এইমাত্র পাওয়া

শীর্ষ পদ এখনো সুবিধাভোগীদের দখলে

নিজস্ব প্রতিবেদক।।৫ আগস্টের পর দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও শিক্ষা সেক্টরে সংস্কার কাজে গতি আসেনি। সাড়ে তিন মাস পরও বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদগুলোতে এখনো বহাল তবিয়তেই রয়েছেন আওয়ামী আমলের সুবিধাভোগীরাই।

এমনকি রাজধানীতে অবস্থিত দেশের একমাত্র টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রীদের সুপারিশের একজনকে। আর দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে কাজ করে বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল।

এই কাউন্সিলের শীর্ষ পদ থেকে শুরু করে একাধিক সদস্যও রয়েছেন যারা আওয়ামী সরকারের মনোনীত ও নিয়োগকৃত। অপর দিকে হবিগঞ্জের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে যাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে সরাসরি আওয়ামী লীগের শিক্ষক ফোরামে সক্রিয় থাকার অভিযোগ রয়েছে।

এ সব বিষয়ে শিক্ষা প্রশাসনে চলছে চরম ক্ষোভ আর হতাশা। আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী এসব শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্বে রেখে শিক্ষা সেক্টরের সংস্কার কাজ কতটুকু কাজে আসবে তা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী আমলে ভিসি পদের তালিকায় থাকা অধ্যাপক ড. মো: জুলহাস উদ্দিন সম্প্রতি ভিসি হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি বুটেক্সের ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক। আওয়ামী লীগের তৃতীয় মেয়াদে ২০১৯ সালে বুটেক্সের তিন সদস্যবিশিষ্ট ভিসি প্যানেলের দুই নম্বরে ছিলেন এই অধ্যাপক।

সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের অনুসারীরাই ইউজিসির খণ্ডকালীন সদস্য কিংবা ভিসি প্যানেলে থাকেন। কিন্তু ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত, বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত এবং আওয়ামী লীগের আমলে বঞ্চিত এমন সব খোঁড়াযুক্তি দাঁড় করিয়ে ভিসি পদটি বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধ্যাপক ড. মো: জুলহাস উদ্দিনের পক্ষে পতিত সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও নেতা সুপারিশ করেছিলেন। সূত্র মতে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক রাষ্ট্রপতি মো: আব্দুল হামিদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং সাবেক শিক্ষাসচিব সোহরাব হোসাইনের স্বাক্ষর সংবলিত বুটেক্সের ভিসি প্যানেল অনুমোদনের চিঠি সম্প্র্রতি জনসম্মুখে প্রকাশ হয়েছে।

সেখানে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে বুটেক্সের ভিসি নিয়োগের জন্য তিন সদস্যের প্যানেল পাঠানো হয় শেখ হাসিনার কাছে। সেই তালিকায় এক নম্বরে ছিলেন অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো: আবুল কাশেম, দুই নম্বরে ছিলেন অধ্যাপক ড. মো: জুলহাস উদ্দিন এবং তিন নম্বরে ছিলেন ফ্যাব্রিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ আলিমুজ্জামান।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল সন্ধ্যায় অধ্যাপক ড. মো: জুলহাস উদ্দিন এই প্রতিবেদককে বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক। সে কারণেই হয়তো আওয়ামী লীগের তালিকায় আমার নাম ছিল। আর এটা তো ছিল পাঁচ বছর আগে। আমি আওয়ামী লীগের আমলে নির্যাতিত এবং বঞ্চিত একজন শিক্ষক। আমি সিনিয়র একজন অধ্যাপক। আমার প্রাপ্ততা এবং যোগ্যতা অনুযায়ীই ভিসি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছি।

এ দিকে গত ২ অক্টোবর হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এপিডেমিওলজি ও পাবলিক হেলথ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ সায়েম উদ্দিন আহম্মদ। যদিও মাত্র কিছু আগেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিচার চেয়ে বিবৃতি দিয়ে দাবিও জানিয়েছিলেন তিনি। (শিক্ষকদের বিবৃতিতে ১৪৮ সিরিয়ালে স্বাক্ষর করেন)।

বিক্ষুব্ধ কয়েকজন শিক্ষক জানান, অধ্যাপক সায়েম বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী স্বাধীনতার সপক্ষের সংগঠন গণতান্ত্রিক শিক্ষক পরিষদের মনোনীত প্যানেলে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটি ২০২২ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।

কিন্তু সম্প্রতি তিনি হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে যোগদান করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, ভুল তথ্য দিয়ে তিনি আগের সব পরিচয় গোপন করে ভিসি পদটি বাগিয়ে নিয়েছেন। এ বিষয়ে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক যোগ্য ও বঞ্চিত শিক্ষককে পাশ কাটিয়ে তিনি কৌশলে উচ্চশিক্ষার শীর্ষ পদটি দখল করেছেন।

এ বিষয়ে গতকাল সন্ধ্যায় তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, আমি কারোর বিচার চেয়ে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করিনি। আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। আমি নিজেই এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে গত ২৩ আগস্ট সিলেটের শাহ পরান (রহ:) থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছি। (প্রকৃত অর্থে ৫ আগস্টের পর তিনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করতেই এই ডায়েরি করেন)। আর আওয়ামী ফোরামের শিক্ষক সমিতির ব্যানারে নির্বাচিত হওয়ার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। মূলত আওয়ামী ফোরামের সাথে তার সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন।

অপর দিকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর শিক্ষা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তনের হাওয়া শুরু হলেও উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলে এখনো বহাল রয়েছেন আওয়ামী আমলের সেই সুবিধাভোগীরাই। আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় বিবেচনায় নিয়োগকৃত মেসবাহউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন পুরো কাউন্সিল বডি বহাল তবিয়তেই রয়েছে। তবে সম্প্রতি অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ও বিতর্কিত সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলের সংস্কারের দাবি উঠেছে।

জানা গেছে, ২০২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলের (বিএসি) চেয়ারম্যান হিসেবে আওয়ামী লীগের দলীয় বিবেচনায় দ্বিতীয় দফায় যোগদান করেন। এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের প্রধান ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন তিনি। কাউন্সিলের অন্য সদস্যদের মধ্যে ইসতিয়াক হোসেন বিগত সরকারের আমলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।

প্রফেসর ড. মো. গোলাম শাহি আলম ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। প্রফেসর ড. গুলশান আরা লতিফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রফেসর ড. এস এম কবীর ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক। এ ছাড়া খণ্ডকালীন সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন অধ্যাপকরা রয়েছেন।

তাদের মধ্যে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী আওয়ামী শিক্ষক সংগঠন স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মো: ফরাশউদ্দিন, খালেদা আক্তার, ড. জগন্নাথ পাতিল, প্রফেসর ড. হাবিবুল হক খন্দকার, প্রফেসর ড. এম লুৎফর ছিলেন আওয়ামী সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট।

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এ/২৪/১১/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.