এইমাত্র পাওয়া

শিক্ষকদের পাশে শিক্ষার্থীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক, সুনামগঞ্জঃ সারাদেশের মতো সুনামগঞ্জেরও কয়েকটি উপজেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে পক্ষে—বিপক্ষে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। সদ্য পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এসব শিক্ষক আওয়ামী লীগে সক্রিয় থাকা, অনিয়ম—দুর্নীতিতে যুক্ত হওয়া এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ক্ষোভ—বিদ্বেষ থেকেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে জেলা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা বলেছেন, শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা ও হেনস্থা করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

জানা যায়, গেল রবিবার ধর্মপাশা উপজেলার পাইকুরাটি ইউনিয়নের গাছতলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুমিতা বালা তালুকদার ও সহকারী প্রধান শিক্ষক দীনুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম দুনীর্তির অভিযোগ তুলে পদত্যাগ দাবি করেন শিক্ষার্থীরা। দুই শিক্ষকদের পদত্যাগের দাবিতে গাছতলা বাজারে বিক্ষোভ মিছিলও করে তারা। শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করে বিদ্যালয়ে গিয়ে জড়ো হয়। এ সময় প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক অফিস কক্ষে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিষয়টি জানতে পেরে উপজেলা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের এ ব্যাপারে খেঁাজ নিতে বলেন। পরে উপজেলা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থী আসিফ আহমেদ, আশরাফুল আলম আরিফসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে গিয়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও অভিযুক্ত শিক্ষকদের সাথে কথা বলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এসময় বিদ্যালয়ের সামনে ওই শিক্ষকদের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকে।

দুপুর একটার দিকে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাহবুবুল কবির ও উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার জাহাঙ্গীর আলম মোহাম্মদ ফারুক বিদ্যালয়ে উপস্থিত হলে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা তাদেরকেও বিষয়টি অবগত করে। পরে মাহবুবুল কবির ও জাহাঙ্গীর আলম মোহাম্মদ ফারুক অফিস কক্ষে যান এবং মাহবুবুল কবির শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়টি ইউএনওকে অবগত করেন। ইউএনও তখন ১০ মিনিটি সময় চাইলে অফিস কক্ষে উপস্থিত শিক্ষার্থী ও অভিভাবক এবং বাইরে অপক্ষেমান শিক্ষার্থীরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এসময় পরিস্থিতি সামাল দিতে সুমিতা বালা তালুকদার ও দীনুল ইসলাম সকলের উপস্থিতিতে স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন। পরে শিক্ষার্থীরা বাজারে আনন্দ মিছিল করে আর উপজেলা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা পদত্যাগপত্র ইউএনওর কাছে জমা দেন।

এদিকে, বিকেল তিনটার দিকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা দুই শিক্ষক ইউএনও কার্যালয়ে এসে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন নি দাবি করেন। তখন শিক্ষকেরা বিষয়টি বিবেচনা ও যাচাই বাছাই করার জন্য ইউএনওর কাছে সময় প্রার্থনা করেন। এ সময় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকেরাসহ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরাও উপস্থিত ছিলেন। পরে ইউএনও বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক লুৎফুর রহমানকে বিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব দেন এবং অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে না যাওয়ার নির্দেশ দেন।

উপজেলা নির্বাহী মো. গিয়াস উদ্দিন মঙ্গলবার ওই বিদ্যালয়ে সরেজমিনে গিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। ওই সময় তিনি শিক্ষার্থীদের জানান, শিক্ষকদের পদত্যাগের দুইটি কপি তার কাছে রয়েছে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

জেলার জগন্নাথপুরে রানীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সামাদের পদত্যাগের দাবিতে মঙ্গলবার বিক্ষোভ কর্মসূচি করেছে শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা বলেছেন, এই প্রধান শিক্ষক চার তারিখের আগে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ছাত্রদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।

মধ্যনগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে দুই শিক্ষকের পদত্যাগের পক্ষে—বিপক্ষে রবিবার কর্মসূচি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের চাপে পদত্যাগ করেন ইংরেজি শিক্ষক শরীফ উদ্দীন। অপর এক শিক্ষক শামীম আহমেদকে দুই মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। জানা গেছে, স্কুলে সময় কম দিয়ে প্রাইভেট ছাত্র পড়ানো নিয়ে এলাকার ক্ষুব্ধ ছাত্র—জনতা শরীফ উদ্দিনের উপর চড়াও হয়।

অন্যদিকে পরদিন সোমবার সকালে শিক্ষক শরীফ উদ্দীনকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগে বাধ্য করা ও শিক্ষক শামীম আহমেদকে সাময়িক বরখাস্ত করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন আরেকদল শিক্ষার্থী।

এছাড়াও মঙ্গলবার জেলার দোয়ারাবাজারে লিয়াকতগঞ্জ স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল কাদির অপসারণসহ নয় দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছে। জেলার ছাতক সরকারি ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তুলসি চরণ দাস পদত্যাগের দাবিতেও গেল বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা।

এদিকে, দেশব্যাপী শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা ও হেনস্থার প্রতিবাদে বুধবার দুপুরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে সুনামগঞ্জ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। বুধবার দুপুরে শহরের হোসেন বখত চত্ত্বরে এই কর্মসূচি হয়।

মানবন্ধনে শিক্ষার্থী নাহাত হাসান পৌলমী বলেন, সারাদেশে পদত্যাগের নাম করে শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা হচ্ছে। পদত্যাগের বিষয়টি হাতে কলমে হওয়ার কথা। আমরা শিক্ষার্থী হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সার্থকতা থাকবে না। শিক্ষক সমাজকে কেউ মান্য না করলে, শ্রদ্ধা না করলে কখনই রাষ্ট্র সংস্কার করা সম্ভব নয়।

শিক্ষার্থী ইমনদ্দোজা ইমন বলেন, কোনো শিক্ষক যদি স্বৈরাচারী সরকারের দোসর হয়ে থাকেন তাহলে আইন অনুযায়ী তার শাস্তি হবে। আমরা শিক্ষার্থীরা দাবি জানাবো, তাদেরকে কোনোভাবেই লাঞ্চিত বা হেনস্থা করতে পারি না। আমরা ছোটবেলায় পাঠপুস্তকে পড়েছি, শিক্ষাগুরুর মর্যাদা দিতে হবে। সেটি ভুলে গেলে হবে না।

সুনামগঞ্জ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি শহরের এইচএমপি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইনচান মিঞা বলেন, প্রত্যেক বিদ্যালয়েই পরিচালনা কমিটি আছে। কোন শিক্ষক অনৈতিক কাজে যুক্ত হলে, কমিটি বরাবরে অভিযোগ করা যেতে পারে। এখানে সুরাহা না হলে জেলা প্রশাসক বা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে বিভাগ হয়ে অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে যাবে। শেষে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সুনামগঞ্জ জেলা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামাল হোসেন বললেন, কোন শিক্ষকের রাজনৈতিক মত থাকতেই পারে। তিনি কোন অনিয়ম করে থাকলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটি। কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বিরোধ বা ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানো হচ্ছে, যা কাম্য নয়। আমাদের সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি এক্ষেত্রে ইতোমধ্যে বিবৃতিও দিয়েছে। এসব কার্যক্রমের নিন্দা জানিয়েছে। আইন নিজের হাতে নেবার বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখছে না কলেজ—মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি।

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বললেন, পদত্যাগে কোন শিক্ষককে বাধ্য করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট শিক্ষক স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন সভাপতির নিকট। সভাপতি রেজুলেশন করে জেলায় পাঠাবেন। জেলা থেকে বিভাগে। বিভাগ থেকে অধিদপ্তরে যাবে। বাধ্য করে পদত্যাগ করিয়ে আমাদের কাছে পাঠালেও, ওই শিক্ষক এসে আমাদের কাছে লিখিত দিলেই, আমরা সেটি আর অগ্রায়ণ করবো না।

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/২৯/০৮/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.