বাগেরহাট সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের স্মরনে দোয়া অনুষ্ঠান
মোঃ মোজাহিদুর রহমান।।
গত ০৭ সেপ্টেম্বর সোমবার বেলা ১১ঘটিকার সময় বাগেরহাট সদর উপজেলার মাধ্যমিক উপজেলা শিক্ষা অফিসার মাছুদা আক্তারের আত্নার মাগফিরাত কামনায় দোয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার সদর উপজেলার আল-ইসলাহ একাডেমির অডিটোরিয়ামে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস ও শিক্ষক-কর্মচারী চিকিৎসা কল্যান সমিতির উদ্যোগে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সুধীজন নিয়ে মরহুম শিক্ষা অফিসারের আত্নার মাগফেরাত কামনায় দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
শিক্ষক কর্মচারী চিকিৎসা কল্যান সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি খান রেজাউল করিমের সভাপতিত্বে এবং প্রধান শিক্ষক হরিচাদ বিশ্বাসের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। দোয়া মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মোসাব্বেরুল ইসলাম, জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ কামরুজ্জামান, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোজাফফর রহমান, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান খান রেজাউল ইসলাম, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রিজিয়া পারভীন, প্রাক্তন জেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ আকরাম হোসেন, বাগেরহাট কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবুল কালাম শেখ, বাগেরহাট সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক কবিরুল ইসলাম, উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার এসএম হিশামুল হক প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মোঃ সালাম, এছাড়া অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রধান শিক্ষক নকিব আব্দুল কুদ্দুস, হুমায়ুন কবীর, মোঃ মুশাররাফ হুসাইন, ঝিমি মন্ডল, ফারহানা আক্তার, ইলিয়াস হোসেনসহ আগত অতিথিবৃন্দ।
দোয়া অনুষ্ঠানের আগে শিক্ষা অফিসার মাছুদা আক্তারের উদ্যোগে গঠিত বাগেরহাট শিক্ষক-কর্মচারী চিকিৎসা কল্যান সমিতির নামে জমি ক্রয় করে সমিতিকে বেগবান করে শিক্ষা অফিসারের মনোবাসনা পুর্ন করার কথা ব্যক্ত করা হয়। পরিশেষে দোয়া পরিচালনা করেন বাগেরহাট কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোঃ আবুল কালাম শেখ।
এক নজরে মাছুদা আক্তারের জীবনী
যুগে যুগে বিভিন্ন সময়ে মহিয়সী নারীর আবির্ভাব হয়েছে। মাদার তেরেসা, বেগম রোকেয়া, মালালা ইউসুফজাই তাদের মধ্যে অন্যতম। নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এ সকল নারী সামাজিক উন্নয়নে নিজেদেরকে বিলিয়ে দিয়েছেন। কোন প্রতিকুলতা তাদের প্রতিভাবে আটকাতে পারেনি। তারা ইতিহাসের পাতায় চির স্মরনীয় হয়ে আছে। তাদের ঋণ ভুলবার নয়।
আমার লেখা ডিজিটাল যুগের একজন মহিয়সী নারীকে নিয়ে। একজন সেরা জয়ীতাকে নিয়ে। এই জয়ীতার নাম মাছুদা আক্তার। তিনি ১৯৬৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর তারিখ বরিশাল জেলার সদর উপজেলায় জন্মগ্রহন করেন। ৯ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ৭ম। তার পিতা পেশায় ছিলেন সরকারী সামান্য কর্মচারী।
শিক্ষা জীবন শেষে কর্মজীবনে তিনি ২০০০ খ্রীষ্টাব্দে বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলায় এবং ২০০৪ খ্রীষ্টাব্দে সদর উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হিসাবে যোগদান করে ২০২০খ্রীষ্টাব্দের ২৫ আগষ্ট পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ২৬ আগষ্ট বুধবার সকাল ৬ঘটিকায় ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বাগেরহাট সদরে যোগদানের পর থেকেই তিনি সদরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে নিরলস পরিশ্রম করে যান। দুর্বল প্রতিষ্ঠানের প্রতি রয়েছে তার ছিল বিশেষ নজর। প্রতিনিয়ত মনিটরিং এর মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠানের সকল খোজ খবর নিতেন। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় থেকে বিরত রাখার জন্য তিনি সচেতনতামূলক সমাবেশ ও প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেছেন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, যৌতুক প্রতিরোধ, দুর্যোগ মোকাবিলা, মাদককে না বলা, ইভটিজিং প্রতিহতকরণ, অপসংস্কৃতি প্রতিরোধে ইউনিয়ন ভিত্তিক সেমিনার এবং বাগেরহাট সদরের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে মা সমাবেশের ব্যবস্থা করেছেন যা সারা বাংলাদেশে ইতিমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে। এসব সমাবেশের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় থেকে বিরত থাকার শপথ পড়ানো হয়।
বাগেরহাট সদরে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৮৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে (স্কুল+মাদ্রাসা)। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীদের কল্যানে মাছুদা আক্তার নিয়েছেন বিশেষ উদ্যোগ। তিনি ২০১৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন শিক্ষক কর্মচারী চিকিৎসা কল্যান সমিতি। এই সমিতির মাধ্যম শিক্ষক কর্মচারী কেউ অথবা তার পরিবারের কোন সদস্য জটিল রোগে আক্রান্ত হলে তাদের জন্য সেবার ব্যবস্থা করা, কোন শিক্ষক কর্মচারী মারা গেলে সংগঠনের পক্ষ থেকে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করা ও তার দাফনকার্যে ব্যয়ের জন্য নগদ ১০ হাজার (দশ হাজার) টাকা সাহায্য প্রদান করা হয়। এ পর্যন্ত এ সংগঠনের মাধ্যমে ৫৬ জন শিক্ষক কর্মচারীর আনুষ্ঠানিক বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। ২৪ জন শিক্ষক কর্মচারীকে চিকিৎসার জন্য আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে। সংগঠনের সকল সদস্য ও তাদের পরিবার যেন মাত্র ১০০টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা, আইনী সহায়তা পায় সেজন্য একজন ডাক্তার, একটা ডায়াগনষ্টিক সেন্টার ও একজন আইনজীবির সাথে চুক্তি করা হয়েছে। এ কাজে বাগেরহাট জেলা প্রশাসন সার্বিকভাবে সহযোগীতা করছে। শিক্ষক কর্মচারীর কল্যানে বিশেষ অবদানের জন্য মাছুদা আক্তার শেরেবাংলা শাইনিং পার্সোনালিটি এ্যাওয়ার্ড-২০১৭ এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্বর্ণপদক-২০১৭ প্রাপ্ত হয়েছেন। ২০১৮সালে খুলনার এক সমাবেশে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ মাছুদা আক্তারের এ সকল কর্মকান্ডের প্রশংসা করেন। এ বছর রোকেয়া দিবসে তিনি ছিনিয়ে নিয়েছেন সেরা জয়ীতার স্বীকৃতি।
সামাজিক, ধর্মীয় কাজের পাশাপাশি তিনি শিক্ষকদের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় তিনি সদর উপজেলার সকল প্রতিষ্ঠান প্রধান ও অফিস সহকারীদের জন্য আইসিটি প্রশিক্ষনের ব্যাবস্থা করেছেন। এছাড়া ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ের জন্যও আলাদা প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেছেন যার ফলে শিক্ষকরা আরো বেশি দক্ষতার সাথে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে পারছেন। তার প্রচেষ্টার উপজেলার সকল শিক্ষক ইতিমধ্যে শিক্ষক বাতায়নের সদস্য হয়েছেন। মুক্তপাঠ, কিশোরপাঠ সম্পর্কে অবহিতকরন সভা করা হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনা করা হয় এবং তা নিয়মিত ড্যাশবোর্ডে আপলোড করা হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্য শিক্ষা সফরের ব্যবস্থা, নারী শিক্ষার উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য বাল্যবিবাহ রোধে বিবাহ মঞ্চ থেকে কনের বাবা মাকে প্রশাসনের সহায়তায় জেল হাজতে প্রেরণ করেছেন।
শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা পালনের জন্য ২০১৯ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে তিনি জেলার গন্ডি পেরিয়ে খুলনা বিভাগের শ্রেষ্ঠ মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে মনোনীত হয়েছেন।
এই প্রতিভাবান মহিয়সী নারী ২০১৪ ইং সালে জটিল রোগ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। দীর্ঘ ৭টি বছর অসুস্থ থেকে ২০২০ সালের ২৬ আগষ্ট বুধবার সকাল ৬ঘটিকায় তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। তিনি আর কোনদিন ফিরে আসবেননা আমাদের মাঝে। তবে তিনি চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবেন বাগেরহাট বাসীর কাছে। তার এ সকল মহৎকর্ম চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়।