। কিভাবে এই পদে আসলেন তার জবাব মেলেনি কারও কাছে। 

শিক্ষা ভবনে মিছিলকারীদের ফের তলব করেন  অনিক কর্মকর্তা শিশির, নেপথ্যে কী?

প্রায় কোটি টাকা ঘুস নিয়ে শিক্ষা ভবনে মিছিলকারী ডিআএ’র কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ না করে শোকজের ফাইল গায়েব করে দেওয়া তৎকালীন ডিআইএ’র পরিচালক এবং বর্তমান মাউশির মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন উইংয়ের পরিচালক অধ্যাপক কাজী মো. আবু কাইয়ুম শিশির অধিদপ্তর ও প্রকল্পে থাকা ২১ জন ক্যাডার কর্মকর্তাকে গত ২৪ জুন ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্যক্তিগত শুনানিতে ডাকেন। দ্বিতীয় ধাপে শুনানির জন্য আরও ২০-২২ জন ক্যাডার কর্মকর্তাকে ডাকবেন তিনি। আওয়ামীপন্থী মিছিলকারী ১৬ ক্যাডার কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কোটি টাকা ঘুস নিয়ে বাঁচিয়ে দেওয়া শিশিরই এবার নেমেছে ফের আওয়ামীপন্থী ক্যাডারদের ধরতে।  বিষয়টি জানেও না মাউশির ডিজি, পরিচালক (প্রশাসন) এমনকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও।

মাউশির নিয়োগে জালিয়াতির অভিযোগে কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত শুনানী করেন শিশির 

২০২০ সালের ২২ অক্টোবর মাউশির অধীনে ২৮টি পদে ৪ হাজার ৩২ জনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন পদে ৩ হাজার ৪২২ জনের চূড়ান্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এই নিয়োগে প্রশ্নফাঁসসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। ওই চক্রটি প্রশ্ন ফাঁস করে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে ওই পরীক্ষাটি বাতিলও করা হয়। এ ছাড়া এই নিয়োগে ‘প্রদর্শক’ ক্যাটাগরির দশম গ্রেডের পদগুলোকে তৃতীয় শ্রেণি দেখিয়ে মাউশি নিজেরা নিয়োগ দিচ্ছে। এটা সম্পূর্ণরূপে সরকারি চাকরি বিধিমালার পরিপন্থি। ওই নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন মাউশির কলেজ ও প্রশাসন শাখার তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী এবং সদস্য সচিব ছিলেন তৎকালীন উপপরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) মো. রুহুল মোমিন। পরিবর্তিতে নানা অনিয়মের অভিযোগে রুহুল মোমিনকে বদলি করা হয়। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস। তিনিও আগের ধারাবাহিকতায় নিয়োগে নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে।

এই নিয়োগে ৫শ কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন এবং দুর্নীতির অর্থ ভাগ-বাটোয়ারার অভিযোগ যাচাই করতে গত ১ জুলাই ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে শাহেদুল খবির চৌধুরী, বিপুল চন্দ্র বিশ্বাসকে ডেকেছিল অনিক কর্মকর্তা শিশির। তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে জবানবন্দি।

নামে পরিচালক ক্ষমতায় মাউশির ডিজিরও উপরে

মাউশিতে  দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তা (অনিক) পদাধিকারবলে মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন উইংয়ের পরিচালক। সে হিসেবে অনিকের দায়িত্বে অধ্যাপক শিশির। ডিজির অনুমোদন ছাড়া এবং সংশ্লিষ্ট শাখায় না পাঠিয়ে মাধ্যমিক উইংয়ের তদন্তের কাজ নিজে করা, এমনকি ডিজিকে না জানিয়ে শিক্ষা ক্যাডারদের ডেকে ব্যক্তিগত শুনানী করা, অধ্যাপক শিশির এগুলো করছেন ‘অনিক’ অর্থ্যাৎ অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা-সংক্রান্ত নির্দেশিকা, ২০১৫ (পরিমার্জিত ২০১৮) এর ধারার অপব্যাখা দিয়ে। অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তার কাজ মূলত সরকারি দপ্তরের কোন সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে কেউ অভিযোগ দায়ের করলে অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তা অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করবেন, সংশ্লিষ্ট দপ্তর তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তাকে অবহিত করবেন। অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তা অভিযোগের কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা অভিযোগকারীকে  অবহিত করবেন। অনিক কর্মকর্তা প্রতিটি অভিযোগের বিষয়টি মাসিক এবং বাৎসরিক প্রতিবেদন তৈরি করে তার সংশ্লিষ্ট দপ্তর প্রধানকে জানাবেন। সেবা প্রদানে একই অভিযোগ যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সেই উদ্দেশ্য সাধন করা মূলত অনিকের কাজ। 

মাউশির ‘অনিক’ এর পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট্য একটি আহ্বায়ক কমিটি করার কথা থাকলেও অনিকের ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে শিশিরই সব। কোন কমিটি যেমন নেই, তেমনি পুরো মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন উইংকে অনিকের কার্যালয়ে রুপান্তর করেছেন তিনি। এই শাখার সকল কর্মকর্তা কর্মচারী এখন অনিকের তদন্ত এবং শুনানীর কাজে ব্যস্ত। 

অনিকের ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে গত মে মাসের শেষে মাউশির কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি বৈঠক করেন শিশির। বৈঠকে অনিকের কাজ কি কি সেগুলো নিয়ে আলোকপাত হলেও অনিকের মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে মনিটরিং ইউংয়ের কাজ ফেলে অনিকের ক্ষমতাবলে তদন্ত কার্যক্রমে জেলা উপজেলায় যাচ্ছেন এবং মনিটরিং উইং থেকে ফাইল উঠিয়ে চিঠি ইস্যু করছেন। একই ধারায় শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত শুনানি করেছেন তিনি।

সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে শৃঙ্খলা ও অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ‘অনিক’ (অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তা) বা অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনায় একজন কর্মকর্তাকে মনোনীত করা হয়। সংবিধানের ২১ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এই কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষমতা দিয়েছে। মাউশির ক্ষেত্রে মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন উইংয়ের পরিচালক এই ‘অনিক’ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। অনিকের  কার্যপরিধির ৫.১.২. অনুচ্ছেদের (চ) ধারায় বলা আছে, ‘প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত যে কোনো সংবাদ, প্রতিবেদন বা চিঠিপত্রে অভিযোগের উপাদান থাকলে, সেগুলো পরীক্ষান্তে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।’ শিশির কর্তৃক গণমাধ্যম দেওয়া বক্তব্যে জানা গেছে, এই ধারার ক্ষমতাবলেই তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ডেকেছেন। এরপর ৭.১ অনুচ্ছেদের খ-এর ‘গ’ ধারায় উল্লেখ আছে, এসব অভিযোগ সম্পর্কিত নথি, প্রতিবেদন, সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র লিখিত/মৌখিক বক্তব্য আকারে গ্রহণ করে তার প্রতিকার করা যাবে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অনিক সাক্ষ্যগ্রহণ ও তদন্ত করতে পারবেন এবং শাস্তির বিধান উল্লেখ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার জন্য নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পেশ করতে পারবেন। কিন্তু ৭.১.২ অনুচ্ছেদের ক ও খ ধারায় বলা আছে, অভিযোগ তদন্তের ক্ষেত্রে অনিক দপ্তর প্রধানের অনুমোদনক্রমে তদন্ত করতে পারবেন।  অনিকের ক্ষমতায় অধ্যাপক যে কার্যক্রমগুলো করছে একদিকে যেমন অনিক কমিটির কারও মতামত নেওয়া হচ্ছে না অন্যদিকে দপ্তর প্রধান (মাউশি ডিজি) এর কোন ধরণের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। একদিকে যেমন তিনি টাকা নিয়ে মিছিলকারীদের রক্ষা করেছেন অন্যদিকে ফের ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অনিকের নামে এই কর্মকান্ডগুলো চালিয়ে যাচ্ছে। 

মাউশির মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে প্রতিমাসে মাসিক সমন্বয় সভা মাউশিতে অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় কখনও যোগদান করেননি অধ্যাপক শিশির। এই সভায় যোগদান কেন করেন নি তা জানানোর প্রয়োজন বোধও করেননি। মাউশির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মূলত মাউশির ডিজিকে তিনি ডিজি বলে মনেই করেননা। এই চেয়ারে তিনি বসবেন সেটা তিনি নিজের মুখেই বলে বেড়ান। এছাড়া মাউশির ডিজি অধ্যাপক আজাদ খান তার ছোট তিনি তার বড় সব জায়গাতেই এই একই কথা বলে বেড়ান। 

কর্মজীবনের সিংহভাগ সময় কলেজে পদায়ন থাকলেও কখনও কলেজমুখী হননি তিনি, নেননি কোন ক্লাস

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করা অধ্যাপক শিশির কর্মজীবনে ঢাকাসহ বিভিন্ন সরকারি কলেজে পদায়ন থাকলেও দুই মাস অন্তর অন্তর একদিন তিনি কলেজে উপস্থিত হয়েছেন। তবে কখনও নেননি ক্লাস। ডিআইএর পরিচালক পদে পদায়নের আগে প্রায় দেড় বছর কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে কর্মরত ছিলেন। এই দের বছরে একটি ক্লাসও নেননি তিনি। ডিআইএর পরিচালক পদ থেকে মাউশির ডিরেক্টর পদে আসার মাঝের কয়েক মাস পদায়ন ছিলনে ময়মনসিংহের মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজে। তবে কলেজটির মাটিতে শুধু যোগদান ছাড়া তা পা পরেনি। সব মিলিয়ে পাঁচ থেকে সাত দিন তিনি কলেজটিতে উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘদিন রাজধানীর ইডেন কলেজে পদায়ন থাকলেও কখনও তিনি ক্লাস নেননি। তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে ইডেনে খাদ্য সরবারহ করা হয়েছে। সে ই খাবার সরবরাহের কাজে তিন মাঝে মাঝে ইডেন কলেজ উঁকি দিতেন। 

শিশিরের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা এবং শিক্ষা সচিব কর্তৃক গুরুদণ্ড প্রদানের ফাইল গায়েব

পটুয়াখালী সরকারি কলেজে কর্মকালীন ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ থেকে ৩১ মার্চ ২০২৩ ইং তারিখ  পর্যন্ত ৯০ (নব্বই) দিন অননুমোদিতভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন কলেজটির ইংরেজি বিভাগে কর্মরত অধ্যাপক শিশির। টানা ৯০ দিন কলেজে অনুপস্থিত থাকায় পটুয়াখালী সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন। তদপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) ও ৩(গ) অনুযায়ী “অসদাচরণ” ও “পলায়ন” এর অভিযোগে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। এই প্রেক্ষিতে অধ্যাপক শিশিরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হলে শোকজের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ৭(২)(ঘ) অনুযায়ী তদন্তের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় এবং  তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদনে শিশিরের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়।  শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ  নথিপত্র পর্যালোচনায় এবং তদন্ত প্রতিবেদনের প্রদত্ত মতামতের আলোকে আপনার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) ও ৩(গ) অনুযায়ী “অসদাচরণ” ও”পলায়ন” এর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় উক্ত অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে শিশিরের বিরুদ্ধে গুরুদণ্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। 

শেখ হাসিনা দেশত্যাগের ঠিক এক মাস আগে অর্থ্যাৎ ৩০ জুন ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা সচিব সোলেমান খান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, “কাজী মো: আবু কাইয়ুম (১০৩৫৭), অধ্যাপক (ইংরেজি), কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম-কে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) ও ৩(গ) অনুযায়ী “অসদাচরণ” ও “পলায়ন: এর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আপনার বিরুদ্ধে গুরুদন্ড আরোপের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায় একই বিধিমালার ৭(৯) বিধি অনুযায়ী কেন আপনাকে চাকরি হতে বরখাস্ত বা বিধিতে বর্ণিত অন্য কোনো গুরুদন্ড প্রদান করাহবে না তার জবাব এ নোটিশ প্রাপ্তির ০৭ (সাত) কার্যদিবসের মধ্যে প্রেরণ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।” সে সময়ে আওয়ামী লীগের বেশ কিছু কেন্দ্রীয় নেতার সাথে ব্যবসায়িক সুসম্পর্ক থাকায় তিনি এই শোকজ ধামাচাপা দেন। এর ঠিক এক মাস পর শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করলে মন্ত্রণালয় থেকে তিনি তার ফাইলই গায়েব করে দেন। 

শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা সচিবকেও গোনার সময় নেই শিশিরের! 

গত ২১ নভেম্বর (২০২৪) ডিআই থেকে  বদলি করার পর গত ২৪ নভেম্বর তার রুমে কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে তার ক্ষোভের কথা জানান ‍শিশির। সেখানে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপদেষ্টা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সিদ্দিক জোবায়েরসহ একাধিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন।

এ সময় তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের লোকজন মনে করছে এই পদ (পরিচালক) আমার জন্য সোনার হরিণ। আমাকে বদলি করলে আমি বেহুঁশ হয়ে যাব। সিদ্দিক জোবায়েরের বাবারও সাধ্য নাই আমাকে ময়মনসিংহে পাঠানোর। প্রয়োজনে চাকরি করব না। সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার (সচিব) কন্ট্রিবিশন কী, কোন যোগ্যতায় শিক্ষা সচিব হয়েছেন সব জানিয়ে দেবো। চাকরিই যদি না করি তাহলে কে সিদ্দিক জোবায়ের, কে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি, কে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি, শিক্ষা উপদেষ্টাকে গোনার সময় আছে? মুখ্য সচিব সিরাজুল ইসলাম সাথী যদি মনে করেন দুই বছরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি তার জীবনের শেষ সময়, তাহলে তিনি মায়ের পেটে আছেন। ওয়ান ইলিভেনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও পরে আওয়ামী লীগ সরকার আমাকে নীলফামারিতে পোস্টিং করেও তিন বছর সেখানে পাঠাতে পারেনি। এখন না গেলে বেতন আটকাবে, এসব বেতনের ধার ধারে না শিশির।’

অসদাচরণের কারণে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের সদস্যপদ থেকে শিশিরকে বরখাস্ত

ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে অশালীন আচরণ এবং প্রশাসন ক্যাডারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের কারণে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের সদস্যপদ থেকে অধ্যাপক কাজী মো. আবু কাইয়ুম শিশিরকে গত ১৩ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ক্লাবের গঠনতন্ত্রের ১৯ (৪) (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কাইয়ুম শিশিরের বিরুদ্ধে এডহক কমিটিকে হুমকি, সদস্যদের সঙ্গে অশালীন আচরণ এবং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের নামে মিথ্যা কুৎসা রটনা করে ফেসবুকসহ ব্যক্তিগত ঠিকানায় পাঠানো এবং ক্লাবের পাওনা পরিশেষে ব্যর্থতার কারণে গত ১৩ সেপ্টেম্বর আপনাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আপনি কারণ দর্শানোর জবাব দেন নাই। তদন্ত কমিটি আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়েছে বলে প্রতিবেদন পেশ করেছে। যা ক্লাবের গঠনতন্ত্রের ১২। (৪) (খ) এবং ১৯। (১) (ক) (খ) (গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, বর্ণিত অবস্থায় এডহক কমিটির ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত সভায় ক্লাবের গঠনতন্ত্রের ১৯। (৪) (খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উল্লিখিত কার্যকলাপের কারণে আপনাকে ক্লাবের সদস্যপদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এমতাবস্থায় আপনাকে ক্লাবের সদস্যপদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।

আওয়ামী ছত্র ছায়ায় খাদ্য অধিদপ্তরের এক নম্বর ঠিকাদার শিশির

পাঁচ আগস্টের পর গিরিগিটির মত রঙ বদলানো শিশির আওয়ামী ছত্র ছায়া থেকে বের হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয়তাবাদি দলের একজন আওয়ামী আমলের বঞ্চিত কর্মকর্তা। বাংলাদেশ পুলিশ ও ইডেন কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খাবার সরবরাহ করতেন তিনি। এছাড়াও শিক্ষা ক্যাডারে যোগদানের বছর চারেক পর থেকেই একাধিক ঠিকাদারি ব্যবসা করছেন। ডিসেম্বর ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে শিশিরের নিজের এলাকা জামালপুরের ইসলামপুরের কুলকান্দি গ্রামের ইউপি সদস্য খলিলুর রহমান ও একই এলাকার আকরাম হোসেনের সাথে নিয়ে বালু নেওয়ার চুক্তি করে শিশির। যমুনা নদী থেকে বালু উত্তোলন করে সেনা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন জায়গায় ঠিকাদারির কাজে বালু দেন শিশির। এই বালুর ঠিকাদারি থেকে শ্রমিকদের কয়েক লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন শিশির। ফেব্রুয়ারি ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে  গোপনে বাড়িতে গেলেন ঐ ইউপিসদস্যসহ শ্রমিকেরা শিশিরকে মারধর করে অবরুদ্ধ করে। অবরুদ্ধকালে টাকা দিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থণা করে রক্ষা পান সে যাত্রায়। এছাড়াও তার রয়েছে একাধিক গার্মেন্টস, ইসলামপুরে রয়েছে খামারসহ ৮/৯টি ব্যবসায়ের সাথে জড়িত তিনি। 

স্ত্রী কলেজ শিক্ষিকা থাকেন লন্ডনে আর বাংলাদেশে বসে বেতন তোলেন শিশির

অধ্যাপক আবু কাইয়ুম শিশিরের পরিবারের সদস্যরা অর্থ্যাৎ তার দুই সন্তান এবং স্ত্রী বদরুন নাহার নিপা বসবাস করেন লন্ডনে। বদরুন নাহার নিপা রাজধানীর মোহম্মদপুরে অবস্থিত ঢাকা স্টেট কলেজের ইংরেজি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক। তিনি কলেজটিতে লন্ডনে বসবাস করলেও ইএফটিতে (ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার) তার বেতন-ভাতা উত্তোলন করছেন শিশির। জানা গেছে, আওয়ামী লীগের আমলে  দীর্ঘদিন কলেজটিতে অনুপস্থিত থাকায় বদরুন নাহারকে বরখাস্ত করে ঢাকা স্টেট কলেজ প্রশাসন। বরখাস্তের বিরুদ্ধে স্ত্রীকে দিয়ে হাইকোর্টে মামলা করান শিশির। পরবর্তীতে পাঁচ আগস্টের পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ থেকে বরখাস্ত প্রত্যাহার করে স্ত্রীকে স্বপদে পুনর্বহাল করে বেতন-ভাতা চালু করেন। প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ শিশিরকে মামলাটি প্রত্যাহার করার অনুরোধ করেন। মামলা পরিচালনায় পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছে সেই টাকা পেলে তিনি মামলা প্রত্যাহার করবেন। কলেজের পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ টাকা প্রদান করা হলেও এখন পর্যন্ত সেই মামলা প্রত্যাহার করেননি তিনি। স্ত্রী লন্ডনে আর বেতন তুলছেন অধ্যাপক শিশির।

নাম প্রকাশে না করার শর্তে কলেজটির কয়েকজন শিক্ষক জানান, বদরুন নাহার দুই মাস অন্তর অন্তর দুই একদিন কলেজে আসেন। আবার চলে যান। এভাবেই চলছে। তার স্বামী মাউশির ডিরেক্টর তার বিরুদ্ধে বলার সাধ্যকার, প্রশ্ন রাখেন তারা। 

মাউশি ডিজি পদে এক কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার চেষ্টার আলাপ ক্যাডার সার্ভিসদের মুখে মুখে

গত ইদুল আযহার ছুটির শুরু আগের দিন অর্থ্যাৎ ৪ জুন শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরারকে (সি আর আবরার) সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, “আমার কাছে তদবির এসেছিল যে একজনকে একটা বড় পোস্টিং দেওয়ার জন্য। তাঁর জন্য প্রথিতযশা একজন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল (বুদ্ধিজীবী) তিনিও আমাকে (তদবির) করেছিলেন। যেহেতু সেই নিয়োগ যুক্তিযুক্ত হবে না, মানে যিনি পদ চাচ্ছিলেন সেই পদে তাঁকে দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, তাঁর ট্র্যাক রেকর্ড ভালো নয়। আমরা সেটা প্রত্যাখ্যান করি। তখন তিনি অন্য পথে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছিলেন যে তাঁরা এত টাকা…করবেন। অঙ্কটাও বলে দিই, এক কোটি টাকা তাঁরা বলেছিলেন। যাঁকে বলেছিলেন, তিনি আমারই পরিচিতজন, যিনি একটি প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন।”

শিক্ষা ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এর মহাপরিচালক পদে পদায়ন নিতে অধ্যাপক শিশির কোন একটি মাধ্যম দিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টাকে এক কোটি টাকার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। 

অঢেল সম্পদ

২০০৭ সাল থেকে শিক্ষা ক্যাডারে একচেটিয়া বদলি বাণিজ্য করে প্রচুর অবৈধ অর্থ অর্জন করেন শিশির। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তিনি খাদ্য অধিদপ্তরের প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং বাংলাদেশ পুলিশ ও ইডেন কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খাবার সরবরাহ করতেন। ঢাকার গুলশান-২ এ রোড নং-২৭ এ বিলাসবহুল ৩টি ফ্ল্যাট, উত্তরার কনকর্ড গ্রীন প্লাজায় ফ্ল্যাট ও বাড্ডা এলাকায় নিজস্ব ৪তলা বাড়ী এবং নিজ জেলা জামালপুরে অভিজাত ডুপেক্স বাড়িসহ নামে বেনামে কয়েকটি শিল্প কারখানার মালিক হয়েছেন। তার নামে বেনামে অসংখ্য প্লট ও সঞ্চয় রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, পূর্বাচল ২১ নং সেক্টরে ‘চরি নামে ৬ কাঠা প্লট, ঢাকার উত্তরখানে ৯ কাঠা জমি। বিলাস বহুল জীবন যাপন করা শিশিরের গাজীপুরে যৌথ মালিকানাধীন একটি রিসোর্টও রয়েছে।

দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে প্রচুর বিত্তবৈভবের মালিক বনে যাওয়া শিশিরকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তলব করেছিল গত ২৫ নভেম্বর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে। দুদক যেসব অভিযোগে তাকে তলব করেছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাওয়া।,পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক পদে পদায়ন পাওয়ার পর কাইয়ুম বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অডিট ও তদন্তের নামে ভয়ভীতি ও নানা হয়রানির মাধ্যমে অবৈধ সুবিধা ও ঘুষ গ্রহণ করেছেন। তিনি এবং তার গড়া সিন্ডিকেট এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। জনতা ব্যাংক-এর বংশাল শাখা ও ব্রাক ব্যাংক-এর মতিঝিল শাখার ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখলে তার কোটি কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

মাধ্যমিকের কোন তদন্ত কার্যক্রম মাউশির মনিটরিং উইংয়ের পরিচালক কিংবা অনিক কর্মকর্তা পারেন কি’না জানতে চেয়ে মাউশির মাধ্যমিক শাখার পরিচালক প্রফেসর ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল দপ্তরে না থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে মাউশির ডিজি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আজাদ খানের বক্তব্য নিতে তার দপ্তরে গিয়ে একঘন্টা অপেক্ষা করলেও তিনি প্রতিবেদককে সাক্ষাৎকার দেননি।

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৪/০৭/২০২৫


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading