প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা: ঠেকানো যাচ্ছে না প্রশ্নপত্র ফাঁস
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের সর্বশেষ পরীক্ষায় আবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। পরীক্ষায় তিন ধাপে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। প্রথম ধাপে জালিয়াতির অভিযোগে ৭৪ জন ও তৃতীয় ধাপে একই অভিযোগে ১৩ জনকে আটক করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। সব মিলিয়ে আটক ৮৭ জন।
পরে মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এর আগে ২০১৯ ও ২০২২ সালে একই পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। এ অভিযোগে প্রতিবার একাধিক ব্যক্তি আটক হলেও কোনোবার পরীক্ষা বাতিল করেনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে তারা জালিয়াতি রোধে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।
এর পরও ঠেকানো যাচ্ছে না প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এবারের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রধম ধাপের লিখিত (এমসিকিউ) পরীক্ষা হয়েছিল গত ৮ ডিসেম্বর। এর মধ্যে এই ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শেষে উত্তীর্ণদের ফল প্রকাশ করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষা হয় চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি।
তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা হয়েছে গত ২৯ মার্চ।
সূত্র জানায়, এবারের তিন ধাপের নিয়োগ পরীক্ষায় মূলত কেন্দ্রে প্রশ্ন যাওয়ার পর তা বাইরে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এরপর নানা ধরনের ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে বাইরে থেকে সমাধান করে পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীদের কাছে উত্তর পৌঁছানো হয়।
প্রথম ধাপে জালিয়াতির অভিযোগে ৭৪ জন আটক হওয়ার পর কিছু ব্যবস্থা নেয় মন্ত্রণালয়। তৃতীয় ধাপের পরীক্ষায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে জালিয়াতি রোধে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উদ্ভাবিত ডিভাইস শনাক্তকরণ সিস্টেমের কার্যকর প্রয়োগও করা হয়।
এর পরও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তৃতীয় ধাপে পরীক্ষার আগের রাত পৌনে ১টার দিকে আমাদের সর্বশেষ প্রশ্ন পৌঁছানোর কাজ শেষ করেছি। এরপর সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে কেন্দ্রগুলোতে প্রশ্নপত্র পৌঁঁছে দেওয়া হয়। পরীক্ষা শুরু হওয়ার ১৫ মিনিট আগে প্রশ্নের প্যাকেট খোলা হয়। কাজেই ঘটনা যা ঘটেছে, সেটা প্রশ্নের প্যাকেট খোলার পর। এটাকে কোনোভাবেই প্রশ্নপত্র ফাঁস বলা যাবে না। এটা ডিজিটাল ডিভাইস জালিয়াতি।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব বলেন, ‘কেন্দ্রে প্রশ্ন পৌঁছানোর পর আমাদের হাতে আর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এরপর পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব জেলা প্রশাসন বা স্থানীয় প্রশাসনের। তবে আমরা এটা বলতে পারি, নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার ফলে প্রথম ধাপের তুলনায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের পরীক্ষায় ডিজিটাল ডিভাইস জালিয়াতি অনেকটাই কমে এসেছে। এর পরও আমরা জালিয়াতচক্রকে খুঁজে বের করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে বলেছি। তারা সেটা করছে। আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এই জালিয়াতি রোধে যা যা করা সম্ভব, তা করব।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক নিয়োগে ৮০ নম্বরের লিখিত (এমসিকিউ) পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেলে চাকরি অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়। তাই কিছু প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেতে অসদুপায় অবলম্বনের চেষ্টা করে থাকেন।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের জানান, গত ২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা চলাকালে উত্তরপত্র, ডিজিটাল ডিভাইসসহ মাদারীপুরে সাতজন এবং রাজবাড়ীতে একজন শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় দুই জেলার সংশ্লিষ্ট থানায় আলাদাভাবে দুটি মামলা হয়। এসব মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। রাজবাড়ীতে গ্রেপ্তার পরীক্ষার্থী পরে আদালতে দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
গোয়েন্দাপ্রধান বলেন, মাদারীপুরে গ্রেপ্তার হওয়া পরীক্ষার্থীদের বেশির ভাগ জামিনে বের হয়ে যান। মাদারীপুর জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাসুদ আলমের অনুরোধে ঘটনা তদন্তে নামে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ। পরে ঢাকা ও মাদারীপুর থেকে আরো পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী জ্যোতির্ময় গাইন ও সুজন চন্দ্র রয়েছেন। তাঁরা দুজন ঢাবির জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
এর আগে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর প্রথম ধাপের নিয়োগ পরীক্ষায়ও জালিয়াতির অভিযোগে গাইবান্ধায় ৩৭, রংপুরে ১৯ ও দিনাজপুরে ১৮ জনকে আটক করা হয়। ওই সময় তাদের কাছ থেকে ২৪টি মাস্টারকার্ড, ২০টি ব্লুটুথ, ১৭টি মোবাইল ফোন সেট, ব্যাংক চেক ও স্ট্যাম্প উদ্ধার করা হয়।
২০২২ সালের নিয়োগ পরীক্ষায় শুধু রাজবাড়ী জেলা থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ১৩ জনকে আটক করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাকরিপ্রত্যাশীদের খুঁজে বের করে তারা ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় পাস করানোর আশ্বাস দিত। আগ্রহী পরীক্ষার্থীদের ডিজিটাল ডিভাইস দেওয়া হতো এবং তাঁদের কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে এক-দুই লাখ টাকা জামানত নেওয়া হতো। অবশিষ্ট টাকা চাকরি পাওয়ার পর পরিশোধ করবেন বলে চুক্তি করা হতো।
২০১৯ সালের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় ঢাকা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে প্রশ্নপত্র বাইরে চলে যায়। পরে চাকরিপ্রার্থীদের ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে উত্তর সরবরাহ করা হয়।কালের কন্ঠ
শিক্ষাবার্তা/জামান/০১//০৫/২৪