মূল্যবোধের অবক্ষয়: শিক্ষাঙ্গনে এ কোন অন্ধকারের গ্রাস
আবদুল মান্নানঃ এই বয়সে এসে মাঝেমধ্যে মনে হয়, যদি সম্ভব হতো তাহলে পঞ্চাশ বছরের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা বা শিক্ষা ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের কথা ভুলে যেতাম। এমন চিন্তা ইদানীং আমার ক’জন ছাত্রসম সহকর্মীর মাঝেও দেখেছি। যে পেশা ছিল গৌরবের তা আজ নানা কারণে এই মুহূর্তে কঠিন সব নেতিবাচক বিতর্কের মুখোমুখি। যে পেশা নিয়ে একসময় গর্ব করা হতো, সে পেশার অনেক মানুষ এখন পেশাগত পরিচয় দিতে লজ্জিত হন। আমিও ব্যতিক্রম নই। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণাকর্ম বা মেধাবী মানুষ তৈরির জন্য সংবাদপত্রের শিরোনাম হতো। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা নিয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে তাদের মেধার স্বাক্ষর রেখেছে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। শিক্ষার বাজেটও ছিল অত্যন্ত সীমিত।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যেকটি বিষয় গুরুত্ব দিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম শিক্ষা। স্বাধীনতার সূচনালগ্নে তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন। উচ্চশিক্ষাকে যুগোপযোগী করে তুলতে গঠন করেছিলেন ‘ড. কুদরত-ই-খোদা শিক্ষা কমিশন’। ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম সফরে এসে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সুধী সমাবেশে বলেছিলেন, ‘এতদিন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমলা তৈরি করেছে মানুষ তৈরি করেনি, শিক্ষাব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু শেষটা দেখে যেতে পারেননি। শুধু শিক্ষা নয় বঙ্গবন্ধুর জাতি গঠনের সব চেষ্টা বাধাগ্রস্ত করেছিলেন অনেকাংশে এই আমলারাই। তবে সব আমলা যে এই অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন তা নয়। কিছু আমলা তাঁর সব কাজে সহায়তা করেছিলেন। ক্রান্তিকালে তাঁকে সুষ্ঠু ও গঠনমূলক পরামর্শ দিয়েছিলেন। পরিতাপের বিষয়, নষ্ট ও অসৎ আমলারা তখনও অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলেন, এখন তো আরও বেশি।
অন্য অনেক খাতের মতো বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাও গত তিন দশকে একটি বড় ও শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের হাতে জিম্মি। তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একজন আমলার কথা যিনি শিক্ষামন্ত্রী হিসেবেই শুধু দক্ষতার পরিচয়ই দেননি বরং তার মন্ত্রণালয়কে সকল দুর্নীতি বা সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন সাবেক আমলা এ এস এইচ কে সাদেক। তিনি ছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের বিজ্ঞ আমলা। দেশ স্বাধীনের পরও তিনি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনীতিতেও অত্যন্ত সফল ছিলেন। যশোরের নিজ নির্বাচনী এলাকার মানুষের সঙ্গে অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক ছিল তার। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যারা এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন তারা এইচ কে সাদেকের মতো সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এই না পারার পেছনে যত না অদক্ষতা, তার চেয়ে বেশি কাজ করেছে মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচ।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নানা রকমের সমস্যা থাকা বিচিত্র নয়। অনেক সময় তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের অসতর্কতা বা অদক্ষতা অথবা বাহ্যিক কোনো কারণে হতে পারে। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি চাপে আছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রতিমন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয়। কারণ তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এই না পারার পেছনে মূল কারণ নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া। ব্যবসায়ী নামে এক শ্রেণির দুর্বৃত্তের হাতে বাজারব্যবস্থা জিম্মি হয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। তবে বিষয়টা যখন শিক্ষা তখন তা দেশ ও সমাজের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। গত কয়েক মাসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব ঘটনা ঘটেছে বা ঘটছে তা আমার মতো শুধু ছাপোষা শিক্ষককেই নয় দেশের যেকোনো বিবেকবান মানুষকে বিচলিত করেছে। সবচেয়ে ভয়াবহ অভিযোগ হচ্ছে কোনো কোনো উপাচার্যের নিয়োগ বাণিজ্য, যার সঙ্গে ইদানীং যুক্ত হয়েছে ক্যাম্পাসে শিক্ষক ও ছাত্রদের দ্বারা যৌন হয়রানি। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্র নেতাদের টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ে বেশ হইচই হতো। এখন এ বিষয়টি তেমন শোনা যায় না। তার কারণ, হতে পারে অবৈধ পন্থায় অর্থ কামানোর ভিন্ন দ্বার খুলে যাওয়া, যার অন্যতম নিয়োগ বাণিজ্য।
দেশের প্রায় অর্ধ ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত এমন ঘটনা সম্প্রতি গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। একটির উপাচার্য ক’দিন পর তার দায়িত্ব শেষ করবেন। তাকে সম্প্রতি শিক্ষক-কর্মচারীরা তার অফিসে ঘেরাও করেছেন তাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে না দেওয়া। আরেকজন তার দায়িত্ব শেষ হওয়ার শেষ দিনে ৪৪ জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দিয়ে দায়িত্ব ছাড়ার মুহূর্তে গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছেন। দুর্ভাগ্য যে, এমন অভিযোগ তার দায়িত্ব নেওয়ার পর হতে তার পিছু ছাড়েনি। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানদের বিরুদ্ধে তার কর্মক্ষেত্রে নিজের আত্মীয়-স্বজনদের যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নানা অনিয়মের মাধ্যমে চাকরির ব্যবস্থা করার অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেনাকাটায় দুর্নীতি আগে তেমন একটা শোনা যেত না, যা এখন নিয়মিত হয়ে গেছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা-ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানাধীন দোকান হতে চাঁদা তোলার মতো লজ্জাজনক ঘটনাও গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। আবার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে অসংখ্য অনিয়মের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাকে পুনর্বার নিয়োগের উদাহরণও রয়েছে। দুয়েকজনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার কারণে আদালত তাকে দণ্ডও দিয়েছেন, যা শিক্ষা ক্ষেত্রে যারাই আছেন তাদের জন্য মোটেও সম্মানের নয়। একজন উপাচার্য শুধু তার ক্যাম্পাসেই সম্মানিত হওয়ার কথা নয়। তিনি পুরো সমাজেই সম্মানিত হবেন। কিন্তু যখন একজন উপাচার্যকে তার কর্মের কারণে রাতের অন্ধকারে ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে হয় তখন ওই পদের আর সম্মান থাকে না।
বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে নানা অনিয়মের মাঝে সাম্প্রতিককালে ‘যৌন হয়রানি’ নামক ভয়াবহ অপরাধ নিয়মিত সংবাদপত্রের শিরোনাম হচ্ছে। এই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন শিক্ষক হতে ছাত্র নামধারী ব্যক্তিরা। ক’দিন আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অবন্তিকার আত্মহত্যা সারা দেশকে নাড়া দিয়েছে। অভিযোগ, এই যৌন হয়রানির সঙ্গে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয় দুয়েকজন শিক্ষকও জড়িত। এ ঘটনার সূত্র ধরে পুলিশ একজন শিক্ষক ও একজন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে। একজন শিক্ষক বা একজন ছাত্রকে যৌন হয়রানির মতো অপরাধের দায়ে আটক করে পুলিশ ভ্যানে করে থানা বা আদালতে নিয়ে যাওয়ার যে দৃশ্য সারা দেশের মানুষ দেখছে, তা মোটেও সুখকর নয়। অনেকের প্রশ্ন দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এই অবস্থায় কেমন করে পড়ল। মনে রাখা ভালো, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। এগুলো বৃহত্তর সমাজেরই একটা অংশ। সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন অবক্ষয়। লেকের প্রবেশপথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নোটিস টাঙাতে হয় ‘স্কুল কলেজের ইউনিফর্ম পরে প্রবেশ নিষেধ’। এমন নোটিস দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। জানতে চাই, ইউনিফর্ম কেন এত বিপজ্জনক? এটি ইউনিফর্মের ব্যাপার নয়। ইউনিফর্ম পরা একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষালয়ে থাকার কথা পার্ক বা লেকের পাড়ে নয়। আসলে সামাজিক ও পারিবারিক অনুশাসন অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে। তার শিকার বর্তমান প্রজন্ম। তার একটি ফল ক্যাম্পাসে যৌন হয়রানির মতো ঘটনা আর অবন্তিকার মতো প্রতিভাবান ছাত্রীর আত্মহত্যা।
এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় কী। প্রথম সমস্যা গোড়ায় গলদ। যথা মানুষকে যথাস্থানে পদায়ন না করা। যিনি উপাচার্যের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার জন্য পদায়িত হবেন তার ওই পদে যাওয়ার বিদ্যায়তনিক ও প্রশাসনিক যোগ্যতা আছে কি না তা খতিয়ে দেখা অত্যন্ত জরুরি, যা ইদানীং অনেক ক্ষেত্রে করা হয় না বলে মনে হয়। রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তা এসব পদে পদায়ন করার জন্য একমাত্র মাপকাঠি হওয়া উচিত নয়। এ ধরনের পদে যারাই দায়িত্ব পালন করেন তাদের জবাবাদিহির আওতায় থাকার কথা, যা কাউকে কদাচিৎ করতে দেখা যায়। সম্প্রতি যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তার প্রত্যেকটা বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। এই কাজ করার জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা আছে। তবে কাকে কোন পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষাঙ্গন হোক বা কর্মক্ষেত্রে সংগঠিত যৌন হয়রানির ব্যাপারে একই কথা প্রযোজ্য। এই দেশে একসময় অ্যাসিড সন্ত্রাস একটি বড় সমস্যা ছিল। যে মুহূর্তে এই সন্ত্রাসের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান করা হলো সেই অ্যাসিড সন্ত্রাস এখন প্রায় নেই বললেই চলে।
সমাজ ও পারিবারিক অনুশাসন ভেঙে পড়েছে এবং তা রাতারাতি ঠিক করা যাবে না। তবে অভিভাবকরা যদি সচেতন হন তাহলে সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান সম্ভব। চারদিকে মূল্যবোধের সর্বগ্রাসী যে অবক্ষয় মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে পুরো সমাজই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি, দায়িত্বশীল সবার তা মনে থাকলেই মঙ্গল।
লেখকঃ শিক্ষাবিদ, সমাজ ও রাজনীতি-বিশ্লেষক
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২২/০৩/২০২৪