ঢাকাঃ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর দেওয়া সংক্রান্ত রিট আপিল নিষ্পত্তি হলেও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ কারণে ঈদের আগে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন ও বোনাসের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। এদিকে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পুনর্বিবেচনার সুযোগের আগেই ঈদের আগে তড়িঘড়ি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এমন সিদ্ধান্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে। এমনকি দুর্বল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এছাড়াও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয় ট্রাস্টের মাধ্যমে, যার কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের সঙ্গেও কর আরোপকে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন অনেকে।
এ বিষয়ে আয়কর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন বলেন, আয়কর আইন ২০২৩ এর ষষ্ঠ তফসিলের দফা ১২ তে বলা আছে– ধর্মীয় বা দাতব্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গৃহীত স্বেচ্ছা প্রদত্ত চাঁদা যাহা কেবল ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। এটিও আয়করের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এখানে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
তিনি আরও বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর ৪১ ধারায় বলা আছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় কিংবা পরিচালনায় আয়ের উৎস কী হবে। সেখান থেকে বোঝা যায় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দান কিংবা
অনুদানে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হবে। এখন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি নেবে। এসব ব্যয়ের ব্যাপারেও আইনে সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া আছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনুমোদিত খাত ছাড়া অন্য কোনো খাতে এই অর্থ ব্যয় করা যাবে না। এসব বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একটা দাতব্য প্রতিষ্ঠানেই রুপ নেয়। এখান থেকে ট্রাস্টিদের কোনও অর্থ বা মুনাফা নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। অর্থাৎ অবশিষ্ট অর্থটি শিক্ষার উন্নয়নেই ব্যয় হবে। সুতরাং জটিলতার কোনও সুযোগই নেই। এখানে আইন অনুযায়ী কর নেওয়ারই সুযোগই নেই।
এদিকে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ১৫ শতাংশ করারোপ নিয়ে উদ্ভূত জটিলতা নিরসন ও স্থগিত করা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ঈদের আগেই চালুর অনুরোধ জানিয়েছে ট্রাস্টিদের সংগঠন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি।
সম্প্রতি সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন মাহামান্য রাষ্ট্রপতি ও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য, অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানের কাছে লিখিতভাবে এ অনুরাধ জানান।
শেখ কবির হোসেন লিখিত পত্রে জানান, অলাভজনক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর প্রদান সংক্রান্ত রিট আপিল নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে সম্প্রতি আদালত রায় দিয়েছেন। আদালতের ‘আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণের বিশদ বিবরণ আদেশের পূর্ণাঙ্গ পাঠ’ এখনো প্রকাশিত হয়নি। এরই মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর প্রদানের চাহিদা পত্র পাঠিয়ে দুঃখজনকভাবে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করেছে।
চিঠিতে শেখ কবির হোসেন বলেন, আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ এবং সেই অনুায়ী কর প্রদান সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কোনোরূপ সময় না না দিয়ে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাংক হিসাব স্থগিত করায় এই খাতে ব্যাপক উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অকস্মাৎ এহেন পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দৈনন্দিন ব্যয় মেটানো এবং বিপুল সংখ্যক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারি পরিবারের বেতন ও ঈদ উৎসব ভাতা প্রদান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলে শিক্ষার্থীদের বেতনের টাকায়। সরকার থেকে কোনও অনুদান তারা পায় না। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে গবেষণা, গ্রন্থাগার নানা একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম তাদের চালাতে হয় ওই টাকা থেকেই। তারা কর না দিলেও পরোক্ষ কর দিচ্ছে। তাদের উন্নয়ন, নির্মাণ, ইত্যাদিতে যেসব খরচ হয়, তা থেকে সরকার ভ্যাট পায়। এদের শিক্ষক, কর্মকর্তারা আয়কর দেন। তারপরও যদি তাদের নিয়মিত কর দিতে হয়, কয়েক বছরের কর এক সঙ্গে পরিশোধ করতে হয়, তাহলে তারা চাপের মুখে পড়বে। হয়তো তাতে বেতন ভাতা কমবে, সুযোগ সুবিধাও কমে যাবে; নয় তো শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়বে। আমি আবারও বলি, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক অনিয়ম হয়, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হোক, কিন্তু তাদের উপর করারোপ করাটা ভালো উদ্যোগ নয়।
তিনি আরও বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর কর আদায় শুরু হলে প্রতি বছর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কত টাকা জমা হবে, তা নিয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, সেই অংকটি এমন বিশাল কিছু হবে না, যা সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনায় বড় ভূমিকা রাখবে, বরং বিভিন্ন বড় প্রকল্পে যেসব নয় ছয় হয়, তা রোধ করা গেলে এর থেকে অনেক বেশি টাকা সাশ্রয় হত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ বিশ্বের নানা প্রান্তের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে কর প্রদান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ শিক্ষাদান, গবেষণা এবং জনসেবার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সমাজের কল্যাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আয়কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে যাতে তারা তাদের রাজস্বের সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম ব্যয়/বিনিয়োগ করতে পারে।
অধ্যাপক জাকির হোসেন আরও বলেন, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কিছু খারাপ মানুষ সিটিং অ্যালাউন্স, অন্যান্য ভাতা, বিলাসবহুল গাড়ি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে অবৈধ ব্যবসায়িক চুক্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ আহরণে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অর্থ পাচার করছে। অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের এই অপরাধমূলক কাজের জন্য অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কিন্তু কয়েকজনের অপরাধের জন্য সামগ্রিকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর অব্যাহতি বাতিল পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। এটি অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মৃত্যুঘণ্টা হয়ে আবির্ভূত হতে পারে।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, ঠিক ঈদের আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যেভাবে ব্যাংক একাউন্ট স্থগিত করলো সেটি সম্পূর্ণ অমানবিক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত।
উল্লেখ্য, বেসরকারি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে শতকরা ১৫ ভাগ হারে আয়কর আদায়ের জন্য ২০০৭ সালের ২৮ জুন ও ২০১০ সালের ১ জুলাই পৃথক দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর। এই দুটি প্রজ্ঞাপনের বৈধতা নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও এক শিক্ষার্থীর করা পৃথক ৪০টির বেশি রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আদায়ের দুটি প্রজ্ঞাপন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।
এনবিআরের ওই দুই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে শতকরা ১৫ ভাগ হারে রিট আবেদনকারী যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে আয়কর বাবদ অর্থ আদায় করা হতো, তা ফেরত দিতে সরকার ও এনবিআরকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
পরে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। এর ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক ৪৫টি লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে।
শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক ৪৫টি আপিল করে, যার ওপর শুনানি শেষে ২৭ ফেব্রুয়ারি রায় দেন আপিল বিভাগ। এই রায়ের কপি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাতে এখনও পৌঁছায়নি। তাছাড়া রায়ের সার্টিফাইড কপি হাতে পেলে তারা রায় পুনর্বিবেচনার জন্য রিভিশন করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আইনি এসব প্রক্রিয়ার বিষয়টি মাথায় না নিয়েই ঈদের আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/০৮/০৪/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.