ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিতকে যেভাবে দেখছেন শিক্ষকরা

নিজস্ব প্রতিবেদক।।

অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর দেওয়া সংক্রান্ত রিট আপিল নিষ্পত্তি হলেও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ কারণে ঈদের আগে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন ও বোনাসের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন।

ঈদের আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এমন সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী হিসেবে বিবেচনা করছেন না সাধারণ শিক্ষকরা। কারণ ঈদের আগে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন ও বোনাস পাওয়ার ক্ষেত্রে এর ফলে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ঈদের পরেও এনবিআর তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারতো বলে মনে করেন শিক্ষকরা।

উচ্চ আদালতের রিট আপিলের নিষ্পত্তি করার নির্দেশের পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার আগেই খুব দ্রুত কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত করে দেয় এনবিআর। এই ঘটনায় বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি গত ৩১ মার্চ গণমাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেনের সই করা প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণের বিষদ বিবরণ আদেশের পূর্ণাঙ্গ পাঠ এখনও প্রকাশিত হয়নি। তথাপি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর প্রদানের চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে এবং দুঃখজনকভাবে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থহিত করা হয়েছে। আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ এবং সেই অনুযায়ী আয়কর প্রদান সংক্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণের আগে কোনোরূপ সুযোগ না দিয়ে রোজা চলাকালে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে বিশ্ববিদ্যলয়গুলোর ব্যাংক অ্যকাউন্ট স্থগিত করা একটি অমানবিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রতীয়মান। কেননা এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবারের বেতন, বোনাস এবং অন্যা বিল পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।

যেভাবে দেখছেন শিক্ষকরা:

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ট্যাক্সের কারণে যেটা হতে পারে তা হলো যেসব বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিকভাবে স্বচ্ছল না, সেসব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যারা স্বচ্ছল বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ক্ষেত্রে অ্যাকাউন্ট স্থগিত করার সিদ্ধান্তটি ঈদের পরে নিলেও ক্ষতি হতো না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী মিলে কয়েক হাজার মানুষ কাজ করেন। তারা সারা বছর বসে থাকেন ঈদের জন্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘আদালতের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু তারও একটা টাইমিং হিসাব করা দরকার। কখন করলে ভালো হবে কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও সুযোগ দেওয়া যায় কিনা? আমি পত্র-পত্রিকায় দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছে। তাই মনে হলো, ঈদের আগে রাজস্ব বোর্ড এ কাজটি করায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যলয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘সারা বিশ্বে হার্ভার্ড থেকে শুরু করে যতগুলো বেসরকারি ইউনিভার্সিটি আছে এদের ওপর ট্যাক্স নির্ধারণ হয় না। কারণ এরা রাষ্ট্র- সমাজকে সেবা দিচ্ছে। রাষ্ট্র যেখানে এককভাবে দিতে পারছে না সেখানে এরা দিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান দাতব্য প্রতিষ্ঠান। এ কারণে এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে ট্যাক্স আরোপ করা হয় না। তবে তারা যদি এটার পাশাপাশি ব্যবসা করে, সম্পত্তি ক্রয় করে সেখান থেকে লাভ করে, তাহলে ট্যাক্স আরোপ করে।’

অধ্যাপক জাকির হোসেন আরও বলেন, ‘আইনজীবীরা যারা ছিলেন, আদালতকে কীভাবে বুঝিয়েছেন আমি জানি না। তারপরও আদালতের রায়ের পর রায় পুনর্ববিবেচনার সুযোগ থাকে। সেই সুযোগটুকু দেওয়া উচিত ছিল। আর যেহেতু সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বাধ্যতামূলক করেছে যে ব্যাংকে ৫ কোটি টাকা থাকতে হবে, অবশ্যই স্থায়ী ক্যাম্পাস থাকতে হবে, তাহলে একটা স্থায়ী ক্যাম্পাস করতেই তো ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয় হাজার কোটি টাকা খরচ করে ক্যাম্পাস তৈরি করছে। এই অবস্থায় যেসব বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করেছে, স্থায়ী ক্যম্পাস এখনও করতেই পারেনি, অবকাঠামো খাতে যে বিশাল খরচ লাগে তা কোথা থেকে আসবে? এই অবস্থায় যদি ট্যাক্স আরোপ করা হয়, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, শিক্ষকদের ঠিকমতো বেতনই দিতে পারছে না, গবেষণা খাতে ব্যয় করতে পারছে না। এমন অবস্থায় আমার মনে হয় না এই গুরুত্বপূর্ণ খাত থেকে টাকা এখন থেকেই নিতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রাশেদা রওনক খান বলেন, ‘এনবিআর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রের ধর্ম হচ্ছে সাধারণ জনগণের কথা ভাবা। উৎসবকে সামনে রেখে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি রাষ্ট্রের কাছে কাম্য হতে পারে না। যেহেতু আয়করের প্রসঙ্গ, সেহেতু এনবিআর এরকম একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সিদ্ধান্তটা কার্যকর করা যেত ঈদের পর থেকে। ঈদের আগে কার্যকর না করে ঈদের পর হতে পারতো। তাহলে বিষয়টি অনেক বেশি মানবিক ও যৌক্তিক হতো।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক প্রণব কুমার পান্ডে বলেন, ‘যারা শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী তারা চাকরি করেন। তাদের কোনও দায় নেই। যদি অনিয়ম হয় তাহলে প্রশাসের সর্বোচ্চ লেভেলে হয়। সে ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষক-কর্মচারী যারা আছেন, ঈদের আগে অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে মুসলিম কমিউনিটির ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনকে কষ্টের করে তোলা কাঙ্ক্ষিত নয়। উভয়পক্ষের ভেবে দেখা উচিত ছিল এটা সঠিক সময় কিনা?’

ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশনের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আফতাব হোসেন বলেন, ‘ঈদের আগে এই সিদ্ধান্তটাকে ভালোভাবে দেখছি না। ঈদে মানুষের পরিকল্পনা থাকে। এই ঈদের আগে নতুন মাস শুরু হয়ে গেছে। বেতন-বোনাসের বিষয় আছে। এখানে ট্রাস্টিরা ও সরকার পক্ষ মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। ঈদের আগে করায় একটি প্যানিক তৈরি হয়ে গেছে।’

প্রসঙ্গত, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হবে বলে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রায় দেন আপিল বিভাগ। আদালত রায় ঘোষণার পর ছয় দিনের মাথায় গত ৪ মার্চ কর আদায়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চিঠি দেওয়া শুরু করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। গত ৪ মার্চ প্রাইম ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার/ট্রেজারারকে দেওয়া চিঠিতে গত ১৫ মার্চের মধ্যে আয়কর পরিশোধের আল্টিমেটাম দেওয়া হয়।

উপ কর কমিশন (সার্কেল-২৩৩) মো. জহিরুল ইসলাম ভূইয়ার সই করা চিঠিতে জানানো হয়, নির্ধারিত (১৫ মার্চ) সময়ের মধ্যে আয়কর পরিশোধ করার অনুরোধ করা যাচ্ছে। কর প্রদানে ব্যর্থ হলে আয়কর আইন-২০২৩ এর ২৭৫ ধারা অনুযায়ী জরিমানা আরোপসহ অন্যান্য আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।

উল্লেখ্য, বেসরকারি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে শতকরা ১৫ ভাগ হারে আয়কর আদায়ের জন্য ২০০৭ সালের ২৮ জুন ও ২০১০ সালের ১ জুলাই পৃথক দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর। এই দুটি প্রজ্ঞাপনের বৈধতা নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও এক শিক্ষার্থীর করা পৃথক ৪০টির বেশি রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আদায়ের দুটি প্রজ্ঞাপন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।

এনবিআরের ওই দুই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে শতকরা ১৫ ভাগ হারে রিট আবেদনকারী যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে আয়কর বাবদ অর্থ আদায় করা হতো, তা ফেরত দিতে সরকার ও এনবিআরকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

পরে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। এর ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক ৪৫টি লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে।

শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক ৪৫টি আপিল করে, যার ওপর শুনানি শেষে ২৭ ফেব্রুয়ারি রায় দেন আপিল বিভাগ। এই রায়ের কপি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাতে এখনও পৌঁছায়নি। তাছাড়া রায়ের সার্টিফাইড কপি হাতে পেলে তারা রায় পুনর্বিবেচনার জন্য রিভিশন করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আইনি এসব প্রক্রিয়ার বিষয়টি মাথায় না নিয়েই ঈদের আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়। বাংলা ট্রিবিউন

শিক্ষাবার্তা ডট কম/জামান/০৬/০৪/২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Check Also

সাত বছর পর বৈধ প্রক্রিয়ায় হলে চবির শিক্ষার্থীরা

চট্টগ্রাম: দীর্ঘ ৭ বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে আসন বরাদ্দ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ফলে …