নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা: বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য নিঃস্বার্থ সর্বজনীন বদলি প্রথা চালু করা, সরকারি শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো ও শিক্ষা কমিশন গঠন করা, বৈষম্য নিরসনে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা ও এফটিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ ও শিক্ষক হয়রানি বন্ধ করাসহ ১৬ দফা দাবি জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষক ফোরাম।
শনিবার (১০ মে) বিকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে ফোরামের নেতারা এসব দাবি তুলে ধরেন। সেমিনারে তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ১৬ দফা দাবি জানানো হয়।
সেগুলো হলো:
- দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নয়নে ইসলামিক স্কলারদের সমন্বয়ে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা।
- বৈষম্য নিরসনে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা।
- সরকারি শিক্ষকদের ন্যায় ৪৫ শতাংশ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব ভাতা প্রদান করা।
- মাধ্যমিকের শিক্ষক সংকট কাটাতে প্রাইমারির ন্যায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও আলিয়া মাদরাসায় নারী কোটা বিলুপ্ত করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ এবং এনটিআরসি থেকে পাশকরা সবাইকে নিয়োগ দিয়ে শিক্ষক সংকট দূর করা।
- মাধ্যমিকে সিনিয়র সহকারী শিক্ষকদের সরাসরি সহকারী প্রধান ও প্রধান শিক্ষকের পদে নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা।
- ঘোষিত সকল ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা। যত দ্রুত সম্ভব প্রজ্ঞাপন জারি করা।
- অবসর ও কল্যাণ বোর্ডে বিশ্বস্ত সৎ জনবল নিয়োগ দিয়ে তহবিলের টাকা দ্রুত দেয়ার ব্যবস্থা করা।
- দেশের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস এর আলোকে সকল সেক্টরের সিলেবাস বিন্যাস করা। দেশের সকল পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ চালু করা।
- বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো ও শিক্ষা কমিশন গঠন করা।
- নিঃস্বার্থ সর্বজনীন বদলি প্রথা চালু করা।
- ইএফটিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ ও শিক্ষক হয়রানি বন্ধ করা।
- আসন্ন বাজেটে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া।
- আলিয়া মাদরাসার পাঠ্যপুস্তক পূর্বের ন্যায় মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক ছাপানোর ব্যবস্থা করা যাতে মাদরাসা শিক্ষার স্বকীয়তা বজায় থাকে।
- এক্সক্লুসিভ বা ইনক্লুসিভ ও বিভিন্ন জীবনধারার শব্দের মারপ্যাচে কোনভাবেই যেন ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ বা
- এলজিবিটিকিউ পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত না হয় সে ব্যপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা।
- দেশের সকল প্রাইমারি স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ প্রদান এবং ২০১৮ সালের প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক-শূন্য পদে নিয়োগ বঞ্চিতদের তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে দ্রুত নিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং
- আলিয়া মাদ্রাসায় ৩০ শতাংশ মহিলা শিক্ষিকা নিয়োগ বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত, মাদরাসা শিক্ষার ঐতিহ্য এবং ধর্মীয়
- মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। এতে মাদরাসা শিক্ষার শৃঙ্খলা ও স্বকীতায় প্রভাব পড়বে।
প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়, আমাদের ছেলেদের মাদরাসায় শতভাগ পুরুষ শিক্ষক এবং মেয়েদের মাদরাসায় শতভাগ নারী শিক্ষিকা নিয়োগ করা হোক। যা মাদরাসা শিক্ষার স্বকীয়তা বজায় এবং ধর্মীয় শৃঙ্খলা রক্ষা হবে বলে মনে করছে জাতীয় শিক্ষক ফোরাম।
বৈষম্য নিরসনে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করার পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নয়নে ইসলামিক স্কলারদের সমন্বয়ে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় শিক্ষক ফোরামের নেতারা।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ পর্যন্ত সাতটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের কুদরতিকুদা শিক্ষা কমিশন থেকে শুরু করে ২০১০ সালে কবির চৌধুরী কমিশন পর্যন্ত কোন কমিশনই বিতর্কের উর্ধ্বে ছিল না। বিগত দিনে শাসক গোষ্ঠী শিক্ষাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে রেজিমকে পাকাপোক্ত করেছে।
তারা বলেন, সবশেষে নতুন কারিকুলাম ছিল অন্তঃসারশূন্য। বিতর্কিত মূল্যায়ন পদ্ধতি, পরীক্ষাবিহীন ব্যবস্থা। বিদেশী প্রভুদের খুশি করার জন্য কারিকুলাম আমদানি করা হয়েছিল। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের মানুষের বোধ-বিশ্বাস, তাহজীব-তামুদ্দুনকে বিদায় করার ব্লু প্রিন্ট এঁকেছিল। শরীফ থেকে শরিফা অপ্রয়োজনীয় বিষয় অন্তর্ভুক্তি, প্লেজারিজমের মত জঘন্য ঘটনা ঘটেছিল। ট্রান্সজেন্ডার প্রমোট করা হয়েছিল। ইতিহাস বিকৃতি, অপ্রয়োজনীয় চিত্র, বিতর্কিত ছবি নাটক, গান-বাজনাসহ বিদ্যালয়গুলোকে নাট্যশালা ও রঙশালায় পরিণত করেছিল। একমুখী শিক্ষার নামে ঐতিহ্যবাহী আলিয়া মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে বলে তুলে ধরা হয় বক্তব্য
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, মাদরাসার স্বকীয়তা ও ঐতিহ্য মুছে ফেলার চক্রান্ত করা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গান ও চারুকলায় ২০ হাজার পদ সৃষ্টি করা হয়েছে, কিন্তু ধর্মীয় বিষয় থাকা সত্ত্বেও ধর্মীয় শিক্ষক এর পদ সৃষ্টি করেনি। ফলে কোটি শিক্ষার্থী ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার মত যথার্থ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষক দিয়ে ইসলাম শিক্ষা ক্লাস নেওয়ার নজির ফ্যাসিবাদী সরকার স্থাপন করেছিল। ফ্যাসিবাদ রেজিম পালিয়েছে কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া থিম শিক্ষা প্রশাসন বাস্তবায়ন করছে। বর্তমান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর কপি-পেস্ট করতে ব্যস্ত। তাই শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
২৪ এর গণ অভ্যুত্থানে প্রায় দুই হাজার ছাত্র জনতা রক্ত দিয়ে বিপ্লব সফল করেছে উল্লেখ করে বলা হয়, হাত, পা, চোখ ও অঙ্গহানির মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার বনি আদম মানবেতর জীবন যাপন করছে। বিপ্লবীরা স্বপ্ন দেখেছে নতুন বাংলাদেশের যেখানে থাকবে না জুলুম অত্যাচার, দুর্নীতি-দুঃশাসন, চিরতরে বন্ধ হবে বৈষম্য নামের মহামারী।
গত বছরের ৮ আগস্ট প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ ১১টি কমিশন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে শিক্ষা সংস্কার কমিশন সরকার গঠন করেনি। অথচ শিক্ষা হচ্ছে একটি উন্নত রাষ্ট্রের অন্যতম অনুষঙ্গ। এটাকে উপেক্ষা করে উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মান সম্ভব নয়। এটি নিয়ে দেশের বিবেকবান মানুষ, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, দেশ প্রেমিক জনতা, ছাত্র-শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তারা শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের দাবি করে আসছেন।
তারা বলেন, গত ৪০ বছর যাবত দেশে ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলো বৈষম্যের শিকার যা সীমাহীন কষ্টের এবং অকল্পনীয় দুর্ভোগের। ৫৩ বছরের শাসনামলে যারাই ক্ষমতায় মসনদে আসীন হয়েছে তাদের ভিতরে ইসলামফোবিয়া কাজ করেছে। মাদরাসা, ইসলাম শিক্ষা এবং আরবি শিক্ষায়তনগুলোকে অবহেলার চোখে দেখা হয়েছে। ইসলামী শিক্ষা সংকোচন নীতি গ্রহণ করতে দেখা গেছে। বৈষম্য রয়েছে মাধ্যমিক পর্যায়েও। কারিকুলাম বাস্তবায়নের নামে প্রায় দুই শত কোটি টাকা অপচয় করে রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে মুজিব শতবর্ষ পালনে সার্কুলার দেওয়া হয়েছিল। এজন্য সারা দেশে ১০ হাজারের বেশি ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণে খরচ হয়েছিল ৪ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া মাউশিসহ শিক্ষার প্রতিটি ধাপে ধাপে দুর্নীতি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তারা।
জাতীয় শিক্ষক ফোরামের সিনিয়র সহ-সভাপতি এবিএম জাকারিয়া তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, এই মুহূর্তে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের মাধ্যমে শিক্ষায় যে সকল পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়েছে তা হলো, শিক্ষার বৈষম্য নিরসনে জাতীয়করণ, শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নয়ন এবং ঝড়ে পড়া রোধ স্বাক্ষরতা বাড়াতে জাতীয়করণের কোন বিকল্প নেই।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১০/০৫/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.