এইমাত্র পাওয়া

নতুন শিক্ষাক্রম: রিপোর্ট কার্ডই হবে সনদ

ঢাকা: নতুন শিক্ষাক্রমে স্কুলের অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক মূল্যায়ন এবং প্রথম পাবলিক মূল্যায়ন (এসএসসি ও সমমান) পদ্ধতি চূড়ান্ত হচ্ছে। এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সাতটি ধাপে নির্ধারণ হবে। তিন পদ্ধতির মূল্যায়নই হবে একই ধরনের। প্রতিটি বিষয়ের জন্য একদিন সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টায় (বিরতিসহ) মূল্যায়ন অনুষ্ঠিত হবে। মূল্যায়ন শেষে যে রিপোর্ট কার্ড তৈরি হবে—সেটিই হবে শিক্ষার্থীর মূল সনদ। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে প্রথম পাবলিক মূল্যায়ন (এসএসসি) অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ডিসেম্বরে না হলে ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে শেষ করা হবে।

মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষা মূল্যায়নে গতানুগতিক পরীক্ষা ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তবে যোগ্যতা ও কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়নের পাশাপাশি লিখিত মূল্যায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। মাধ্যমিকে লিখিত মূল্যায়ন ৫০ শতাংশ এবং কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়ন ৫০ শতাংশের প্রস্তাব করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিক স্তরের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মূল্যায়ন নেই। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ৬০ শতাংশ কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়ন ও ৪০ শতাংশ লিখিত মূল্যায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।

সনদ বা ট্রান্সক্রিপ্টের চূড়ান্ত মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সাতটি ধাপে (স্কেলে) যোগ্যতা ও পারদর্শিতার সূচকের বিষয়টি অভিভাবক ও অংশীজনদের জানানোর জন্য সুপারিশ করা হয়। চূড়ান্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি ও গাইডলাইনের আলোকে নৈপুণ্য প্ল্যাটফর্ম হালনাগাদ করা হবে। এ বিষয়ে শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

থাকবে না জিপিএ

নতুন শিক্ষাক্রমে জিপিএ (গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজ) এবং নম্বরের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের বিষয়টি উঠে যাচ্ছে। সেখানে একজন শিক্ষার্থীর অগ্রগতি বোঝাতে নম্বর বা গ্রেডের বদলে ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। ত্রিভুজ হলো সবচেয়ে দক্ষ বা ভালো, বৃত্ত হলো মোটামুটি ভালো এবং চতুর্ভুজ হলো উন্নতি প্রয়োজন। ২০২৩ সালে শুরু হওয়া মাধ্যমিক স্তরের প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির মূল্যায়ন এভাবে করা হয়েছে।

সাত ধাপে মূল্যায়ন

বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সাতটি ধাপের (স্কেলের) কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো—প্রারম্ভিক, বিকাশমান, অনুসন্ধানী, সক্রিয়, অগ্রগামী, অর্জনমুখী ও অনন্য। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করে কোন শিক্ষার্থী কোন পর্যায়ে আছে—তা নির্ধারণ করতে এই সাতটি ধাপ রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিসিটি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ যতটা পেতে পারে আর সর্বনিম্ন যতটা পেতে পারে, সেই গ্যাপটিকে সাতটি ধাপ করা হয়েছে। আবার এই সাতটি ধাপ মূল্যায়ন করতে, যে বিষয়ে ১০টি পিআই (পারদর্শিতার নির্দেশক) আছে সেটি এক রকম, ১২টি পিআই আছে সেটি আরেক রকম, আবার যে বিষয়ে সাতটি পিআই আছে সেটি অন্য রকম। অর্থাৎ গ্যাপটিকে সাতটি ভাগে ভাগ করে ক্যালকুলাসের সাহায্যে পজিশনগুলো ঠিক করা হয়েছে। এটি নির্ভর করবে পিআইতে শিক্ষার্থীর অর্জন কী তার ওপর।’

সামষ্টিক মূল্যায়ন

কোনও নির্দিষ্ট সময়ে কোনও একটি যোগ্যতা অর্জনে শিক্ষার্থী কোন পর্যায়ে আছে, তা জানার জন্য যে মূল্যায়ন, সেটিই হচ্ছে সামষ্টিক মূল্যায়ন। এক্ষেত্রে যোগ্যতার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, মূল্যায়নের বহুমুখী পদ্ধতির সমন্বিত প্রয়োগের মাধ্যমে নির্দিষ্ট যোগ্যতা অর্জনে শিক্ষার্থী কোন পর্যায়ে আছে, তা জানা যাবে। এই মূল্যায়ন শিক্ষা বছরের মাঝামাঝি এবং শেষে, দুইবার করা হবে। সামষ্টিক মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনার সময়েও শিক্ষক শিখনকালীন মূল্যায়নের মতোই বিষয়ভিত্তিক প্রমাণের ভিত্তিতে পারদর্শিতার নির্দেশক (পিআই) অনুযায়ী নৈপুণ্য অ্যাপে ইনপুট দেবেন। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সংশ্লিষ্ট প্রমাণগুলো সংরক্ষণ করবেন। প্রথম ছয় মাসের শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীর ষাণ্মাসিক অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট তৈরি হবে। প্রথম ষাণ্মাসিক মূল্যায়নের রেকর্ড, পরবর্তী ৬ মাসের শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং বাৎসরিক সামষ্টিক মূল্যায়নের রেকর্ডের সমন্বয়ে পরে বাৎসরিক অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট এবং রিপোর্ট কার্ড প্রস্তুত করা হবে।

পাবলিক মূল্যায়ন পদ্ধতি

পাবলিক মূল্যায়নের সময়েও শিখনকালীন ও সামষ্টিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়া পরিচালিত হবে। দশম শ্রেণিতে প্রত্যেকটি বিষয়েই বছরব্যাপী শিখনকালীন মূল্যায়ন পরিচালিত হবে, যা পাবলিক মূল্যায়নেরই অংশ। দশম শ্রেণির শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকে এনসিটিবি প্রণীত শিখনকালীন মূল্যায়ন নির্দেশিকা অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠানের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক শিখনকালীন মূল্যায়ন পরিচালনা করবেন। প্রতিটি শিখন অভিজ্ঞতা শেষে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক প্রমাণপত্রের ভিত্তিতে পারদর্শিতার নির্দেশক অনুযায়ী নৈপুণ্য অ্যাপে ইনপুট দেবেন। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক প্রমাণপত্রগুলো সংরক্ষণ করবেন। শিক্ষা বোর্ড বিষয়ভিত্তিক নির্বাচিত বহিঃমূল্যায়নকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের প্রমাণপত্র যাচাই করবেন।

শিক্ষক প্রশিক্ষণ

মূল্যায়ন পদ্ধতি বাস্তবায়নের বিষয়ে কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, চূড়ান্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি ও গাইডলাইনের আলোকে নৈপুণ্য প্ল্যাটফর্ম হালনাগাদ করা যেতে পারে এবং এই বিষয়ে শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের বিষয়ে এনসিসিটির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, ‘কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রশিক্ষণ চলতেই থাকবে। ফলে বাস্তবায়নে সমস্যা হবে না।’

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সারা বছরই চলবে শিক্ষক প্রশিক্ষণ। এছাড়া চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

মূল্যায়ন বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘শিক্ষার্থীর সনদ (সার্টিফিকেট) হবে তার রিপোর্ট কার্ড, আর কোনও সনদ প্রয়োজন হবে না। নতুন শিক্ষাক্রমে (কারিকুলাম) প্রথমবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে। তবে প্রথম বছর পাবলিক মূল্যায়ন হওয়ায় ডিসেম্বরে নেওয়া হয়তো সম্ভব না। সেক্ষেত্রে ২০২৬ সালের জানুয়ারির শুরুতেই নেওয়া হবে। একদিনে একটি বিষয়ের মূল্যায়ন অনুষ্ঠিত হবে, সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টায় (বিরতিসহ)।’

প্রচলিত পদ্ধতিতে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির শুরুতে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। ২০২০ সালে কোভিড মহামারির পর এই পরীক্ষাসূচি কিছুটা পেছানো হয়েছে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে বছরের শেষদিকে অর্থাৎ ডিসেম্বরেই এসএসসি’র পাবলিক মূল্যায়ন অনুষ্ঠিত হবে।

প্রসঙ্গত, ১৯৬২ সাল থেকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় চলতি শিক্ষাবর্ষে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে পাঠদান শুরু হয়েছে। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ২০২৫ সালে পাবলিক মূল্যায়নে (এসএসসি) অংশ নেবে। ডিসেম্বরে এই মূল্যায়ন শেষ না করা গেলে ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে মূল্যায়ন শেষ করা হবে।

এর আগে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হয়। চলতি শিক্ষাবর্ষে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এরপর ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণি, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে।

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/৩০/০৫/২২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.