সৈয়দ ফারুক হোসেন।। চলতি শীত মৌসুমে সারা দেশের পাশাপাশি রাজধানীতেও শীতের তীব্র প্রকোপ বেড়েছে। ভোর থেকে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে ঘন কুয়াশা। পুরো রাজধানীতে জেঁকে বসেছে শীত। গত কয়েক দিন ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘন কুয়াশা পড়ছে। শীত থেকে বাঁচতে সকালে ভারী শীতবস্ত্র পরে অফিসমুখী হয়েছেন নগরের মানুষজন। ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা দেশ।
দেশজুড়ে তাপমাত্রার পতনের সঙ্গে বেড়েছে ঘন কুয়াশার দাপট। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কুয়াশায় ঢেকে গেছে চারদিক। এমন পরিস্থিতি আরও দুই-তিন দিন চলতে পারে বলে জানাচ্ছে আবহাওয়া অধিদফতর। আবহাওয়াবিদদের মতে, বর্তমানে যে কুয়াশা দেখা যাচ্ছে, তাকে ‘অ্যাডভেকশন ফগ’ বা পরিচালন কুয়াশা বলা হয়। এটি মূলত ভারত থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করেছে। ঢাকাসহ রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট এবং নোয়াখালী পর্যন্ত বিস্তৃত এই কুয়াশার প্রভাব। তবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এর প্রকোপ অপেক্ষাকৃত কম। সম্প্রতি রাজধানীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিনের তাপমাত্রাও স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম।
ডিসেম্বর মাসে বঙ্গোপসাগরে তিনটি লঘুচাপের কারণে তাপমাত্রা বেশি ছিল, ফলে শীতও ততটা পড়েনি। তবে বছরের শেষ দিক থেকে শীতের প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। দেশজুড়ে এমন শীতের প্রভাবে জীবনযাত্রা যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি মানুষের মনে শুরু হয়েছে শীতের উৎসবের আমেজ। তবে সতর্কতা ও সঠিক প্রস্তুতি ছাড়া এই শীত স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এবার শীত দেরিতে শুরু হলেও ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এসে মাঝারি আকারে এবং জানুয়ারিতে এসে হঠাৎ জেঁকে বসেছে। দিনভর দেখা মেলেনি সূর্যের। শহরে দিনের বেলাতেও হেডলাইন জ্বালিয়ে গাড়ি চলাচল করছে। ঘন কুয়াশার সঙ্গে হালকা ফোটা ফোটা বৃষ্টি। জেঁকে বসা শীতের সঙ্গে উত্তরবঙ্গে প্রবাহিত হচ্ছে শৈত্যপ্রবাহ।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ঢাকাসহ সারা দেশেই এ বছর বেশ ভালো মাত্রার শীত পড়বে। যে তাপমাত্রা অনুভব করা হচ্ছে, সেই শীতের অনুভূতি সামনে আরও বাড়বে। তীব্র শীত অনুভূত হওয়ায় মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এই বৈরী আবহাওয়ায়ও প্রয়োজনীয় কাজের জন্য ঘরের বাইরে আসতে হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে। বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে হাটবাজারের শ্রমিক ও কৃষি শ্রমিকদের। তীব্র শীতে খেটে খাওয়া মানুষের উপার্জন কমে গেছে।
হঠাৎ করে শীত বেড়ে যাওয়া শীতার্তরা ভিড় করছেন পুরাতন শীত নিবারণের কাপড়ের দোকানে। শীতকালে তাপমাত্রা কমতে কমতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছালে তাকে শৈত্যপ্রবাহ বলে ধরে নেওয়া হয়। আবহাওয়াবিদরা জানান, সমতল অঞ্চলে সাধারণত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে এবং স্বাভাবিক থেকে তার পার্থক্য ন্যূনতম ৫ ডিগ্রি হলে আবহাওয়ার সেই পরিস্থিতিকে শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। বাতাসে তাপমাত্রা সাধারণত ১০ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে। এর ফলে শীতে কাঁপছে মানুষ। এরই মধ্যে গ্রামের ফুটপাথে গরম কাপড়ের দোকানে ভিড় বাড়ছে মানুষের।
এ বছর শীত বেশ ধীরে এলেও তাপমাত্রা হঠাৎ করে কমে প্রচণ্ড ঠান্ডা শুরু হয়ে গেল। বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে শুরু করে জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত শীত থাকে। এ সময়ই শৈত্যপ্রবাহ দেখা যায়। একেকটি শৈত্যপ্রবাহ তিন থেকে সাত দিন, কখনো কখনো তারও বেশিও দীর্ঘায়িত হতে পারে। প্রতি বছরই শীতকাল আমাদের মাঝে আসে। আবার চলেও যায়। কিন্তু কষ্ট হয় অসহায় ও দুঃখী মানুষের। কিন্তু আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় অনেকেই গরম কাপড় কিনতে পারছে না। ফলে শীতে কষ্ট পাচ্ছেন নিম্নআয়ের ছিন্নমূল মানুষ। এদিকে শীতের পাশাপাশি চলছে বোরো আবাদের বীজতলা তৈরির কাজ। টানা শীত আর মৃদু শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকলে আসন্ন বোরো আবাদের বীজতলার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে গৃহপালিত পশুপাখি নিয়েও বিপাকে পড়েছেন খামারিসহ কৃষকরা। ঠান্ডা ও কুয়াশার কারণে বাইরে বের করতে করা যাচ্ছে না গবাদিপশু। কেনা খাবার খাওয়ানো যাচ্ছে না।
শীতে বেকাত্বের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তাদের। অসুস্থতায় ভুগছেন অনেকে। অতিরিক্ত ঠান্ডা, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশিসহ হৃদরোগে এ সময় অনেকে মারাও যান। যাদের মধ্যে বেশিরভাগ প্রবীণ ও শিশু। শীতের দুর্ভোগের ফলে তাদের এখন বেঁচে থাকাই দায়। ঘন কুয়াশার কারণে সূর্যের তেমন দেখা মেলেনি। কনকনে ঠান্ডায় বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। শহরে লোকজনের চলাচল অনেক কমে গেছে।
আগামী কয়েক দিনের মধ্যে শীতের প্রকোপ আরও বাড়বে। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকায় ঢাকাসহ দেশের উত্তরাঞ্চল আগামী দুই-তিন দিন নিয়মিত কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকবে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শৈত্যপ্রবাহে বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের চেয়ে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বেশি মারা যায়। চলতি মাসের গোড়ার দিকে ন্যাচারাল হ্যাজার্ডস রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় বলা হয়, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে শৈত্যপ্রবাহের প্রবণতা বেশি এবং মৃত্যুর হারও বেশি। বাংলাদেশে শৈত্যপ্রবাহ সংশ্লিষ্ট কারণে বছরে গড়ে ২৮১ জনের মৃত্যু হয় বলে সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
গত ২০ বছরে ৮১টি শৈত্যপ্রবাহের ঘটনা ঘটেছে। গবেষণায় এই সময়ের মধ্যে শৈত্যপ্রবাহের সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা গেছে। ‘কোল্ড ওয়েভ ইনডিউসড মর্টালিটিস ইন বাংলাদেশ : স্প্যাটিওটেম্পোরাল অ্যানালাইসিস অব ২০ ইয়ার্স ডাটা, ২০০০-২০১৯’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটনা ঘটে, এরপরই রয়েছে ডিসেম্বর মাস। শীত যেমন বাহারি আনন্দ বয়ে আনে ঠিক তেমনি অনেকের জন্য বয়ে আনে অনাবিল কষ্টও। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল, চর, হাওরাঞ্চলসহ শহরের ছিন্নমূল সুবিধাবঞ্চিত হতদরিদ্র নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ক্ষণস্থায়ী এই শীত আসে অভিশাপ হয়ে। বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই। এই শীতে দরিদ্র কৃষিজীবীরা প্রচণ্ড শীতে জবুথবু হয়ে পড়েন।
পূর্বাভাস শুনে মনে হচ্ছে, শীত এবার আটঘাট বেঁধেই নামবে। এতে খেটে খাওয়া মানুষের শীতের কষ্ট যেমন বাড়বে, তেমনি কমবে আয়ও। সব এলাকার ওপর দিয়ে শীতল হাওয়া অনবরত বয়ে যাওয়ায় তীব্র শীতে স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। শীতে খেটে খাওয়া মানুষজন বিশেষ করে কৃষি শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা ও ভ্যানচালকসহ নিম্নআয়ের মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। শীতজনিত অসুস্থতায় শিশু ও বয়স্ক মানুষের হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও বেড়েছে। অন্যদিকে পুষ্টিহীনতার কারণে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও তাদের কম। শীতের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে মানুষ।
প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না। প্রচণ্ড শীতে ঠান্ডাজনিত রোগ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক মানুষ ডায়রিয়া ও ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় ইতিমধ্যে এ ধরনের রোগী ভর্তি শুরু হয়ে গেছে অনেক হাসপাতালে। শীতের প্রকোপ অসহনীয় হয়ে উঠছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে শীতার্ত দুস্থদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়েও তেমন উদ্যোগ নেই। চলমান শৈত্যপ্রবাহের কারণে শীতের প্রকোপে নিদারুণ কষ্ট ও দুঃসহ অবস্থায় পড়ে মানবেতন জীবনযাপন করছে দেশের লাখ লাখ হতদরিদ্র, নিঃস্ব, ছিন্নমূল মানুষ। এ ছাড়া তীব্র বায়ূদূষণজনিত কারণে নানারকম শ্বাসকষ্টজনিত রোগও দেখা দিচ্ছে। উপরন্তু প্রতিদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে, বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।
আর্থিক দুরবস্থার কারণে অনেকেই শীতের গরম কাপড় কিনতে পারছে না। প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র না থাকায় দুস্থ ও গরিব মানুষ চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাই মানবিক কারণে শীতার্তদের পাশে দাঁড়ানো ধনী ও সামর্থ্যবান সবার নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন সুচিকিৎসা, ওষুধপথ্য এবং শীত মোকাবিলায় সরকারি বা বেসরকারিভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা গণহারে গুরুতর শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাদের চিকিৎসার ব্যাপারে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নিলে শীতের দুর্ভোগে মৃত্যুর হারও বাড়বে। এ জন্য আমাদের সবারই শীতার্ত বস্ত্রহীন মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
সাবেক রেজিস্ট্রার, বিএসএফএমএসটিইউ
শিক্ষাবার্তা /এ/০৭/০১/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.