নিজস্ব প্রতিবেদক।।জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে ২০ হাজারের বেশি মানুষ হতাহত হয়েছে। আহতদের বড় একটি অংশ মস্তিষ্ক, পেট ও চোখে গুলিবিদ্ধ হন। এমনকি হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে পেটের খাদ্যনালী পর্যন্ত ছিঁড়ে গেছে। দেশে সর্বোচ্চ চিকিৎসার পরও অনেকের অবস্থা সংকটাপন্ন। এসব রোগীকে উন্নত চিকিৎসা দিতে বিভিন্ন দেশে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জুলাই বিপ্লবে আহতদের চিকিৎসায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীনসহ বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বাংলাদেশে এসে চিকিৎসা দিচ্ছেন। এর বাইরেও অনেকের ক্ষেত্রে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন। সেই উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে এক শিশুসহ পাঁচজনকে বিদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এদের একজনকে সিঙ্গাপুর এবং চারজনকে থাইল্যান্ডে নেওয়া হয়। নতুন করে আরও অন্তত ২৫ জনকে থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। চলতি সপ্তাহেই এদের কয়েকজনকে নেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা।
গত ৫ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে মাথায় মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী কাজল। তিন মাস ধরে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পরও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় গত রবিবার রাতে থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়েছে তাকে। এ নিয়ে কাজলসহ এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে বিদেশে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ বাসিত খান মুসা। সাত বছর বয়সী এই শিশু সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। নতুন করে আরও ২৫ জনকে বিদেশে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে আগামীকাল থাইল্যান্ডে নেওয়া হচ্ছে মুরাদ ইসলামকে (৪০)। এরই মধ্যে তার ভিসাসহ সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
জানা গেছে, গুলশাল ক্যাফেরিয়া রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার মুরাদ গত ১৮ জুলাই অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথে রাত ৯টার দিকে মিরপুরের সেনপাড়ায় পানির ট্যাংক এলাকায় পৌঁছলে পুলিশের গুলিতে তিনিসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। ওই সময় ঘটনাস্থলে দুজনের মৃত্যু হলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান মুরাদ। গুলি তার গলার ডান পাশে ঢুকে বাম পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। শুরুতে তাকে স্থানীয় আল হেলাল হাসপাতালে ও পরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে চিকিৎসা পেতে নানা ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে বলে জানান মুরাদের বাবা আমিনুল ইসলাম।
আমিনুল ইসলাম বলেন, চারদিক থেকে গুলিবিদ্ধ রোগী আসায় চিকিৎসা পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে, সঙ্গে অবহেলা তো ছিলই। পরে ভাস্কুলার সমস্যার কথা বলে হৃদরোগে পাঠানো হয়, সেখান থেকে নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালে। তিন মাস ধরে মুরাদ এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি বলেন, ছেলের অবস্থা এতটাই সংকটাপন্ন ছিল যে চিকিৎসক মৃত্যুর সংবাদ শুনতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন। এখন কিছুটা উন্নতি হলেও নাক দিয়ে শ্বাস নিতে পারছে না। গলা থেকে পুরো শরীর অবস। হাত, পা ও শরীরের কোনো অংশই সক্রিয় নয়। এর জন্য রোবট থেরাপি দরকার, যা বাংলাদেশে নেই। এ জন্য সরকার দেশের বাইরে পাঠাচ্ছে।
একই হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ সিএনজিচালক আশরাফুলের (৪০) অবস্থা আরও সংকটাপন্ন। গুলিতে মাথার হাড় ভেঙে গেছে। বিদেশে নেওয়ার প্রয়োজন হলেও এখনও শারীরিকভাবে প্রস্তুত নন আশরাফুল। অবস্থার উন্নতি হলে তাকে নেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. হুমায়ন কবীর হিমু বলেন, মুরাদের অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। তাই উন্নত চিকিৎসায় দেশের বাইরে নেওয়ার সুপারিশ করেছে বোর্ড। শিগগির আরও কয়েকজনকে নেওয়া হবে।
অন্যদিকে মো. বাবুল নামে একজনের পেটের ওপর ভেসে উঠছে মলমূত্র। মেশিন দিয়ে পরিষ্কার করতে হচ্ছে। কিছু খেলেই বের হয়ে আসে। অবস্থা প্রতিনিয়ত গুরুতর হচ্ছে। এতে বার বার পিছিয়ে যাচ্ছে তাকে বিদেশে নেওয়ার উদ্যোগ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাবুল স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমানের ছেলে। পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর শনিরআখাড়ায় ভাড়া বাসায় থাকেন। ২০ জুলাই ধনিয়া কলেজের বিপরীত ছাত্র-জনতার সঙ্গে মারমুখী অবস্থানে ছিল পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী। এ সময় আকাশে উড়াল দিচ্ছিল হেলিকপ্টার। হঠাৎই একটি গুলি পেছন দিক থেকে আঘাত করে। এতে পেট থেকে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসে। তাকে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসা দিতে অনেকটা অস্বীকৃতি জানান চিকিৎসকরা। উল্টো মারধরও করা হয় বলে জানান বাবুলের বড় বোন সুবর্ণা।
১৭ আগস্ট বিএসএমএমইউতে নেওয়ার আগ পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে গিয়ে সাড়ে ৮ লাখ টাকা খরচ হয় বাবুলের পরিবারের। চিকিৎসার ভার বহন করতে গিয়ে ছেড়ে দিতে হয় ভাড়া বাসাও। বাবুলের আড়াই বছরের একটি সন্তান রয়েছে। সুবর্ণা বলেন, ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত মুগদা হাসপাতালে আওয়ামী লীগের চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিতে চাননি। এমনকি গুলিবিদ্ধ একজন আমার ভাইকে কয়েক দফা মারধরও করেছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে চিকিৎসা বিনামূল্যে শুরু হয়। এর আগ পর্যন্ত সাড়ে ৮ লাখ টাকা গেছে। কিন্তু অবস্থা প্রায়ই অবনতি হচ্ছে। বিদেশে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আগামী সপ্তাহে নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বাবুলের নিয়মিত ড্রেসিংয়ে ক্ষত সারানোর চেষ্টা চলছে। কিছু খেলেই বেরিয়ে যায়। শারীরিক সক্ষমতা না হওয়ায় অস্ত্রোপচারও করা যাচ্ছিল না। তবে এখন কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য শাহরিয়ার মাহমুদ ইয়ামিন বলেন, ‘যাদের অবস্থা খুবই জটিল ও সংকটাপন্ন তাদেরকেই দেশের বাইরে নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে ২৫ জনের মতো একটি তালিকা করা হয়েছে। এর বাইরে যাদেরই দেশের বাইরে নেওয়া প্রয়োজন বলে মত দেবেন চিকিৎসকরা, আমরা ব্যবস্থা করব। শিক্ষার্থী কিংবা সাধারণÑ যেই হোক, গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া প্রত্যেক আহতের চিকিৎসা রাষ্ট্র যাতে করে আমরা সেই পদক্ষেপ নিয়েছি।’
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। আরও ২০-২৫ জনকে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে তুরস্কে সাতজনকে পাঠানো হবে। এদের মধ্যে তিনজন চোখে আঘাতপ্রাপ্ত এবং বাকি চারজন অর্থপেডিকসের রোগী। এ নিয়ে তুরস্ক সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
নেপাল থেকে আনা হচ্ছে কর্নিয়া : আন্দোলনে আহত রোগীদের চোখে কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের জন্য নেপাল থেকে টিস্যু আনা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান সেবা ফাউন্ডেশন এই অতি সংবেদনশীল কর্নিয়াল টিস্যু সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে।
গত রবিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থী, শ্রমিক ও জনতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় সরকার বহন করবে। আহতদের দীর্ঘ মেয়াদি ও ব্যয়বহুল চিকিৎসায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রতিটি শহীদ পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। নেপাল থেকে কর্নিয়া আনা হয়েছে।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এ/১৯/১১/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.