শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে এনসিটিবির চেয়ারম্যানের পদ শূন্য। তিন মাস হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের সদস্য পদেও নেই কোনো কর্মকর্তা। দুই দিন আগে পাঠ্যপুস্তক উইংয়ের সদস্যও চলে গেছেন হজে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি পদের তিন পদেই নেই কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। অবশ্য ভারপ্রাপ্ত হিসেবে একজনকে দায়িত্ব দেয়া হলেও পাঠ্যবই মুদ্রণ প্রক্রিয়া শুরুর এই সময়টাতে কোনোই অভিভাবকই যেন নেই এনসিটিবিতে। এই সুযোগে অনিয়ম আর দুর্নীতিও একসাথেই জেঁকে বসেছে বিনামূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণের তদারকির দায়িত্বে থাকা এই প্রতিষ্ঠানটিতে।
এদিকে ২০২৬ সালের বই মুদ্রণ কাজের প্রক্রিয়ার শুরুতেই অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে পছন্দের তিনটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিক পর্যায়ের অর্থাৎ প্রি-প্রাইমারির দেড় কোটি (আমার বই ও লেখার খাতা) বই ছাপার দায়িত্ব দিয়ে সাড়ে তিন কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে কয়েকজন কর্মকর্তার মাধ্যমে। বিষয়টি সবার মধ্যে জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর এটি নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা নিজেও উষ্মা প্রকাশ করেছেন। সূত্র জানায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রি-পাইমারির এই বইয়ের টেন্ডার বাতিল করে এখন রি- টেন্ডার অথবা সংশোধনী দিয়ে আবারো দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে নির্দিষ্ট ওই তিনটি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অন্যান্য মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানও প্রি প্রাইমারি বইয়ের টেন্ডারে অংশ নেয়ার সুযোগ পাবেন।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান গত ২৫ জানুয়ারি অবসরে চলে যাওয়ার পর তাকে পুনরায় দুই মাসের জন্য চুক্তিভিত্তিক হিসেবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই মেয়াদও গত ২৬ মার্চ শেষ হয়েছে। কিন্তু এরপর এখনো পর্যন্ত কাউকেই এনসিটিবিতে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়া হয়নি। তবে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এনসিটিবির শিক্ষাক্রম উইংয়ের সদস্য প্রফেসর ড. রবিউল কবীর চৌধুরীকে তার দায়িত্বের বাইরেও চেয়ারম্যান পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়। অর্থাৎ গত দুই মাস ধরেই চেয়রম্যান হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। অন্যদিকে এনসিটিবির অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ পাঠ্যপুস্তক উইং। এই উইংয়ের সদস্য পদটিও গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে শূন্য রয়েছে। আগে এই পদে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রফেসর ড. সারোয়ার জাহান। তিনি ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে বদলি হয়ে যাওয়ার পর এই পদেও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন প্রফেসর ড. রবিউল কবীর চৌধুরী। তিনি একাই এখন এনসিটিবির প্রধান তিনটি পদের দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে মেম্বার পাঠ্যপুস্তক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রফেসর রিয়াদ চৌধুরী। তিনিও আজ বৃহস্পতিবার পবিত্র হজ পালনের জন্য সৌদি আবরে যাচ্ছেন। অর্থাৎ এই পদটিও আজ থেকে শূন্য হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে মেম্বার অর্থ পদে দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ নায়ের আলী। তিনিও পারিবারিক একটি সমস্যার কারণে নিয়মিত কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, পাঠ্যপুস্তক উইংয়ের সদস্য রিয়াদ চৌধুরী হজ পালনের জন্য আজ বৃহস্পতিবার থেকে দীর্ঘ ছুটিতে যাচ্ছেন। তবে তার এই পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি অর্গানোগ্রামের বাইরে গিয়ে এবং নিয়ম লঙ্ঘন করে এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক প্রফেসর ফাতিহুল কাদীর সম্রাটকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী প্রফেসর ফাতিহুল কাদীর এই পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের পদাধিকার প্রাপ্ত নন। কিন্তু তারপরেও প্রফেসর রিয়াজ চৌধুরীর বেশ কিছু অনিয়মের এবং টেন্ডার জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশের ভয়ে তারই বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজন হওয়ার সুবাধে ফাতিহুল কাদীরকে এই পদের (মেম্বার পাঠ্যপুস্তক) অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে পাঠ্যপুস্তক উইংয়ের সদস্য প্রফেসর রিয়াদ চৌধুরী প্রাক প্রাথমিকের দেড় কোটি বই মুদ্রণের জন্য তিনটি প্রেস মালিকের নিকট থেকে মোটা অঙ্কের টাকা উৎকোচ নিয়ে দীর্ঘ ১৫ বছরের টেন্ডারের নিয়ম লঙ্ঘন করে বইয়ের ও কাগজের স্পেসিফিকেশন পরিবর্তন করে গত ১৯ মে টেন্ডার আহ্বান করেছেন। এতে নির্দিষ্ট ওই তিনটি প্রেস ছাড়া বাকি কোনো প্রেসই টেন্ডারের অংশ নেয়ার মতো উপযুক্ত ছিলেন না। কেননা ওই টেন্ডারে যে সাইজের বই বা কাগজ দেয়ার শর্ত দেয়া হয়েছে সেখানে তিনটি প্রেস ছাড়া অন্যদের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ ছিল না।
সূত্র জানায়, এনসিটিবির একটি চক্র তাদের অভিনব চালাকির মাধ্যমে তিন বিতর্কিত ছাপাখানাকে প্রাক-প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ দেয়ার সব আয়োজন চূড়ান্ত করে। ইতোমধ্যে গত ১৯ মে কায়দা করে টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। মেশিনের সাইজের এমন শর্ত যুক্ত করা হয়েছে যাতে সারা দেশে মাত্র দুই-তিনটি প্রতিষ্ঠানই বই ছাপার কাজ পায়। অভিযোগ রয়েছে টেন্ডারের এই পুরো প্রক্রিয়ায় প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য থেকে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের দুই কর্মকর্তা যারা দীপু মনি সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য হিসেবে ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছেন তারাই মূলত এসব বিষয়ে সবকিছু কলকাঠি লাড়ছেন। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও তাদের মুখোশ উন্মোচন করে ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে বক্তব্য বিবৃতিও প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে যারা অর্থের বিনিময়ে টেন্ডারে এমন শর্ত আরোপ করে নিজেদের মধ্যেই প্রি-প্রাইমারির বইয়ের মুদ্রণের কাজ ভাগাভাগি করতে চেয়েছিলেন তাদের বিষয়ে ইতোমধ্যে খোঁজখবর নেয়া শুরু হয়েছে। শিগগিরই তাদের বিষয়েও আরো বিস্তারিত তথ্য বেরিয়ে আসবে।
এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. বরিউল করীর চৌধুরী বলেন, পদ শূন্য থাকলে কাজের গতি কমে যাবে এটাই স্বাভাবিক। আমি নিজেও চাইছি এখানে একজন স্থায়ীভাবে চেয়ারম্যান পদে কেউ আসুক। এতে আমি আমার নিজের কাজে আরো বেশি মনোযোগ দিতে পারব। তবে যতদিন চেয়ারম্যান পদে কেউ না আসে ততদিন তো আমাকেই সব কাজ দায়িত্ব নিয়েই পালন করতে হচ্ছে।
অপরদিকে পাঠ্যপুস্তক উইংয়ের সদস্য পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণের বিষয়ে প্রফেসর ফাতিহুল কাদীর সম্রাট বলেন, বর্তমানে এনসিটিবিতে অনেক গুরুত্ব পূর্ণ পদেই কেউ নেই। অনেকগুলো পদ এখনো শূন্য। এই অবস্থায় আমাকে কোনো পদে যদি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেয়া হয় আমি নিজে সেখানে অপারগতা প্রকাশ করতে পারি না। এনসিটিবির অর্গানোগ্রামের বাইরে আপনাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর বাইরে তো এখন কিছু করারও নেই। কেননা উনি (মেম্বার পাঠ্যপুস্তক) হজে যাচ্ছেন। কাজতো কাউকে না কাউকে চালিয়ে নিতে হবে। সূত্রঃ নয়া দিগন্ত
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/২৯/০৫/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.