ঢাকাঃ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি অঙ্কনকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)-এ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গ্রাফিতি অঙ্কনকে অন্যায় ঘোষণা দিয়ে শাস্তিস্বরূপ মুছে ফেলার নির্দেশনা দেয় কর্তৃপক্ষ। এরপরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন শিক্ষার্থীরা। ভাইস চ্যান্সেলরের পদত্যাগসহ ৫ দফা দাবি জানান তারা। বিষয়টি তদন্তে কাজ করছে একটি প্রতিনিধিদল। তবে শিক্ষার্থীরা উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী প্রশাসন জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।
গত ২৯শে ডিসেম্বর ইউল্যাব প্রশাসন দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ‘গ্রাফিতি অঙ্কন’কে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। শাস্তিস্বরূপ শিক্ষার্থীদের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে গ্রাফিতিগুলো মুছে ফেলার আল্টিমেটাম দেয়া হয়। রেজিস্ট্রার কর্তৃক অনুমোদিত একটি নির্দেশনায় গ্রাফিতি আঁকার অভিযোগে দুই শিক্ষার্থীকে ‘প্রবেশন’-এ রাখা হয়। শিক্ষার্থীদের দাবি- এই সিদ্ধান্ত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে অসম্মান করে। ঐতিহাসিকভাবে গণ-অভ্যুত্থানের সময় গ্রাফিতি একটি শক্তিশালী প্রতিরোধের মাধ্যম ছিল, যা শহর জুড়ে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসি ইমরান রহমান শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নেয়া শাস্তি প্রত্যাহারের ঘোষণা ই-মেইলের মাধ্যমে দেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাতে কোনো ক্ষমা বা ভুল স্বীকারের তথ্য ছিল না। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের দাবি- জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে অসম্মান এবং আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হয়রানির দায় নিয়ে ভিসি’র পদত্যাগ; ফ্যাসিবাদের দোসর এবং দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ট্রাস্টি বোর্ড থেকে অপসারণ; ডিসিপ্লিনারি কমিটি ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের পদত্যাগ; কোড অফ কন্ডাক্টের যৌক্তিক সংস্কার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা-ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সকল কালো আইন বিলোপ করতে হবে।
শিক্ষার্থীরা ১লা জানুয়ারি বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে ভিসি’র পদত্যাগ অত্যাবশ্যক বলে দাবি করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ফ্যাসিবাদ-সংশ্লিষ্ট এবং দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যদের ট্রাস্টি বোর্ড থেকে অপসারণের কথা বলেন। এর আগের দিন ৩১শে ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক একটি যৌথ বিবৃতি দেন। তারা গ্রাফিতিকে মত প্রকাশের শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নেয়া শাস্তিমূলক পদক্ষেপ অনৈতিক এবং গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটের প্রতি অসম্মানজনক। তারা দাবি করেন, বিদ্যমান আচরণবিধি সংশোধন করে শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের অধিকার সুরক্ষিত করতে হবে।
২রা জানুয়ারি কোনো সদুত্তর না পাওয়ায় দুই শিক্ষার্থী অনশন শুরু করেন। এদিন মধ্যরাতে ইউল্যাবের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ভিসি ও প্রো-ভিসি’র পদত্যাগের জন্য আল্টিমেটাম দিয়ে আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত করেন। তবে প্রশাসন আল্টিমেটামের সময়সীমা পার হওয়া সত্ত্বেও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। ফলে দু’জন শিক্ষার্থী বাধ্য হয়ে অনশন কর্মসূচি শুরু করেন। রাতে অনশনে থাকা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদের মধ্যস্থতায় রেজিস্ট্রার এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথা বলা হয়। রিপোর্ট প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত ভিসি তার দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকবেন এবং প্রো-ভিসি শুধু কার্যনির্বাহী দায়িত্ব পালন করবেন। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ব্যক্তি প্রকাশ্যে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব করবে না। আন্দোলনকারীরা আপত্তিকর গ্রাফিতি সরিয়ে দেবে এবং এজন্য দুঃখ প্রকাশ করবে। আন্দোলনকারীরা আন্দোলন প্রত্যাহার করে ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক কার্যক্রম ফিরিয়ে আনবে।
কিন্তু বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভিসিকে তার দায়িত্ব থেকে বিরত থাকার কথা থাকলেও, পরের দিন তিনি সকল শিক্ষার্থীকে একটি ই-মেইল পাঠান। ই-মেইলে তিনি আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস চালান। তিনি আন্দোলনকারীদের প্রতি তিরস্কারমূলক মন্তব্য করে প্রতিবাদের পরিবর্তে প্রশাসনের প্রতি আনুগত্যের পরামর্শ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে শিক্ষার্থীদের ছবি অ্যাপ করে লেখা হয়- উই স্ট্যান্ড উইথ ভিসি স্যার, সেভ ইউল্যাব, রেসপেক্ট টিচার্স ইত্যাদি স্লোগান।
বুধবার তদন্ত কমিটির সদস্যরা প্রশাসন এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। এতে ছিলেন ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমাসহ আরও দু’জন। শিক্ষার্থীরা জানান, আমরা তদন্তকারী কমিটিকে তথ্য দিয়েছি, আমাদের দাবি জানিয়েছি। আন্দোলনের সম্মুখে থাকা এক শিক্ষার্থী বলেন, ২০১০ সালের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বলা হয়েছে, ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা এমন কিছু করতে পারবেন না যাতে তা জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। তারা জাতীয় স্বার্থ ভঙ্গ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, গত বুধবার আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের মেইল করা হয়। সেই মেইলে আমরা নানাবিধ অন্যায়ের বিষয়টি তুলে ধরেছি। এই মেইলে দেখা যায়, ভিসি অধ্যাপক ইমরান রহমান সাম্প্রতিক আন্দোলনে যেসব শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন তাদের ইন্ট্রারগেশন সেলে পাঠান। এই সেলটাকে তারা আয়নাঘরের সঙ্গে তুলনা করেন। সেখানে মানসিক চাপ দেয়া, অশ্রাব্য কথা বলেন। ভিসি ভারতীয় একজন শিক্ষক সুদীপ চক্রবর্তীকে নিয়োগ দেন। যিনি ৩০শে জুলাই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। যার কোনো পিএইচডি ডিগ্রিও ছিল না। তারা বলেন, কয়েকজন শিক্ষক আছেন যাদের এখনো বেশ কিছু শিক্ষককে রানিং শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। কিন্তু আট বছরেও তারা কোনো ক্লাস নেননি। বিদেশি শিক্ষকদের শুধুমাত্র প্রোফাইল শো করা হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ট্রাস্টি বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান কাজী নাবিল আহমেদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যশোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও একাধিক সংসদীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি জেমকন গ্রুপের মালিক ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি। তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অপকর্মের অভিযোগ। সরকারি-বেসরকারি ভূমি দখল, মামলা দিয়ে স্থানীয়দের হয়রানি, মন্দির দখল, নদী দখল ইত্যাদি। বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান কাজী আনিস আহমেদ জুলাই বিপ্লবে বিরোধী অবস্থান নেন। শেখ হাসিনাপন্থি প্রচারে মোটা অংকের অর্থ ব্যয়ের অভিযোগ রয়েছে। নেত্র নিউজের সংবাদ অনুযায়ী, কাজী আনিস তার মালিকানার দুবাইভিত্তিক কোম্পানির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ডানপন্থি লবিং কোম্পানির সাহায্যে ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক মহলে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার চেষ্টা চালিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগও কোনো ধরনের অফিসিয়াল মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এসএমএ ফায়েজ বলেন, এই মুহূর্তে এ বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। যেহেতু তদন্ত চলমান। তিনি তদন্ত প্রতিবেদন আসার পরই যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৭/০১/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.