ঢাকা কলেজের আটটি ছাত্রাবাসে প্রায় ৩০০ কক্ষে এক হাজার ২০০ শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা আছে। বাস্তবে থাকে প্রায় পাঁচ হাজার। তবে গত মাসে কয়েক দিন ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই পাঁচ হাজারের মধ্যে অন্তত এক হাজারই অছাত্র ও বহিরাগত। মূলত রাজনৈতিক মদদেই উত্তর, দক্ষিণ ও মাস্টার্স ছাত্রাবাসেই বেশি অবস্থান করছে বহিরাগতরা। রাজনৈতিক প্রয়োজনে তারা ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মসূচিতেও যোগ দেয়। ওই বহিরাগতদের অনেকেই রাজধানীর অন্যান্য কলেজের ছাত্র। এ ছাড়া অনেক শিক্ষার্থী মাস্টার্স শেষ করলেও হল ছাড়েনি। অনেকে শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পরও দু-তিন বছর ধরে অবস্থান করছে হলে। ওই অছাত্র ও বহিরাগতদের দাপটে তটস্থ থাকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এমনকি নানা ধরনের আদেশও পালন করতে হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
মনোবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এমনিতেই ছাত্রাবাসগুলোতে আসনসংখ্যা কম, এর ওপর অছাত্র বড় ভাইরা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে জোরপূর্বক হলে অবস্থান করছে। পড়াশোনা তিন-চার বছর আগে শেষ হলেও এখনো হল ছাড়ার নাম নেই অনেকের। এগুলো নিয়ে কেউ কথাও বলে না। আর প্রশাসন সব কিছু দেখেও না দেখার ভান করে। অছাত্রদের কাছ থেকে আসনগুলো উদ্ধার করা গেলেও সমস্যা কিছুটা কমত।’
জানা যায়, সর্বশেষ ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের ৫৫ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন এফ এইচ পল্লব এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাকিব হাসান সুইম। অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে এক ছাত্র নিহত হওয়ার পর ২০১৩ সালে ৩০ নভেম্বর স্থগিত করা হয়েছিল ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি। একই সঙ্গে সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ সাতজনকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এর পর থেকে নেতৃত্বহীনভাবে চলেছিল ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ। ২০১৬ সালে ১৭ নভেম্বর নুর আলম ভূঁইয়া রাজুকে আহ্বায়ক করে কমিটি করা হয় তিন মাসের জন্য। ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি দুই গ্রুপের সংঘর্ষের জের ধরে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়কসহ ১৯ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়। এখনো সেই আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই চলছে সংগঠন। এত দিন ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ার পর ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়া হবে। কিন্তু এখন আর কমিটি নিয়ে কোনো তোড়জোড় নেই।
ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সর্বশেষ আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ফরহাদ মির্জা বলেন, ‘দুই বছরেরও বেশি সময় পার হয়েছে আমাদের নিয়মিত কমিটি নেই। আমরা ছাত্রলীগের সর্বশেষ দুই কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে বিষয়টি নিয়ে গিয়েছি। তাঁরা আমাদের আশ্বাস দেন; কিন্তু কমিটি করে দেন না। এভাবে চলছে। কমিটি না থাকায় নতুন নেতৃত্ব আসতে পারছে না। আবার অনেকের পড়ালেখা শেষ হয়ে যাচ্ছে, তারা আক্ষেপ নিয়েই কলেজ থেকে বিদায় নিচ্ছে। আমরা প্রস্তুত আছি। দ্রুতই আমরা কমিটি চাই।’
জানা যায়, বর্তমানে ১০-১২ জন নেতা ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতৃত্ব পর্যায়ে আছেন, যাঁদের বেশির ভাগই সর্বশেষ অ্যাডহক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক। তাঁরা একেকজন আবার একেকটি হলের নেতৃত্ব দেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হুমায়ন কবির রানা, এম এম জোহা, লেলিন, ফরহাদ মির্জা, রাসেল মাহমুদ, জামাল উদ্দিন মাহী, শেখ রাসেল, সাদ্দাম, হিরণ ভূঁইয়া। নেতাদের কারো কারো ছাত্রত্বের বয়সসীমা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে আছে বিস্তর অভিযোগও। ঢাকা কলেজের সামনে ও পাশে আছে নিউ মার্কেট, চন্দ্রিমা মার্কেট, হকার্স মার্কেটসহ বড় কয়েকটি মার্কেট। এ ছাড়া ফুটপাতজুড়ে হাজার হাজার হকার। ওই সব জায়গা থেকে আয়ের একটি অংশ দিতে হয় ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নেতাদের। সেই আয়ের ভাগ-বাটোয়ারা ও নেতৃত্ব নিয়ে প্রায়ই ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগে সংঘর্ষ বাধে। মাঝেমধ্যেই তা বড় আকারও ধারণ করে। আবার ছাত্রাবাসে উঠতে হলেও অনেক সময়ই ছাত্রলীগ নেতাদের ধরতে হয় শিক্ষার্থীদের।
রসায়ন বিভাগের এক অনাবাসিক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘হলে উঠতে গেলে বড় ভাইদের কাছে তদবির করতে হয়। আর তদবির করে হলে উঠলেও সেখানে থাকার ও পড়াশোনার পরিবেশ নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেতে হয়। তাই প্রথমে কিছুদিন হলে ওঠার চেষ্টা করলেও পরে পিছিয়ে এসেছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে কাছেই অবস্থান হওয়ায় ঢাকা কলেজে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র ইউনিটগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ডাক দিলে দ্রুতই চলে যেতে পারে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন সময় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরও সভা-সমাবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে দেখা যায়।
এদিকে গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিএনপি ক্ষমতায় না থাকায় ঢাকা কলেজে ছাত্রদলের দেখা পাওয়াই দুষ্কর। যদিও কলেজে ছাত্রদলের কমিটি আছে।
অন্যদিকে ঢাকা কলেজ ছাত্রসংসদেরও নির্বাচন হয় না দুই দশকের বেশি সময় ধরে। ১৯৫০-৫১ শিক্ষাবর্ষে এই কলেজে সর্বপ্রথম ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়েছিল। আর সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯৩-৯৪ শিক্ষাবর্ষে।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.