নিজস্ব প্রতিবেদক।।
শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। ৪১ বছর ধরে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যবই প্রণয়ন ও ছাপার কাজ করছে এনসিটিবি। সম্প্রতি এ দায়িত্ব প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে দিতে তৎপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে সম্মতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, বই ছাপানো ও বিতরণ করাটা এনসিটিবির কাজ নয়। তারা শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করবেন, পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করবেন। সেটা কোথা থেকে, কীভাবে ছাপা হবে- অধিদপ্তর দেখবে। এতে ছাপাখানা মালিকদের সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হবে। পাশাপাশি ভালো হবে বইয়ের মানও।
অন্যদিকে প্রাথমিকের বই ছাপানোর দায়িত্ব ছাড়তে নারাজ এনসিটিবি। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, জটিলতা কাটাতেই বই ছাপানোর কাজ ১৯৮৩ সালে এনসিটিবির অধীনে এক ছাতার নিচে আনা হয়। এ দায়িত্ব এখন প্রাথমিক অধিদপ্তরে গেলে নতুন করে নানান জটিলতা সামনে আসবে। একই সঙ্গে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে এনসিটিবি। প্রতিষ্ঠানটি কার্যত অচল হয়ে পড়বে। তাছাড়া আইনি জটিলতাও রয়েছে।
জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এনসিটিবির কাছ থেকে প্রাথমিকের বই ছাপানোর দায়িত্ব সরিয়ে নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এরপরে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে বিষয়টি উপস্থাপন করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাতে সাড়া দেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির হস্তক্ষেপে ঝুলে যায় প্রাথমিকের উদ্যোগ বাস্তবায়ন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠনের পর সম্প্রতি আবারও বিষয়টি সামনে আনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে ফের উপস্থাপন করা হলে এবার তাতে সায় দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ নীতিগত সিদ্ধান্তের সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সম্প্রতি এ সিদ্ধান্তে নীতিগত সম্মতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
আমরা এখন কারিকুলাম প্রস্তুত, বই লেখা ও ছাপানোর কাজ করছি। বোর্ডের কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ আছেন। কিন্তু প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানো অধিদপ্তরের কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ পদ নেই। পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয় নিজেদের আয় থেকে। রয়্যালটি বাবদ পাওয়া টাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেই আমরা। তারা (অধিদপ্তর) বই ছাপানো শুরু করলেও রয়্যালটির টাকা নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হবে।-এনসিটিবি চেয়ারম্যান
এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আইনের সংশোধনী প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধনী প্রস্তাব চূড়ান্তও করা হয়েছে। এটি অনুমোদনের জন্য এখন মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। মন্ত্রিসভা অনুমোদন করলেই দায়িত্ব চলে যাবে অধিদপ্তরের হাতে। এজন্য ২০২৫ সাল থেকে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
অন্যদিকে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রাথমিকের বই ছাপানোর দায়িত্ব নিজেদের অধীনে রাখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেনদরবার চালিয়ে যাচ্ছে। আইনি জটিলতা ও এনসিটিবির আর্থিক সংকটে পড়ার শঙ্কার কথা জানিয়ে তারা বই ছাপার কাজ নিজেদের অধীনে রাখতে মরিয়া।
প্রধানমন্ত্রীর নীতিগত সম্মতির পর প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণির বই ছাপতে রীতিমতো প্রস্তুতি নিতে শুরু করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরে বই ছাপার কাজের জন্য আলাদা বিভাগ তৈরি, প্রক্রিয়া ও কাজের পরিধি ঠিক করতে শিগগির বৈঠক হবে বলেও জানিয়েছে অধিদপ্তর সূত্র।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গাইডলাইন মেনে আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে ২০২৫ সাল থেকেই আমরা বই ছাপার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। ২০২৬ সালে শিক্ষার্থীদের হাতে আমাদের অধীনে ছাপা বই তুলে দিতে চাই।
নতুন শিক্ষাক্রমে মাদরাসার বই রূপান্তরে ‘জুজুর ভয়’
এদিকে, সম্প্রতি দুটি সংবাদ সম্মেলনে খোলামেলাভাবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদও। সর্বশেষ গত ২১ মার্চ সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এনসিটিবির কাজ হলো কারিকুলাম তৈরি এবং পর্যালোচনা করা। সংশোধন-পরিমার্জন করে নতুনত্ব আনা। বই ছাপানোর কাজটি প্রশাসনিক। এটি মন্ত্রণালয়ের অধীন কোনো প্রতিষ্ঠান করলেই ভালো হয়। এনসিটিবি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। সেজন্য আমরা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে এ দায়িত্ব দিতে উদ্যোগ নিয়েছি।
এই যে প্রায় ৩০ কোটি টাকা সার্ভিস চার্জ দেওয়া হচ্ছে, এতে সরকারের অপচয় হচ্ছে। আমাদের যে জনবল রয়েছে, তাদের দিয়ে যদি এটা করা হতো, তাহলে বাড়তি খরচ হবে না। সে সক্ষমতাও আমাদের রয়েছে। বরং এনসিটিবির চেয়ে দ্রুত বই ছাপা শেষ করতে পারবো আমরা।-প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক
জানতে চাইলে বুধবার (২৭ মার্চ) সচিব ফরিদ আহাম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, এনসিটিবি কেন ছাড়তে চাইছে না, সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। তাদের আর্থিক সংকট থাকলে সেটা শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সরকার দেখবে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের সার্ভিস চার্জ দিয়ে বই ছাপিয়ে নিচ্ছি। এতে আমাদের আর্থিক ক্ষতি হয়। যথাসময়ে এবং ভালো মানের বই পাওয়াও যাচ্ছে না। এজন্য এটা (বই ছাপার দায়িত্ব) সরিয়ে নেওয়ার উপযুক্ত সময় এসেছে বলে মনে করছি আমরা।
প্রতিবছর দেশের প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য সাড়ে ৯ থেকে ১০ কোটি পাঠ্যবই ছাপা হয়। সর্বশেষ ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় ৯ কোটি ৩৬ লাখ বই ছাপা হয়। এরমধ্যে প্রথম, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ছাপানো হয়েছে ৫ কোটি ৩৮ লাখ ৩ হাজার ৪২৩ কপি বই। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই সংখ্যা ৩ কোটি ৩৬ লাখ ১ হাজার ২৭৪টি। প্রাক-প্রাথমিকের জন্য ৬১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৭৮ কপি বই ছাপা হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যের বই ছাপানোর বরাদ্দ আসে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুকূলে। বর্তমানে যে আইন রয়েছে, তাতে বই ছাপানোর জন্য এনসিটিবিকে অতিরিক্ত ২ শতাংশ অর্থ সার্ভিস চার্জ হিসেবে দিতে হয়। এতে এনসিটিবির প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কোটি আয় হয়। আর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, এই যে প্রায় ৩০ কোটি টাকা সার্ভিস চার্জ দেওয়া হচ্ছে, এতে সরকারের অপচয় হচ্ছে। যদি আমাদের যে জনবল রয়েছে, তাদের দিয়ে এটা করানো হতো, তাহলে বাড়তি খরচ হবে না। সে সক্ষমতাও আমাদের রয়েছে। বরং এনসিটিবির চেয়ে দ্রুত বই ছাপা শেষ করতে পারবো আমরা।
প্রতিবছর এনসিটিবি যে বই ও শিক্ষক সহায়িকা ছাপে, তার প্রায় অর্ধেক প্রাথমিক স্তরের। বই ছাপিয়ে বড় অংকের অর্থও উপার্জন করে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। রয়্যালটি বাবদ যে টাকা এনসিটিবি পায়, তা দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে। প্রাথমিকের বই অধিদপ্তরের হাতে চলে গেলে বড় অংকের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে প্রতিষ্ঠানটি। সার্বিক দিক বিবেচনায় প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ নিজেদের হাতে রাখতে মরিয়া এনসিটিবিও।
এনসিটিবির অধিকাংশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক আলাদাভাবে চিন্তা করা হলেও শিক্ষা তো শিক্ষাই। এটি এক ছাতার নিচেই থাকা উচিত। এর মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় সামঞ্জস্য থাকবে।
জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমরা এখন কারিকুলাম প্রস্তুত, বই লেখা ও ছাপানোর কাজ করছি। বোর্ডের কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ আছেন। কিন্তু প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানো অধিদপ্তরের কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ পদ নেই।
চেয়ারম্যানের ভাষ্য, এখানে বই ছাপানোই মূল কাজ নয়। ছাপানোর পর বিশেষজ্ঞরা সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখেন, সব ঠিকঠাক আছে কি না। সেটা তো অধিদপ্তর পারবে না। এমনটি করতে হলে এনসিটিবির প্রাথমিক শিক্ষাক্রম শাখাকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে অধিগ্রহণ করতে হবে।
এনসিটিবি বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে রুগণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে দাবি করে তিনি আরও বলেন, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয় নিজেদের আয় থেকে। রয়্যালটি বাবদ পাওয়া টাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেই । জাগো নিউজ
শিক্ষাবার্তা ডট কম/জামান/১/০৪/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.