অনিয়মে একাই একশো প্রধান শিক্ষক জসিম
নিজস্ব প্রতিবেদক, বান্দরবানঃ জেলার লামা উপজেলার ফাইতং উচ্চ বিদ্যালয়ে একাধিক শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগে বিগত দিনের তারিখ দেখিয়ে অনিয়ম করে ও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এই অভিযোগ বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক জসিম উদ্দিন এর বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর জুলাই মাসে ফাইতং উচ্চ বিদ্যালয় নিন্ম মাধ্যমিক থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের রুপান্তর করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে প্রধান শিক্ষক নবম ও দশম শ্রেণির জন্য পূর্ববর্তী তারিখ (অর্থাৎ ২০১৪ সালে) নিয়োগ দেখিয়ে কুতুব উদ্দিন ও মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনকে সহকারী শিক্ষক এবং মোহাম্মদ ফেরদৌস নৈশ প্রহরী পদে প্রায় দশ লক্ষ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিয়ে গোপনে এমপিও ফাইল প্রেরণ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বিদ্যালয়টির সাবেক ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শহিদুল্লা মিন্টু।
লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, সহকারী শিক্ষক (ব্যবসা শিক্ষা) কুতুব উদ্দিন ২০১৮ সালের ৯ই জানুয়ারী দৈনিক পূর্বকোনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক প্রাতিষ্ঠানিক বেতনে নিয়োগ পান। তিনি ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চকরিয়া ক্যামব্রিয়ান স্কুল এন্ড কলেজে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে এবং ২০১৬ সাল থেকে বর্তমানেও চকরিয়া ইনটারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ এবং বদরখালী ইনটারন্যাশনাল বালিকা স্কুল এন্ড কলেজের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। তিনি মাঝে মাঝে বিদ্যালয়ে এসে প্রধান শিক্ষকের কথামতো না আসা দিনগুলো স্বাক্ষর করে দেয়। ২০১৮ সালের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী নিয়োগ পেলেও ফাইতং উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ২০১৪ সালের নিয়োগ দেখিয়ে নতুন এমপিওভুক্তির জন্য ফাইল প্রেরণ করেছেন।
বিদ্যালয়ে কোন দিন না এসেও নিয়োগ পেয়েছেন মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন নামের সমাজবিজ্ঞানের এক সহকারী শিক্ষক। মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনকে কেউ কোনদিন বিদ্যালয়ে দেখেনি এবং একদিনের জন্য ও বিদ্যালয়ে আসেনি। প্রধান শিক্ষক মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ভূয়া রেজুলেশন তৈরি করে পূর্বের কমিটির স্বাক্ষর জাল করে ফাইল তৈরি করেন এবং গত বছরের সেপ্টম্বর মাসে জনতা ব্যাংক জামা শাখায় উক্ত শিক্ষকের নামে ফাইতং উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকের তালিকায় হিসাব নং - 01002346588৭০ খোলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালে ১০ মার্চ, দৈনিক পূর্বকোন পত্রিকায় ১ জন করে আয়া, নৈশ প্রহরী এবং নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু প্রধান শিক্ষক সেই নিয়োগ বন্ধ করে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে আরও একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে যেখানে নৈশ প্রহরির পদ বাদ দিয়ে আয়া, অফিস সহায়ক ও নিরাপত্তা কর্মীর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। প্রথম নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে নৈশ প্রহরির পদে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও দেখে গেছে, ২০১৪ সালের নিয়োগ দেখিয়ে লামার রাঙ্গাঝিরি এলাকার মফিজুর রহমানের পুত্রের ফেরদৌসকে নৈশ প্রহরি পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। এরপর প্রধান শিক্ষক গোপনে উক্ত কর্মচারীর এমপিও করে। যার ইনডেক্স নম্বর N 56817332।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (শরীর চর্চা) নুরুল আমিন এর নিবন্ধন সনদটি জাল প্রমানিত হওয়ায় উক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য বেসরকারী শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ ১০/০২/২০১৪ ইং তারিখে স্বারকঃ বেশিনিক/শি.শি./সনদ যাচাই (সকল)/৪২১(অংশ-০)/২০১৩ মূলে প্রধান শিক্ষককে নির্দেশ করেন। কিন্তু প্রধান শিক্ষক ঐ শিক্ষক থেকে প্রতি মাসে বেতন থেকে শতকরা হারে টাকা নিয়ে এখনো পর্যন্ত উক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেনি।
নিবন্ধনের জাল সনদে ১০ বছর ধরে চাকরি করছেন ফাইতং উচ্চ বিদ্যালয়ের শরীর চর্চা (সহকারী শিক্ষক) মো. নুরুল আমিনে। নুরুল আমিন ২০০৯ সালের ৭ জুলাই উপজেলার লামামুখ উচ্চ বিদ্যালয়ের শরীর চর্চা পদে নিয়োগ পায়। এরপর ২০১২ সালে তিনি বদলী হয়ে ফাইতং উচ্চ বিদ্যালয়ে শরীর চর্চা (সহকারী শিক্ষক) পদে যোগদান করেন। ২০১১ সালের দিকে এমপিওভুক্ত হন এ শিক্ষক। বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন কাগজপত্র যাচাই করতে গিয়ে শিক্ষক নুরুল আমিনের শিক্ষক নিবন্ধন সনদটি যাহার রোল নং ৩১১৭০২৫৬ নিয়ে সন্দেহ হয় বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির। এ কারণে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার সনদের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য এনটিআরসিএ’র কাছে পাঠায়। যাচাই শেষে ২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল স্মারক নং বেশিনিক/শি.শি/সনদ যাচাই (সকল)/৪২১(অংশ-০)/২০১৩/৩৩৫ মূলে এনটিআরসিএ’র উপ-পরিচালক (শিক্ষা তত্ব ও শিক্ষা মান) মাধব চন্দ্র রুদ্র স্বাক্ষরিত পত্রে জানিয়ে দেওয়া হয় শরীর চর্চা পদের শিক্ষক নুরুল আমিনের নিবন্ধন সনদটি জাল ও ভুয়া। এ প্রেক্ষিতে ভুয়া ও জাল সনদধারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করে তা কর্তৃপক্ষকে অবগতি করার জন্য নির্দেশও দেয় এনটিআরসিএ। এরপরও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জসিম উদ্দিন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বরং অভিযোগটি গোপন করে রোল নং ৩১১৭০২৫৬ এর স্থলে ৩১১৭০২৬০ বসিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষকের নামে আরেকটি নতুন নিবন্ধন সনদ উপস্থাপন করে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকৃত ও কর্মরত শিক্ষকদের তথ্যাদি প্রেরণ করেন এবং নিয়মিত বেতন ভাতা প্রদান করে আসছেন। এমনকি এই শিক্ষকের প্রতিমাসের এমপিও'র একটি অংশ প্রধান শিক্ষকের পকেটে যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীদেরকে দেওয়া উপবৃত্তির সাথে বিদ্যালয়ের জন্য টিউশন ফি; বাবদ অগ্রণি ব্যাংক, লামা, আজিজনগর শাখায় বিদ্যালয়ের একাউন্টে জমা হয়। ঐ একাউন্ট হতে প্রধান শিক্ষক ভিভিন্ন চেক মারফত সর্বমোট এক লক্ষ চুরানব্বই হাজার পাঁচশত টাকা উত্তোলন করে চলিত ব্যাংকে জমা করেনি। সেই টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন।
জানা গেছে, ফাইতং উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে জনতা ব্যাংক লামা শাখায় এফডিআর ছিল। ২০১১ সালে প্রধান শিক্ষক সেই এফডিআর বিলুপ্ত করে সোনালি ব্যাংক লামা শাখায় নতুন এফডিআর চালু করে। কিন্তু বিগত ২০ বছরে উক্ত এফডিআরের লভ্যাংশ বিদ্যালয়ের চলিত ব্যাংকে জমা করেনি।
এ বিষয়ে অভিযোগকারী বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শহিদুল্লা মিন্টু শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, বিগত ৩/৪ বছরে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয়ের কাছে দেওয়া হলেও কোন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমি এই অভিযোগ মাউশি ঢাকা এবং মাউশি চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ে জমা দিয়েছি। তবে এখন পর্যন্ত কোন তদন্ত হয়নি।
তিনি আরও বলেন, আমি যেখানেই অভিযোগ দেইনা যে কোনো উপায়েই হোক প্রধান শিক্ষক লবিং করে তার তদন্তের কাজ আটকিয়ে রাখেন। অভিযোগ গুলো তদন্ত করলে তার শতভাগ সত্যতা পাওয়া যাবে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক জসিম উদ্দিনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
এ বিষয়ে ফাইতং উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এহসান উল্লা শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, অভিযোগগুলো নিয়ে বিভিন্ন টানা হেচরা হয়েছে। একাধিকবার শিক্ষা কর্মকর্তা এসেছন। এই বিষয়ে প্রধান শিক্ষক ভালো বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (লামা উপজেলার দায়িত্বেও তিনি) সরিয়ে কুমার চাকমা শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, এই স্কুলটির অভিযোগের শেষ নেই। আমি কয়েকবার প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়েছি। একটা বিষয়ে সমাধান হয় তো আর একটা অনিয়ম ধরা পরে। যদি শিক্ষা অধিদপ্তর বা অডিট ডিপার্টমেন্ট থেকে কেউ এসে তদন্ত করতেন তাহলে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা যেত।