এইমাত্র পাওয়া

কারিকুলাম পরিমার্জন: প্রেক্ষিত প্রাথমিক শিক্ষা

আহাম্মেদ আলী রিয়াদ।।

পরিবর্তিত পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা এবং বৈশ্বিক আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে চলার পাশাপাশি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলা করার দক্ষতা অর্জনের জন্য আমাদের শিশুদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনার আলোকে শিক্ষাক্ষেত্রকে ঢেলে সাজানোর যে উদ্যোগ এরই মধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে, শিক্ষাক্রমের (কারিকুলাম) সাম্প্রতিক পরিমার্জন তারই একটি অন্যতম অংশ।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলায় ২০২১ এর পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের ভিশন (রূপকল্প)। বলাবাহুল্য, সময়ের সঙ্গে সংগতি রেখে শিক্ষাক্রমের (কারিকুলাম) উন্নয়ন ও পরিমার্জন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) একটি নিয়মিত ও গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সর্বপ্রথম ১৯৮৬ সালে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে উদ্দেশ্যভিত্তিক শিক্ষাক্রমের পরিবর্তে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কার্যক্রম হাতে নেয়, যা ১৯৮৮ সালে চূড়ান্ত রূপ পায়।

ডেলর কমিশন রিপোর্ট অনুযায়ী এ শিক্ষাক্রমের উন্নয়ন ও পরিমার্জন মূলত চারটি স্তম্ভ (জানার জন্য শিখন, কাজের জন্য শিখন, মিলেমিশে থাকার জন্য শিখন ও বিকশিত হওয়ার জন্য শিখন) এর ওপর প্রতিষ্ঠিত। তবে বাংলাদেশের শিক্ষাক্রমের পরিমার্জনে এই স্তম্ভগুলোর পাশাপাশি সমকালীন জাতীয় ও বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রেক্ষাপটও বিবেচনায় নেওয়া হয়। গত দুই দশকেরও অধিক সময়ে যুগের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের কারিকুলাম বেশ কয়েকবার পরিমার্জন করা হয়েছে। পূর্বের সবকটি পরিমার্জনের মূল লক্ষ্য যুগোপযোগী, অভিযোজনক্ষম দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা হলেও সর্বব্যাপী ওই পরিমার্জনকালীন সময়ে কোনো অভিপ্রেত কিংবা অনভিপ্রেত ঘটনা গোচরীভূত হওয়ার খবর তেমনভাবে প্রতিভাত হয়নি, যেমনটি সর্বশেষ পরিমার্জনের ক্ষেত্রে ঘটেছে।

গত ২০২১ সালে সর্বশেষ যে পরিমার্জিত কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে, তা কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণের দাবি রাখে।

বলাবাহুল্য, সর্বশেষ এই কারিকুলাম পরিমার্জনের কর্মযজ্ঞ ২০১৭ সালে শুরু হয়ে দীর্ঘ কয়েক বছরের প্রচেষ্টার মাধ্যমে ২০২১ সালে চূড়ান্ত রূপ নেয়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এর পূর্বে ২০১১ সালের পরিমার্জিত কারিকুলামে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা থাকলেও সাম্প্রতিক পরিমার্জনে দশটি মূল যোগ্যতাকে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়েছে।

এই যোগ্যতা অর্জনের জন্য যোগ্যতার বিভিন্ন ক্ষেত্রও কারিকুলামে স্থান পেয়েছে। তা ছাড়া পূর্বের কারিকুলাম পরিমার্জনগুলোর সঙ্গে ২০২১-এর পরিমার্জিত কারিকুলামের বেশ বড় কিছু তফাত লক্ষণীয়। অতীতের পরিমার্জনগুলো ছিল সংক্ষিপ্ত পরিসরে, কিন্তু বর্তমানের পরিমার্জনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, এটিতে ব্যাপক পরিসরে কাজ করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের কনটেন্ট থেকে শুরু করে বিষয়ের কলেবর যেমন পরিবর্তন ও বৃদ্ধি করা হয়েছে, তেমনি পুরোদস্তুর পরিবর্তন এসেছে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে। সব মিলিয়ে সাম্প্রতিক এই পরিমার্জনের এত বড়সড় পরিবর্তন জনমানুষের মাঝে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, যা পূর্বের কোনো পরিমার্জনগুলোতে ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি।

পুরো ঘটনাপ্রবাহ থেকে আমরা দেখতে পেয়েছি ২০২১ এর পরিমার্জিত কারিকুলামে পাঠ্যপুস্তকের ভেতরকার বিষয়বস্তু পরিবর্তন, পরিমার্জন কিংবা সংযোজন কারিকুলামের সব প্রচেষ্টাকে অনেকখানি ম্লান করেছে বললে বোধকরি ভুল হবে না। যদিও শিক্ষাবিদ, মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও অভিভাবকদের পক্ষ থেকে এর কারণ হিসেবে বেশকিছু যৌক্তিক ও আবার অনেক ক্ষেত্রে কিছু অযৌক্তিক অভিযোগও দৃষ্টিগোচর হয়েছে।

তবে অভিভাবকদের দিক থেকে (অনেক শিক্ষাবিদও আছেন) বেশি সমালোচিত হয়েছে কারিকুলামের মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে। লেখনীর পরিসর সীমিত করার জন্য এখানে প্রাথমিক পর্যায়ের মূল্যায়নের বিষয়টি সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরছি।

বলে রাখা প্রয়োজন, ২০২১-এর পরিমার্জিত কারিকুলামে প্রাথমিক পর্যায়ে তিন ধাপে ধারাবাহিক/শিখনকালীন মূল্যায়নের সুপারিশ করা হয়েছে, যা পর্যায়ক্রমে ২০২৫ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে। প্রথম ধাপে প্রথম শ্রেণিতে ধারাবাহিক/শিখনকালীন মূল্যায়ন, দ্বিতীয় ধাপে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিখনকালীন মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি সর্বশেষ অর্থাৎ তৃতীয় ধাপে ২০২৫ সালে বিদ্যালয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পরিমার্জিত কারিকুলামের প্রথম ধাপের প্রথম শ্রেণির ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়া বিদ্যালয়ে শুরু হতে মাঝখানে কেটে যায় অনেক সময়। যাই হোক, দেরিতে হলেও ২০২৩ সালে এটি মাঠপর্যায়ে শুরু হয়। কিন্তু তাতেও বাধা হয়ে দাঁড়াল মূল্যায়নের মূল উপকরণ নতুন পাঠ নির্দেশক সংবলিত শিক্ষক সহায়িকা সঠিক সময়ে শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে না দেওয়া। যদিও পরে কয়েক মাস পর এটি বিদ্যালয়ে নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু তাতে শুরুতেই কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে বলে মনে হয়।

তবে আশাব্যঞ্জক বিষয় ছিল, শিখনকালীন মূল্যায়নের অংশ হিসেবে প্রথম শ্রেণির ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় ‘ডায়েরি’ নামক একটি কৌশলকে বেছে নেওয়া। এ কৌশলের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের জন্য শিক্ষকরা বিষয়ভিত্তিক ডায়েরি-১ ও ডায়েরি-২ এ রেকর্ড সংরক্ষণ করবেন বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই ডায়েরি সংরক্ষণের জন্য প্রথম শ্রেণির শিক্ষক সহায়িকায় দেওয়া অধ্যায়/পাঠভিত্তিক মূল্যায়ন নির্দেশক অনুসরণ করার কথাও বলা হয় কারিকুলামে। এই মূল্যায়ন ডায়েরির একটি বিশেষত্ব এই যে, এতে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিরাময়ের একটি চমৎকার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের কার্যকর ফিডব্যাকের (ফলাবর্তন) মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক উন্নতিরও সুযোগ রয়েছে এই ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায়। এভাবেই ডিজাইন করে তৈরিকৃত ম্যানুয়েল অনুসরণ করে সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও প্রদান করা হয়।

২০২৪ সালে যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষক সহায়িকার মাধ্যমে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে চলে আসে।

এক. দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষক সহায়িকাটি জানুয়ারির প্রথম থেকেই শ্রেণিকার্যক্রমে শিক্ষকদের ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের শিখনকালীন মূল্যায়নের কথা থাকলেও, সঠিক সময়ে শিক্ষক সহায়িকা বিদ্যালয়ে পৌঁছানো নিশ্চিত না করার কারণে পূর্বের মতো এবারও শুরুতেই মূল্যায়ন কার্যক্রম বড় একটি ধাক্কা খেয়েছে।

দুই. শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই যে শিক্ষক সহায়িকা শিক্ষকদের হাতে থাকার কথা ছিল, তা পাওয়া গেছে জুন মাসে। তাহলে এই ছয় মাসের পিছিয়ে যাওয়া মূল্যায়ন প্রক্রিয়া শিক্ষকরা কীভাবে নিশ্চিত করবেন, তা বোধগম্য নয়।

তিন. প্রথম শ্রেণির ডায়েরিভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির জন্য নতুন আঙ্গিকে শিখনকালীন মূল্যায়নের জন্য একটি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রথম শ্রেণির মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটিকেও পূর্বের রূপ বদলে দিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির মতো করে সাজানো হয়েছে। তাহলে স্বভাবতই একটি প্রশ্ন সামনে আসে, এত আলোচনা, পর্যালোচনা ও সমীক্ষার মাধ্যমে প্রথম শ্রেণির ডায়েরিভিত্তিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি কেন বিদ্যালয়ে গত এক বছর বাস্তবায়ন করা হলো, যা এ বছর খোলনলচে পরিবর্তন আনা হলো। আর কেনইবা এর প্রশিক্ষণের পেছনে এত অর্থ ব্যয় করা হলো?

চার. বর্তমানে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুগোপযোগী তাতে সন্দেহ নেই, তবে তা প্রাথমিক পর্যায়ের জন্য কতটা যোগ্যতাভিত্তিক তা প্রশ্ন ও একই সঙ্গে আরও গবেষণার দাবি রাখে।

পাঁচ. পূর্বের প্রথম শ্রেণির শিক্ষক সহায়িকায় প্রতি পাঠ/অধ্যায়ভিত্তিক চারটি যোগ্যতার (জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ) ওপর মূল্যায়ন নির্দেশক প্রশ্ন ছিল, যার প্রতিফলন শিক্ষক ডায়েরি-১ ও ২ এ থাকত। কিন্তু বর্তমানের (প্রথম-তৃতীয়) শ্রেণির মূল্যায়নে বিষয়টি এভাবে না রেখে পরিশিষ্ট আকারে শ্রেণিভিত্তিক অর্জন উপযোগী যোগ্যতা, পারদর্শিতার সূচক, পারদর্শিতার মাত্রা (ভালো-good, খুব ভালো-very good, উত্তম-excellent), বিষয়ভিত্তিক পারদর্শিতার ক্ষেত্র ইত্যাদি বিভিন্ন পর্যায়ে সাজানো হয়েছে। তা ছাড়া সর্বশেষ সার্বিক মূল্যায়নের জন্য ৭টি মূল্যায়ন স্কেল যথাক্রমে অনন্য (Upgrading), অর্জনমুখী (Achieving), অগ্রগামী (Advancing), সক্রিয় (Activating), অনুসন্ধানী (Exploring), বিকাশমান (Developing), প্রারম্ভিক (Elementary) নির্ধারণ করা হয়েছে। সার্বিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের জন্য উপযোগী হলেও প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা উপযোগী তাও একটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়।

ছয়. তা ছাড়া প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিখনকালীন মূল্যায়নের এ প্রক্রিয়াটি যেহেতু নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং তাতে নতুন অনেক টুলস যুক্ত করা হয়েছে, তাই এবারও বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে মূল্যায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের ফের প্রশিক্ষণ দেওয়া অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।

কিন্তু প্রশিক্ষণ কখন হবে তাও পরিষ্কার নয়, অথচ এরই মধ্যে চলতি শিক্ষাবর্ষের অর্ধেক সময় চলে গেছে। সার্বিকভাবে বলাবাহুল্য, একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, ডেলটা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কিংবা এসডিজি অর্জনসহ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে অভিযোজনের জন্য জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায়ও পরিবর্তন দরকার, তবে সেটি করার জন্য অবশ্যই বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নেওয়া অপরিহার্য। তবেই গুণগত ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার কার্যকর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

লেখক: সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এ/০৪/০৮/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading